“থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে,
দেখবো এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে…।’
কাজী নজরুল ইসলামের এ কবিতাটি আমার মনের সকল ভাব প্রকাশ করে দিয়েছে। বদ্ধ ঘরে একলা থাকতে আমার দুরন্ত মন কখনই চাইতো না। তাইতো সুযোগ খুঁজি কখন একটি ভ্রমণের দিনক্ষণ ঠিক হবে আর আমি এ জগৎ সংসার দেখতে বের হবো। মিশে যাবো এ প্রকৃতির মাঝে। আমি বরাবরই ভ্রমণ করা পছন্দ করি। তাই যখনই শুনলাম বিভাগ থেকে ট্যুরে বান্দরবান, কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন যাওয়া হবে তখনই আমি রাজি হয়ে গেলাম।
প্রকৃতির রুপ স্বচক্ষে দেখে যতটা তৃপ্তি পাওয়া যায়, অন্য কোন স্থির চিত্র বা ভিডিও দেখে সে ভালোলাগা অনুভব করা যায় না। এই প্রকৃতি কখনো গম্ভীর ভাব নেয় মেঘের কারণে, কখনো প্রাণবন্ত, আবার কখনো সে কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে প্রকৃতির ভিন্ন সৌন্দর্য জানান দেয়। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এর ভিন্ন বৈচিত্রতা। আমরা ভ্রমণে বের হয়েছি শীত চলে যায় এমন বিদায় ক্ষণে।
ভ্রমণ শুরু হয়েছিল রাত ১১টা। মনের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে সবার হৃদয়ে। আর সেই সাথে তাল মিলিয়ে গানে আর নাচে উৎসব মুখর ছিল আমাদের এ ভ্রমণ।
রাত্রের ভ্রমণ ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা আর ভালোলাগা উপহার দিয়েছে। পথের কোথাও আধার ছিল আবার কোথাও লাল, নীলসহ বিভিন্ন রংয়ের বাতি আমাদের ভিন্ন জগতে নিয়ে গেছে। কোথাও এত বড় লাইটিং ছিল যে মনে হচ্ছে সূর্য তার তেজ নিয়ে পূর্বাকাশে প্রভাতের কথা জানান দিচ্ছে।এরই মাঝে এ দীর্ঘ রজনীতে কেউ গল্প করছে প্রিয় জনের সাথে, কেউ আপন সুরে প্রিয় গান গাইছে আবার কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে বাসে। এভাবেই রাত কেটে যায়।
ভোর ৬টায় আমরা বান্দরবান গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে আমরা প্রাতঃরাশ শেষ করে প্রকৃতি দেখতে বেরিয়ে গেলাম। আমরা চান্দের গাড়ি দিয়ে আঁকা বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলাম। এ লগ্নে আমরা উপজাতিদের বাসস্থান আর তার কাজকর্ম দেখলাম। যা আমরা বই পড়ে তাদের সম্পর্কে জানতাম। এসময় আমরা সেলফি তুলতে ভুলিনি। বন্ধু-বান্ধবীর গল্প, গান আর গাড়ীর দ্রুত গিয়ারে আমরা চলে এলাম নীলগিরি। জায়গাটা বেশ সুন্দর। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে নীলগিরির উচ্চতা প্রায় ২ হাজার ২০০ ফুট। এর সৌন্দর্য চোখ ধাঁধানোর মত। এত উঁচু যে মনে হচ্ছে আমরা আকাশ ছুঁতে পারবো। মেঘ আমাদের নিচে ভাসছে। আমরা লাফ দিয়েই তা ছুঁতে পারবো! উঁচু নিচু পাহাড় শুধু মাটির স্তূপই নয়, নাম না জানা বিভিন্ন গাছপালা তার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা বড়ই, কলা, তেঁতুল ফল বিক্রি করে সুলভ মূল্যে। আমি একজন ফল বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা,এগুলোর (তেঁতুল) দাম কত? তিনি উত্তর দিলেন, “এতার দাম দশ তাকা”। আমরা সবাই সেসব খেলাম। নীলগিরি থেকে ফেরার পথে আমরা শৈল প্রপাত দেখতে গেলাম। পাথরের ভিতর থেকে একটু একটু পানি আসছে।হাত ছুতেই ঠাণ্ডা লাগলো। সেখানে কয়েকজনকে আমরা ঠাণ্ডা পানির পরশ পাওয়ার জন্য শৈল প্রপাত ভিজতে দেখলাম। অসংখ্য দর্শনার্থীর পদচারণে মুখরিত ছিল সেই শৈল প্রপাতের স্থান।
