শিরোনাম
কালের সাক্ষী বেলে পাথরের মন্দির
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৩৩
কালের সাক্ষী বেলে পাথরের মন্দির
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে ১৯ শতকের দিকে স্থাপিত হয় বেলে পাথরের মন্দির। যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের খরসূতি গ্রামে এটি অবস্থিত। রায় সাহেব ঈশান চন্দ্র ঘাষে এটি নির্মাণ করেছেন বলে জানা যায়।


ধারণা করা হয়, মন্দিরটি ১৮০০ সালের শেষের দিকে স্থাপিত। মন্দির ছাড়াও তিনি ‘খরসূতি চন্দ্র কিশোর বহুমূখি উচ্চ বিদ্যালয়’, ‘শশীমুখি দাতব্য চিকিৎসালয়’সহ বেশ কয়েকটি পুকুর খনন, রাস্তা-ঘাট ও বেশ কিছু মন্দির নির্মাণ করেন। যা আজও এলাকায় ঐতিহ্য বহনের পাশাপাশি কালের সাক্ষী হয়ে আছে।


তার মধ্যে স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয়টি ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। স্থাপনাগুলোর অবস্থাও জরাজীর্ণ। অনেকটা অযত্ন-অবহেলায় মন্দিরটি তালাবদ্ধ। এসব ভবনগুলো সংস্করণের অভাবে ভাঙন ধরেছে। এখান আর সেখানে হয় না পূজা-অর্চনা।


মন্দিরটি উত্তর ভারতীয় গুজরাট রাজ্যে অবস্থিত নাগেশ্বর মন্দিরের আদলে নির্মিত। মন্দিরটির উত্তর ও দক্ষিণে দু’টি কাঠের তৈরি দরজা আছে। দরজার পাল্লায় কাঠের কারুকার্যমণ্ডিত দু’টি মুখোমুখি সাপ পেচানো আছে। দুই পাল্লার মাঝে কাঠের বিষ্ণুমূর্তি বিদ্যমান।


দক্ষিণ পাশের বারান্দায় একটি বিষ্ণুমূর্তি আছে। মন্দিরের ভেতরে একটি বিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপনা করা হয়েছিলো, তবে বর্তমানে তা আর নেই। সেটি চুরি হয়ে গেছে বলে শোনা যায়। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে এ ধরনের মোট ১৩ টি মন্দির আছে, যার মধ্যে বাংলাদেশে এটি একটি। মন্দিরটি দীর্ঘকাল ধরে তালাবদ্ধ।


মন্দিরটি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ঈশান চন্দ্র ঘোষ স্মৃতি বিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। ঈশান চন্দ্র ঘোষ (রায়বাহাদুর) বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের খরসূতি গ্রামে ১৮৫৮ সালের (বাংলা ১২৬৭ সাল) মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন।


ময়না ইউনিয়নটি তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত ছিলো। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে অপরের সাহায্যে ও নিজ প্রচেষ্টায় বৃত্তিসহ ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন এফ এ ও জেনারেল ইনস্টিটিউশন থেকে বিএ পাশ করেন।


১৮৮২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে এম এ পাশ করে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি কিছুদিন গৃহশিক্ষকতা ও সংবাদপত্রে রচনাদি লিখে সংসার চালালেও ১৮৮৫ সালে নড়াইল হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।


১৯১১ সালে জন্মভূমি বোয়ালমারীতে ‘জর্জ একাডেমী’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হন। ১৯১২ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্ট বিভাগের ডেপুটি স্কুল ইন্সপেক্টর পদে যোগদান করেন। ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তে প্রথম বাঙালি হিসেবে কলকাতা ডেভিড হেয়ার স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।


তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যেও তার অবদান অপরিসীম ‘নতুন শিশুপাঠ’ তৎকালীন স্কুলপাঠ্য পুস্তক হিসেবে গৃহীত হয়। এ ছাড়াও ‘হিতোপদেশ’, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, ‘মহাপুরুষ চরিত’ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিলো।


এখনও ভারতের আসাম রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের বাংলা পাঠ্যবইয়ের প্রথম প্রবন্ধ ঈশান চন্দ্র ঘোষ অনূদিত ‘জাতক কাহিনী’ থেকে নেওয়া হয়েছে। সাহিত্যিক হিসেবে তার লেখক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে পালি ভাষায় ‘জাতক মালা’এর অনুবাদক হিসাবে।


বৃদ্ধ বয়সে পালি ভাষা শিখে একক প্রচেষ্টায় ১৬ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছয় খণ্ডে জাতকের অনুবাদ শেষ করেন। যা বৌদ্ধ ধর্মের বাংলাভাষীদের কাছে অমূল্য সম্পদ এই বৌদ্ধজাতক গ্রন্থটি। মূল গ্রন্থটি পালি ভাষায় রচিত হয়েছে।


