শিরোনাম
‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমার বাবার অবদান কিছুতেই কম নয়’
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২০, ১৯:১২
‘স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমার বাবার অবদান কিছুতেই কম নয়’
অনামিকা রায়
প্রিন্ট অ-অ+

নামের অর্থ তার দেবরাজ ইন্দ্র! ইন্দ্রের মতো স্বর্গরাজ্য তাঁর ছিলো না বটে; তবে ক্ষমতা ছিলো যেকোনো স্থানকে স্বর্গ করে তোলার। কোনো স্থানে তাঁর পা পড়ার অর্থই ছিলো সকল সমস্যার নিরসন। তিনি আমার বাবা! জীবনের গল্পে যিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের ভরসার নাম, নির্ভরতার নাম আর এক সুদ্ধ ভালোবাসার নাম। কর্মক্ষেত্রে ছিলেন জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠা এক সাহসী সৈনিক!


মধুমতি পাড়ের জল-কাঁদা মাখা মাটিতে রয়েছে তাঁর শৈশব, কৈশোর আর দুর্দান্ত যুবক হয়ে ওঠার গল্প। তারপর একদিন ডাক আসল পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেবার। শুরু করলেন নতুন জীবন। সেখানেও বিপত্তি! বাদ সাধলো দেশের ভাগ্য! ডাক আসল দেশকে নতুন নাম দেবার, নতুন পতাকা দেবার। তিনি সে ডাককেও উপেক্ষা করেননি, বুক উচিয়ে থানার অস্ত্রসহ পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন সহকর্মীদের সঙ্গে। আর তাই তো আমরা ভাইবোনেরা গর্ব নিয়ে ভাবতে পারি এই স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য আমার বাবার অবদানও নেহাত কম নয় কিছুতেই!


সালটা ১৯৭১। আমার মা তখন গর্ভবতী। প্রথম প্রানের স্পন্দন তাঁর শরীরের মধ্যে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। এর মধেই খবর এলো তাঁর স্বামী নিখোঁজ। কারো কাছে আর কোনো খবর নেই। দেশের অবস্থা ভয়াবহ! আমার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন! ওই অবস্থাতেই জন্ম দিলেন ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের যার মুখ আমার বাবা দেখতে পাননি কখনো!


কার্তিকের জোছনায় ভেসে যাচ্ছিল সে রাত্রি। মাঝ রাত-টাত হবে হয়তো। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ সাথে মমতা মমতা বলে অবিরত ডাক (মমতা আমার মাসিমনি, গল্পটা তার থেকেই শোনা)! ওমন অস্থির সময়ে অতরাতে ওই শব্দ কেমন ভয়ের আভাস দিয়েছিলো সকলের মনে। দাদু দরজা খুলেই চমকে উঠলেন-এক মাথা চুল, লম্বা দাঁড়ি, ছেঁড়া -ফোঁটা গেঞ্জি গায়ে একলোক ক্রমাগত মমতা মমতা বলে ডেকে যাচ্ছে। ওমন অর্ধ উন্মাদের মতো লোকটা ছিলেন আমার বাবা যাকে মৃত বলেই ভেবে নিয়েছিলেন সকলে এতদিন! এটা বাবাকে নিয়ে শোনা আমার সবচেয়ে প্রিয় জীবন্ত গল্প! আমি যেন চোখ বুঝলেই গল্পটা দেখতে পাই!


প্রথম সন্তান হারিয়েই বোধ হয় তিনি সকলের পিতৃসম হয়ে ওঠতে পেরেছিলেন। তাঁর যত ভাই-বোনদের আমি দেখেছি সকলেই বাবাকে তাদের বাবার মতো মনে করে, শ্রদ্ধা করে। বাবা তো আক্ষরিক অর্থে তাদের বাবাই ছিলেন।সকলের সব দায়িত্ব নিজে পালন করেছেন। কেউ কোনো সমস্যায় পড়লেই বাবার দারস্থ হতেন। কারো কোনো আবদার, নালিশ সবই বাবাকেই মেটাতে হতো। জমিতে সেচ দেওয়ার সময় যেমন জমির আইল উঁচু করে দেওয়া হয় জল যাতে বাইরে না যায়, আমার বাবা ছিলেন সকল আত্মীয়, বন্ধু স্বজনদের কাছে ওই উঁচু আইলের মতো যাঁকে ছাপিয়ে যাওয়ার অবাধ্যতা কারো নেই!


