শিরোনাম
নীল নদ কাছে টানে, স্বপ্নে জড়ায়
প্রকাশ : ২৫ মে ২০১৭, ০৯:১৯
নীল নদ কাছে টানে, স্বপ্নে জড়ায়
জিয়া হাবীব আহসান
প্রিন্ট অ-অ+

মিশরের রাজধানী কায়রো প্রদক্ষিণকালে মনে হচ্ছিল পুরো শহরটিই যেন একটি জাদুঘর এ শহরকে কেউ বলে হাজার মিনারের নগরী আর মিশরীয়রা গর্বভরে বলেন, পৃথিবীর সমস্ত শহরের মা । কেননা এ নগরী বিশ্বের অন্যতম বড় এবং পুরনো সভ্যতার নগরী। ঐতিহাসিক নীলনদের দুই কূলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই আধুনিক কায়রো নগরী। এখানে মনোমুগ্ধকর সুউচ্চ দালান, কারুকার্য খচিত অসংখ্য মিনার, পিরামিড, ফারাওদের বিশাল মূর্তি, অসংখ্য সুদীর্ঘ ফ্লাইওভার, প্রশস্ত রাস্তা যে কোন পর্যটকের দৃষ্টি আর্কষণ করবেই।


আমাদের বাংলাদেশী ১৮জনের ভিজিটরস টিমের দিনভর কায়রো সিটি ট্যুর চলাকালে কিছু কিছু এলাকায় অনেক পুরানো দালান কোঠাও চোখে পড়ে। পুরনো শহরের দালান কোটা দেখে মনে হবে যেন হয়রত নূহ আলাইহিস সালামের যুগে বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার পর এসব স্থাপনার উপর আর রঙ্গের প্রলাপ পড়েনি। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নীলনদের দুই তীরে বিলাসবহুল ফাইভ স্টার ও থ্রী স্টার মানের হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, ক্লাব, পার্ক ইত্যাদি নিমার্ণ করা হয়েছে। নীলনদের ভাসমান সুসজ্জিত বিলাস বহুল প্রমোদতরী গুলো যেন পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মিশর সরকারের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পর্যটন। দিনের চেয়ে রাতের আলোর ঝলমল দৃশ্য আরো বেশি দৃষ্টিনন্দন। তাই কোথাও যেন যানজট সৃষ্টি না হয় তার জন্যে বিশাল রাস্তাগুলোর মধ্যে ডিভাইডার ও ওয়ান ওয়ে চলাচল ব্যবস্থা রয়েছে ।



যাওয়া আসার পথে ৫টি করে লেন, দু পাশের লেন বেয়ে ১০টি করে গাড়ি ডিভাইডারের সীমানা রক্ষা করে নিয়ম মাফিক নিয়ন্ত্রিত গতিতে যাতায়াত করছে। আমার ছেলে যাওয়াদকে বললাম, দেখো আমাদের দেশের মতো যেখান সেখান দিয়ে পথচারীরা এখানে রাস্তা পারাপার করে না, কিংবা যেখানে সেখানে পসরা সাজিয়ে ফেরিওয়ালার বহর বা রাস্তাঘাটে সর্বদা খুঁড়া খুঁড়ির দৃশ্য চোখে পড়ে না। এসব কারণে যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ খুবই কম।


মিসরকে বলা হয় নীলনদের দান। এ নদী আসওয়ান বা প্রথম জলপ্রপাত পর্যন্ত নাব্য। নীলনদের ব-দ্বীপে অসংখ্য শাখা নদী রয়েছে। নীল নদের উপর দিয়ে আমাদের বহনকারী এসি বাসটি ব্রীজ পার হচ্ছিল। গাইড আহমদ বললেন, ‘এসব নদীর মধ্যে রসেট্টা ও ডামিয়েট্রা সবচেয়ে বড়। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীর মধ্যে নীলনদ হলো অন্যতম। এর একাধিক উৎসের মধ্যে আফ্রিকার বুরুন্ডির উচ্চ ভূমিতে ট্রাঙানিকা হৃদের উত্তরে কাগেরা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে ভিক্টোরিয়া হ্রদে পতিত হয়েছে। এটি উগান্ডার ভিক্টোরিয়া হৃদের উত্তর তীরের জিঞ্জা থেকে শুরু হয়েছে। নীল নদ প্রায় ৪১১৫ মাইল আফ্রিকায় নয়টি দেশের বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, জায়ারে, সুদান, ইথিওপিয়া ও মিশরের মধ্যে ১১,৫০,০০০ বর্গমাইল খাতে দক্ষিণে পানি সংগ্রহ করে ৯৩৫ মাইল উত্তর মুখে প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরে পতিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ নীল নদ মিশরের দক্ষিণে ইথিওপিয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে উত্তরে ভূমধ্যসাগরে পতিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতের বেলায় ঠিক এর উল্টো অর্থ্যাৎ উত্তরে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে শেষ হয়।


