শিরোনাম
স্মৃতিঘেরা মালনীছড়া চা বাগান
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৭, ০৯:০৮
স্মৃতিঘেরা মালনীছড়া চা বাগান
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

শরত বা শীতের পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সকালে এক কাপ ধোয়া ওঠা চা কার না ভাল লাগে? চা এমন একটি পানীয় যা কম বেশি সবাই পান করেন, আর অনেকের কাছে তো রীতিমত একটা নেশা। এ তো গেল চা এর কথা। এই চার পেছনে যে গল্পটা রয়েছে সেই চা-পাতার কুড়িকে দেখেছেন কি? যদি না দেখে থাকেন তবে কর্মব্যস্ত জীবনের কিছুটা অবসর মুহুর্তে যেতে পারি বাংলাদেশের প্রাচীন চা বাগান মালনীছড়ায়।


সিলেট শহর থেকে উত্তর দিকে বিমান বন্দর সড়কের পাশেই ১৮৫৪ সালে মালনীছড়া চা বাগানটি যাত্রা শুরু করে। দেড় শতাব্দীর মালনীছড়া বহু ইংরেজ, পাকিস্তানি এবং বাংলাদেশী ব্যবস্থাপকের হাত ঘুরে ১৯৮৮ সালে শিল্পপতি রাগীব আলীর মালিকানায় নিবন্ধিত হয়। প্রায় আড়াই হাজার একর ভূমিস্বত্ব সীমানায় উঁচু-নিচু সবুজ টিলার সমারোহ মালনীছড়া চা বাগানটি বেষ্টিত। চা আবাদের জন্য একহাজার দুইশত একর জমি, রাবার আবাদের জন্য সাতশত একর জমি এবং কারখানা, আবাসন, বৃক্ষরাজি, বনজঙ্গল জুড়ে আছে বাকী জমিটুকু। ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে ‘এসো বন্ধু আমার সবুজ ছায়ায় এসো-এক সাথে আনন্দ উল্লাস করি।


❏ চা বাগানে মেঘকন্যার গল্প: দূর মেঘালয় থেকে হিমবাতাস বয়ে নিয়ে আসে অতিথি মেঘকন্যাকে। তারপর চা বাগানের আকাশ সাজে শুভ্র মেঘমালায়। এক সময় মেঘকন্যা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে নরম কচি চা পাতার উপর। বৃষ্টির পরশে চায়ের পাতার রং বদলায়। বর্ষায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তোলার উপযুক্ত সময়। অর্থাৎ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চা এর মৌসুম। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি এ দুমাসে চা প্লাকিং করা হয় না। কারণ শীতকালে অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় চা পাতার কুঁড়ি বৃদ্ধি পায় না। চা গাছের সব পাতায় কিন্তু চা হয় না। শুধুমাত্র দুটি পাতা এবং একটি কুঁড়ি হলো চা এর মূল উৎস। দুটি পাতা থেকে আসে লিকার এবং কুঁড়ি থেকে আসে ফ্লেবার।


চা বাগান মানেই দিগন্তপ্রসারী সবুজের মাঝে ছায়াবৃক্ষের মিলন মেলা। নির্ভীক যাত্রী আপনি, অপলক তাকিয়ে থাকবেন চা বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ ঝরনার পানে। ছোট ছোট টিলায় ভুটান ফুলে হারিয়ে যাবে মন অনাবিল আনন্দে। হঠাৎ আপনি চমকে উঠবেন যখন ঝরনার জলে স্পর্শ পাবেন গাড় সুবজ শৈবালের। কখনও গভীর অরণ্যে উপলব্ধি করতে পারবেন আলো ছায়ায় মায়াময় লুকোচুরি খেলা।


মালনীছড়ায় আছে কমলা বাগান, কাঁঠাল বাগান, সুপারি বাগান। আরো দেখবেন গুল মরিচের লতানো গাছ, ট্যাং ফল, আগর, চন্দনসহ অনেক ঔষধি-শোভাবর্ধক বৃক্ষ। উঁচু-নিচু টিলায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। এর মাঝেই দেখা হয়ে যেতে পারে সবুজ টিয়া অথবা শালিকের উচ্ছ্বল নৃত্য। উঁচু টিলায় আছে শিব মন্দির। পরিচিত হবেন মানীছড়া রাবার প্রকল্পের সাথে। কিভাবে চাপাতা প্রক্রিয়াজাত করণ এবং রাবার উৎপাদন হয় তারও একটি বাস্তব চিত্র আপনি দেখতে পাবেন।