এ ছাড়াও ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক হিসেবেও অপরিসীম অবদান রেখেছেন তিনি। অনেকগুলো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের পরামর্শদাতা ও কয়েকটির পরিচালক ছিলেন। বিভিন্ন জনহিতকর কাজে বহু অর্থ দান করেন।


এলাকাবাসী জানান, তিনি তার মায়ের নামে ‘কালিতারা দাতব্য চিকিৎসালয়’ ও বাবার স্মৃতি রক্ষায় ‘খরসূতি চন্দ্র কিশোর বহুমূখি উচ্চ বিদ্যালয়’ ও বঙ্গেশ্বরদীতে স্ত্রীর নামে ‘শশীমুখি দাতব্য চিকিৎসালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। কয়েকটি পুকুর খনন,রাস্তা-ঘাট ও বেশ কিছু মন্দির নির্মাণ করেন।


যার মধ্যে খরসূতি নিজের বাড়ির সামনে বেলে পাথরের মন্দির। আজও ফরিদপুরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। এছাড়াও যাদবপুর ও কসৌলী যক্ষ্মা হাসপাতালেও বিপুল পরিমাণ অর্থদান করেছিলেন।


ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতিনামা অধ্যাপক প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ তার জ্যৈষ্ঠপুত্র। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু’র স্ত্রী শ্রীমতী বাসন্তী ঘোষ ঈশান চন্দ্র ঘোষের নাতনি। এসব তথ্য বোয়ালমারীর সন্তান কবি, সাহিত্যিক সমর চক্রবর্তীর’র লেখা ২০০৫ সালে ‘ভূষণা রাজ্যের ইতিহাস’ (গবেষণামূলক আঞ্চলিক ইতিহাস) গ্রন্থ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানাযায়।


ময়না গ্রামের বাসিন্দা ও শিক্ষক মুকুল কুমার বোস জানান, ‘আমার জন্মের পর থেকে মুরব্বিদের মুখে অনেক গল্প কাহিনী ও ইতিহাস শুনেছি। মন্দিরটিতে কোনোদিন পূজা হতে দেখিনি। তবে দেশের এই পুরোনো ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটি রক্ষায় সরকারের এগিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি।


বোয়ালমারী উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির সদস্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমির চারু বলেন, এলাকার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি এটি ধরে রাখতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


চন্দ্র কিশোর বহুমূখি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক অধীর চন্দ্র রায় বলেন, মন্দিরটি এশিয়া মহাদেশের ১৩টি ভেতর এটি একটি মন্দির। এখানে বহুবছরের পুরোনো একটি পারিজাত ফুলগাছ আছে। যা ঐশ্বরিক দান হিসেবে জেনে আসছি। মন্দিরটি তালাবদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে পড়ে আছে। তবে এলাকাবাসী অথবা কারও এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই।


ময়না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির মোহাম্মদ সেলিম বলেন, এই নিদর্শনটি আমাদের এলাকার ঐতিহ্য ও সম্পদ। এটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।’ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংরক্ষণের দাবী জানান তিনি।


স্থানীয়রা জানান, শশীমুখি দাতব্য চিকিৎসালয়টি স্বাধীনতার পরে সরকারের অধীনস্থ। তৎকালীন নামটি পরিবর্তনের পর খরসূতি-ময়না ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে নামকরণ করা হয়। পুরাতন ভবনটি এখন জরাজীর্ণ ও তালাবদ্ধ।


বর্তমান উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার ডা. মোঃ তরিকুল হাসান বলেন, এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমির পরিমান ৩ একর ৬৬ শতাংশ। যা দেশের মধ্যে এতো জায়গা নিয়ে কোন ইউনিয়ন উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই। বর্তমানে এখানেও আছে লোকবল শূন্যতা। এলাকাবাসীর আবেদনের পক্ষে তিনি ১০ সজ্জা বিশিষ্ট একটি হাসপাতালের দাবী জানান।


বোয়ালমারীর ময়না গ্রামের বাসিন্দা, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক সমর চক্রবর্তী (‘ভূষণা রাজ্যের ইতিহাস’ এর লেখক) জাগো নিউজকে বলেন, এটি আমাদের এলাকার একটি ইতিহাস ঐতিহ্য। এসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার দাবি জানান।


ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সাংসদ আব্দুর রউফ এর ছেলে, চন্দ্র কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য, আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ঈশান চন্দ্র ঘোষের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সরকারের কাছে সংরক্ষণের দাবি জানায়। এ ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও তিনি জানান।


এ প্রসঙ্গে,বোয়ালমারী ইউএনও রেজাউল করিম বলেন, সময় নিয়ে এলাকাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলেতাদের দাবি যুক্তিযুক্ত কি না তা যাচাই করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতামতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


বিবার্তা/এমবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com