বর্তমান মরুভূমি এখনকার অপ্রবেশ্য অরণ্য এই নীলনদ তীরবর্তী অঞ্চলেই ৫০০০ বছর পূর্বে মিশরীয় সভ্যতার উদ্ভব হয়। এই নদীর কোনো শাখা বা উপনদী মিসরে নেই। তাই যে দিকেই যাচ্ছিলাম সেদিকেই নীলনদকে পাচ্ছিলাম। মজার কথা হল, নীল নদের আসল নাম নীল নয়, নাইল। নাইল কবে কেন যে নীল হয়ে গেল তা জানতে পারিনি। তবে সম্ভবত আকাশের নীল রঙের মত পানির রঙ নীল দেখা যায় বলে কোন বাঙালি কবি একে নীল নদ নামে অভিহিত করেছিলেন। চওড়ায় ঢাকার বুড়িগঙ্গা থেকে সামান্য বড় হলেও এর গভীরতা অনেক।


ইতিহাস থেকে জানা যায়, আদি মিসরীয়রা নীল নদের বন্যার পানীয় উপযুক্ত ব্যবহার করে নানা ধরনের ফসল, খাদ্যশস্য, পশুখাদ্য উৎপাদন কৌশল রপ্ত করেছিল। নীলনদের পানির ধারা পাহাড়ি প্রতিবন্ধকতাকে পেড়িয়ে ৬টি জলপ্রপাত সৃষ্টি করেছে। মিশরের সৌন্দর্যই যেন নীলনদ। লন্ডনের টেমস নদীর মতোই স্রোতস্বীনী এ নদী। আমাদের বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলীকে চাইলে এভাবে সাজানো যেত। কথিত ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং বা মেরিন ড্রাইভের নামে স্রোতস্বিনী পাহাড়িকন্যা কর্ণফুলী নদীকে এখন সংকীর্ণ খালে পরিণত করা হয়েছে।


নীলনদের বক্ষে ভ্রমণ ও নৈশভোজের অফার গ্রহণ করলাম না কারণ পরদিন আমাদের যেতে হবে বহুদূরে তুরে সিনাই পর্বতমালায়, যেখানে হযরত মুসা (আঃ) তাঁর প্রভুর সাথে কথা বলে ছিলেন। যাক সে কথা আমাদের টিম লিডার ড. মফিজুর রহমান আযহারী সাহেব নীলনদকে নিয়ে এক কিংবদন্তীর ঘটনা বর্ণনা করলেন যা আমরা শুনে হতবাক হলাম। তা ছিল নীলনদকে আমিরুল মুমেনীন খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর প্রদত্ত একটি চিঠির ঘটনা নিয়ে ।পাঠ করা এ ঘটনাটি শুনে হতবাক হবেনচলন্ত বাসে সিটি ট্যুর চলছিল, টিম লিডার মাউথ স্পিকারে বলতে লাগলেন:



‘খলিফাতুল মুসলিমীন, আমিরুল মুমেনীন হয়রত ওমর ফারুকের (রাঃ) শাসনকাল। মিশর মুসলমানদের করতলগত হলো। আমর ইবনে আসকে খলিফার পক্ষ থেকে মিশরের গভর্নর নিয়োগ করা হলো। যে মিশরকে নীল নদের দান বলা হয় সে মিশরের শাসনের দায়িত্বভার নেয়ার পর মিশরের কিছু লোক তথাকার গভর্নর আমর ইবনে আসের কাছে একটি জঘন্যতম কুপ্রথার সংবাদ অবহিত করান। ব্যাপরটি ছিল এরূপ প্রতিবছরের একটি নির্দিষ্ট মাসের একাদশ রজনী অতিবাহিত হওয়ার পর যদি মিশরের সর্বাপেক্ষা ষোড়শী সুন্দরী কুমারী তরুণীকে উত্তমরূপে গোসল দিয়ে মূল্যবান কাপড় চোপড় ও অলংকার পরিধান করিয়ে নীল নদে নিক্ষেপ করে অর্ঘ্যস্বরূপ নিবেদন করা হয় তবে নদীতে জলপ্রবাহ শুরু হয় এবং জোয়ারের পানি নদীকে তখন জীবন্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। একাজ না করলে নীলনদের পানি প্রবাহিত হয় না। মিশরবাসীও সম্মুখীন হতো প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষের। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও কুপ্রথাকে চিরতরে উৎখাত করতে দুনিয়ার বুকে ইসলামের একজন শ্রেষ্ঠ সাহাবার খেলাফতকালে এমন জঘন্যতম কুসংস্কার চলতে পারে না। হযরত ওমর (রা.) এ প্রথাকে পালন না করায় নীল নদের পানি প্রবাহও বৃদ্ধি পেল না। দেশবাসীও দুর্ভিক্ষের আশংকায় শংকিত হয়ে দেশত্যাগের চিন্তা ভাবনা করছিল। উদ্ভূত সমস্যার কথা জানিয়ে গভর্নর আমর ইবনে আস আমীরুল মুমেনীন হযরত ওমরের (রা.) কাছে পত্র লিখলেন। হযরত ওমর (রাঃ) গভর্নরের পত্র পেলেন।