কোম্পানি বাংলোতে আছে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ। বাংলো চত্ত্বর পরিপূর্ণ দেশী-বিদেশী ফুল আর বিরল প্রজাতির ক্যাকটাসে। প্যারাডাইস ফুল দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন।


❏ ইতিহাসের ছোঁয়া: ‘মালনীছড়া চাবাগান’ ইতিহাসের অংশ। সেই অমৃত ইতিহাস পরিদর্শনে আপনি পাবেন শতাব্দীর অনেক পেছনের বাস-বতার স্পর্শ। মালনীছড়ায় এখনও সেই ইতিহাসের কিছু নিদর্শন পরিপাটি করে সাজানো আছে।


জটকোণা পাহাড় (যেখানে গাছের শিকড় থেকে বিন্দু বিন্দু পানি ঝরে পড়ছে টিলার নীচের বালুময় স্থানে) আবাদানী পাহাড়, হারুং হুড়ুং গুহা (হযরত শাহজালাল (রা:) এর কাছে পরাজিত হয়ে রাজা গৌর গোবিন্দ এ পাহাড়ের মধ্যে সৃষ্ট দুটো গুহাপথ দিয়ে পলায়ন করেন। আজও গুহা দুটি কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।


মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত চা বাগান মালনীছড়া। ১৯৭১ সালে চা বাগানের দায়িত্বে ছিলেন শওকত শাহনেয়াজ। পাক আর্মিরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অফিস থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। বাংলার পাশ্ববর্তী এলাকায় তিনি শহীদ হন। তার স্মৃতিরক্ষার জন্য একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।



❏ চা শ্রমিকের জীবনযাপন: ভোরের চা বাগান নীরব; নিরব কোয়াটার্স, নিরব শ্রমিক আবাস। হঠাৎ বাতাসের ছোঁয়া পেলে চা পাতা একটু কেঁপে অনুভূতি প্রকাশ করে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ে। রৌদ্রস্নাত দুপুরের নিস্তব্ধতায় শোনা যায় চা পাতা তোলার শব্দ। কখনো হালকা গানের সুর আবার কখনো চুপিচুপি কথা বলার অনুরাগের এক মুহুর্ত।মধ্য দুপুরে চাপাতা ওজন দিয়ে জমা দেয়া হয়। তারপর মধ্যাহ্নের খাবার খেয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নেয়।


খাবার বলতে লবণমিশ্রিত ঠাণ্ডা চা এবং রুটি। বিশ্রাম শেষে শুরু হয় ২য় দফা কাজ। রোদ, অসহ্য গরম আর বৃষ্টি উপেক্ষা করেই তাদের কাজ করতে হয়। দুপুরের অবসরে সংগৃহীত ঘাস, কচুরলতি, ঢেঁকিশাক ইত্যাদি বনজ উপকরণ নিয়ে অপরাহ্নে তারা বাড়ি ফিরে। সবাই জানে চা শ্রমিকরা উৎসব প্রিয়। সবচেয়ে বড় পার্বন হচ্ছে, হোলি খেলা বা দোল উৎসব।


এ সময় বাগান তিনদিনের ছুটি থাকে। মাদলের তালে তালে লাঠি নৃত্য আর ঝুমুর গানে মুখরিত হয় শ্রমিক পল্লী। এছাড়াও গ্রাম পূজা, টুসুপূজা, দূর্গা পূজা চা বাগানের উৎসবের আওতায় পড়ে।


❏ কিভাবে যাবেন: সিলেট-বিমান বন্দর সড়কের পাশেই মালনীছড়া চা বাগানের অবস্থান। মালনীছড়ায় বেড়াতে এলে থাকার জন্য কোন সমস্যায় পড়তে হবে না আপনাকে। কারণ এর পাশাপাশি রয়েছে অত্যাধুনিক একটি হোটেল ও মোটেল। আরো কাছে রয়েছে একটি রেষ্ট হাউজ (লাক্কাতুরা চা বাগানে এর অবস্থান)। মালনীছড়া চা বাগানের একেবারেই শেষ সীমানায় ওসমানী বিমান বন্দরের পাশেই সিলেট পর্যটন মোটেলের অবস্থান।


সিলেট শহর থেকে রিকশাযোগে অথবা অটোরিকশা বা গাড়িতে বিমানবন্দর রোডে চাবাগানটি পাওয়া যাবে। গাড়িতে যেতে আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে ১০ মিনিট এর পথ। রিকশাযোগে যেতে আধঘন্টা লাগবে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশের ভিতরই এমন সুন্দর চা বাগান দেখে আসতে পারেন আর নিতে পারেন নির্মল আনন্দ।


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com