শৈশবের স্মৃতিতে তাঁর সুখকথা ছিলো বলে আমি শুনিনি! জন্মের অল্প কিছুদিন পর মাকে হারানো দিয়ে তাঁর জীবনে হারানোর অধ্যায় শুরু! তারপর বসতবাড়ি থেকে শুরু করে হারিয়েছে বাবা, ভাই, ছেলে, মেয়ে! যখন জীবন খাতায় পাওয়ার হিসেব খোলা শুরু হলো তখনই বাদ সাধলো ভাগ্য! মরণব্যাধি ক্যানসার তাঁর অপূর্ণ জীবনকেই নিয়ে গেল ইন্দ্র ভুবনে!


আমি আমার বাবাকে কাছে পেয়েছি খুব অল্প সময়ের জন্য। চাকরির সুবাদে বাবা থাকতেন বাইরে আর আমরা মায়ের সাথে গ্রামের বাড়িতে। আমার দাদারা বাবাকে কাছে পেয়েছেন অনেকটা তার তুলনায় আমি নিতান্তই অল্প! তাইতো আমার স্মৃতির ঝুলিতে বাবার স্মৃতি যতটুকু আছে তার সবটাই সুখের মতন। বিষাদ যা আছে তা তাঁকে হারানোর।


পুজোর ছুটিতে বাবার যেদিন বাড়ি আসার কথা থাকতো আমি আর অপু রাত জেগে বসে থাকতাম। সন্ধ্যে হয়ে রাত, তারপর আরো রাত, রাত কেবল বেড়েই চলতো কিন্তু বাবার দেখা নেই! ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে যেতাম আমরা। সকালবেলা যখন ঘুম ভেঙ্গে চোখ খুলতাম দেখতাম বাবা আমার পাশে শুয়ে! সে যে আমার অপেক্ষার রঙিন দিনগুলি!


একবার মেজদা পুজোয় ইন্ডিয়া থেকে একগাদা জামা নিয়ে এসেছিলো কিন্তু আমার মহম্মদপুরের জামা চাই। মহম্মদপুরের জামা না আসা পর্যন্ত সারাদিন কেঁদেছিলাম আর আমার বাবা সারাদিন আমায় কোলে নিয়ে বসেছিলো পুজো মণ্ডপে। একবার আমার অনেক বড় এক্সিডেন্ট হলো! পায়ে ১৮/২০টা সেলাই, আমি একা বসতেও পারি না। আমার বাবা আমায় কোলে করে এঘর ওঘর করে বেড়াতো।


সেদিন আমার জীবনে বিশেষ ভয়ংকর একদিন। সেদিন আমার জীবনে প্রথম ট্রেন দেখার দিন! জীবনের প্রথম কাছ থেকে ট্রেন দেখে আমার কেবল কান্নাই পাচ্ছিল খুব করে। বাবা, তোমাকে বাড়িতে যেয়ে শেষবার দেখব এটা ভেবেই হয়তো। বাবা তুমি বুঝতে পেরেছিলে আমার কেমন অসহায় লাগছিলো তোমাকে সবাই যখন বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। তুমি আর মা এখনো কি বুঝতে পারো হঠাৎ হঠাৎ আমার পৃথিবী কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। আমার কেবল তোমাদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে, দেখতে ইচ্ছে করে। ফিরে আসো না তোমরা প্লিজ বাবা!


বিবার্তা/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com