উত্তরে তিনি মিশরের গভর্নরকে লিখলেন, ‘হে আমর ইবনে আস! তুমি যে কাজ করেছ সত্যি সঠিক এবং বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তির কাজ করেছ। নিশ্চয়ই ইসলামের আগমন ধর্মান্ধতা ও কুপ্রথাকে উচ্ছেদ করতে। হয়রত ওমর ফারুকের (রা.) পত্র পেয়ে আমর দেখলেন সেখানে আরও আলাদা একখানা পত্র। পত্রে খলিফা ওমর (রা.) মিশরের গভর্নরকে আলাদা পত্রখানা নীলনদে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিলেন। দ্বিতীয় পত্রটিতে হযরত ওমর (রাঃ) এর নিজ হাতে লিখা ছিল, ‘এ পত্র আল্লাহর বান্দা ওমর (রা.) হতে প্রেরিত হলো মিশরের নীল নদের প্রতি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, দরূদ ও সালাম মহানবী (সাঃ) এর প্রতি নিবেদন করে, হে নীল নদ । তুমি যদি স্বেচ্ছায় প্রবাহিত হয়ে থাকো তবে তুমি আর কখনও প্রবাহিত হয়ো না । তোমার সে পানি আমাদের প্রয়োজন নেই । আর যদি মহান স্রষ্টার নির্দেশে তুমি প্রবাহিত হয়ে থাকো তবে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর কাছে মুনাজাত করছি তিনি যেন তোমাকে প্রবাহিত করেন।’ নির্ধারিত তারিখের পূর্ব রজনী। মিশরের গর্ভনর আমর নীলনদের প্রতি লিখিত হযরত ওমর (রা.) এর পত্রখানা নিজ হাতে নীল নদের বক্ষে নিক্ষেপ করলেন। সমস্ত মিশরবাসী পরদিন ভোরবেলা এক রাতের মধ্যেই নদীর পানি ১৬হাত বেড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে হতভম্ভ হয়ে গেলো। যে নদী জীবন্ত সুন্দরী নারীর জীবনের বিনিময়ে স্বীয় প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখতো দীর্ঘদিনের সে কুপ্রথাকে চিরতরে উৎখাত করলো হযরত ওমর (রা.) এর নিজ হাতে লিখা একখানা ছোট্ট চিঠির বিনিময়ে।


মিশরবাসী অমানবিক কুপ্রথার হাত থেকে রেহাই পেলো না, সেদিন থেকে আজ অবধি পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে নীলনদী নিয়মিত প্রবাহিত। খোলাফায়ে রাশেদীনের কামেলিয়াতের এর চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কি হতে পারে। নীল নদকে নিয়ে এ কিংবদন্তীর ঘটনা শুনতে শুনতে আমরা মিশর বিজয়ী বীর আমর ইবনে আস মসজিদের সামনে এসে দাঁড়ালাম।


মিশরের ফুসতাদ এলাকায় বিশাল মসজিদটি অবস্থিত। ফুসতাদ মানে হলো তাঁবু। সেখানে মিশর বিজয়ীরা তাঁবু গেড়েছিল বলে হয়তো এলাকায় এই নাম। এটি নাকি আফ্রিকার প্রথম মসজিদ। যা মিশরের তদানিন্তন গভর্নর আমর ইবনে আস প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সংখ্যায় এসব নিয়ে আরো চমৎকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরার প্রত্যাশা রাখি।


লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com