স্বর্ণমন্দির: স্বর্নমন্দিরে প্রতিটা মূর্তি ছিল সোনালী রংয়ের। প্রত্যেকে আমরা নগ্ন পায়ে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমাদের বন্ধুমহল আবারো ফটো তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠার পর দেখলাম অসংখ্য মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।তাদের গাত্র লাল পোশাকে ঢাকা ছিল। স্বর্ণমন্দির দেখার পর আমরা মেঘলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এখানটা এত উঁচু ছিল যেখান থেকে দূরের শহর দেখা যাচ্ছিল। একটি বড় বাড়ি আমাদের সবার দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করলো।কেননা বাড়ীটি এমন যায়গায় করা হয়েছে যার চতুর্দিকে শুধু পাহাড়, গাছপালা আর নিরবতা ছিল যার সঙ্গী! এখান থেকে সূর্যাস্তটা দেখতে দারুণ লেগেছে। ক্লান্ত আর শ্রান্ত দেহ নিয়ে আমরা হোটেলে চলে আসলাম। রাতটা সেখানে থেকে ভোরে কক্সবাজারের জন্য রওয়ানা হলাম।
কক্সবাজার: বান্দরবান থেকে সকালে প্রাতঃরাশ সেরে সবাই বাসে উঠলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। এ পথে আমরা অনেক বৈচিত্রতা অবলোকন করলাম। সকালের লাল সূর্য পূর্বাকাশকে রাঙ্গিয়ে দিয়েছে। এ পথের পাশেও ছিল ছোট বড় পাহাড়। নানান পেশাজীবী, মানুষ তাদের কর্ম ব্যস্ততায় মত্ত। কোথায়ও ছোট দোকানে এক সাথে বসে অনেকে চা আড্ডা দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ বাজারে আসছে। সদাই কিনছে। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। এ ব্যস্ত মানুষ আর ব্যস্ত রাস্তার সীমানা অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম কক্সবাজার। এখানে একটি বড় হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। সবাই নিজ নিজ রুমে গিয়ে সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার জন্য রেডি জয়ে আসলো। কেউ কেউ আবার ফুটবল নিয়ে বের হলো সমুদ্রের পানিতে খেলার জন্য। হোটেল থেকে এক রাস্তার মোড় পার হয়ে ডান দিকে মোড় ফিরে আমরা চলে এলাম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। সাগরের উত্তাল ঢেউ আর তার গর্জন দূর থেকেও শুনা যায়। নানান স্থানের ব্যক্তিবর্গ, পর্যটক, আর বিদেশীদের এখানে দেখা গেলো। দূর থেকে ঢেউ এসে কিভাবে তীরে কোলে বিলীন হয়ে যায় তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর! সবাই এই ঢেউয়ের সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে সমুদ্রের বুকে। কেউ সাতার কাটে। কেউ ছবি তোলার জন্য নানান অঙ্গভঙ্গি, আর পোজ দিতে থাকে। আমার এক বন্ধু একটি কালো চশমা দিয়ে ছবি তোলার জন্য একটু সমুদ্রের গভীরে গেলো। কিন্তু সাগরের ঢেউ এসে তার চোখ থেকে চশমাটা ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। যার আর হদিশ মিলিল না। আর চশমাটা বান্ধবীর ছিল। তার চশমা হারিয়ে সে বেদনাতুর হয়ে গেলো। এখানে ডি এস এল ক্যামেরা দিয়ে কয়েকজন ছবি তোলে দেয়। প্রতি ছবি তিন/ পাঁচ টাকা রাখতো। এখানে দুই তিন ঘণ্টা গোসল করলেও উঠতে ইচ্ছে করবে না।
সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখে আমার হৃদয় মন্দিরে গান বেজে উঠলো-
“সাগরের ঢেউ বলে তীর পেয়েছি,
আকাশের পাখি বলে নীড় পেয়েছি,
এই মন বলে আমি সুখী হয়েছি…”
প্রায় আড়াইটায় আমরা হোটেলে চলে আসলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নীল সবাই।
সন্ধ্যা সবাই আবার সমুদ্র দেখার জন্য বের হলো। রাতের সমুদ্র ও বেশ সুন্দর। দূর অন্ধকারে সমুদ্রের মাঝে লাল লাল বাতি দেখা গিয়েছিল। এগুলো ছিল বিপদ সংকেত। এর বাহিরে যাওয়া যাবে না। এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করার পর আমরা শপিং করার জন্য বের হলাম। সন্ধ্যায় আমরা বীচের পাশের দোকানগুলো ঘুরে দেখলাম। দোকানে শামুকের তৈরি বিভিন্ন পণ্য যেমন: গহনা, প্রবাল, ঝাড়, নাম খোদাই করে সাজিয়ে রাখার মত শামুক ছিল। বিভিন্ন ধরনের আচার ও ছিল এসব দোকান গুলোতে। কিছু কিছু দোকানে ছোট বড় সামুদ্রিক মাছের শুটকি ছিল এবং এসব শুটকি কেনার জন্য নানান পর্যটক আর ক্রেতাদের ভিড় ছিল।
সেন্টমার্টিন: নীল পানির মাঝে জেগে উঠা দ্বীপ সেন্টমার্টিন। সেথায় যাওয়ার জন্য আমরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। সকাল ৬টা আমাদের বাস যাত্রা শুরু করলো। আমাদের এবারের গন্তব্যস্থান টেকনাফ। সেখান থেকেই শীপে করে সেন্টমার্টিন যেতে হয়ে। লবণ চাষ একটি বৈচিত্রময় পেশা, এখানে আসলে এ লবণ চাষ দেখা যায়। সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে বেড়ী দিয়ে রেখে সেখান থেকে লবণ তৈরি করে। এসব দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম টেকনাফ। টেকনাফে আমরা রোহিঙ্গা দেখেছি।
মিয়ানমারের প্যাগোডার সোনালী স্তম্ভ দেখা গেলো নাফ নদীতে শীপে যখন আমরা অবস্থান করি। আর আমাদের বাংলাদেশে এ পাশে ছিল বড় বড় পাহাড়। আবার এ পাহাড়ের পাশেই আবার কালো রাস্তা ছিল। এ রাস্তায় যখন গাড়ি মালামাল নিয়ে যাচ্ছিল তখন জাহাজ থেকে মনে হলো পাঁচ ইঞ্চি সাইজের কোন খেলনা গাড়ি ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও গাড়িগুলোর গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ৪০ কিঃমিঃ। আমাদের শীপের চারপাশে গাংচিল উড়ছিল। যেগুলো পুরো যাত্রায় আমাদের সাথে ছিল। কোন চিপস ছুড়ে খেতে দিলে তারা খেয়ে ফেলতো উড়ন্ত অবস্থায় পানিতে পড়ার আগেই। প্রায় তিন ঘণ্টা অতিক্রম করার পর আমরা সুন্দর দ্বীপ সেন্টমার্টিনে চলে আসলাম। সেন্টমার্টিন যখন সূর্যোদয় দেখবে তখন মনে হবে পানির নিচ থেকে যেন সূর্য উঠছে। আর এখানে প্রতিটা ঢেউ এ নানান রঙ বেরংয়ের শামুক, পাথর ভেসে আসে। এখানকার প্রবাল ছিল এই দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ। এই সেন্টমার্টিনে দেখার মত ছিল হুমায়ুন আহমেদের “সমুদ্র বিলাস”, কেয়া ফল, বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ, অক্টোপাস।সূর্যাস্তের দৃশ্য এ মনোজগতে বিস্ময় জাগায়। অবশেষে আমরা পাঁচদিন ভ্রমণের শেষে ক্যাম্পাসে ফিয়ে আসলাম।
লেখিকা
শিমন আরা আক্তার
ষষ্ঠ সেমিস্টার, তৃতীয় বর্ষ
লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/রাসেল/জহির
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]