শিরোনাম
পোর্টাল ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ ও একজন ‘সুপ্রীতি ধর’!
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০১৭, ২৩:০৩
পোর্টাল ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ ও একজন ‘সুপ্রীতি ধর’!
নূসরাত আফরিন
প্রিন্ট অ-অ+

আমাদের ‘সহনশীলতার মানদণ্ড’ নিয়ে আমি আমার একাধিক লেখায় সংশয় প্রকাশ করে আসছি দীর্ঘদিন ধরেই! ইতোমধ্যে পাঠক হয়তো ভাবছেন, আমার কোন লেখার মধ্যাংশ অথবা শেষাংশ থেকে পড়ছেন কি-না!


প্রথম লাইন পড়েই হয়তো অনেকে অস্থিরতায় ভোগা শুরু করেছেন অথবা লেখাটির তীর্যক সমালোচনার জন্য মানসিকভাবে আটঘাট বেঁধে তৈরি হচ্ছেন! তবে তার আগে আসুন লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।


‘সুপ্রীতি ধর’ পরিচিত একটি নাম; নানান কারনে তিনি সবসময় বিতর্ক সৃষ্টি করে আসছেন । অতীতে কখনো সাম্প্রদায়িক ইস্যু, কখনো রাজনৈতিক এবং নারীবাদ নিয়ে তারা লেখা সবসময়ই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে এবং ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ নামে একটি অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক তিনি, যা বিভিন্নভাবে আলোচিত ও সমালোচিত! এবারে গত দুইদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়াকে উত্তপ্ত করে রাখা সুপ্রীতি ধরের লেখক পরিচয় নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকুক আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য!


সুপ্রীতি ধরের সাথে আমার ব্যক্তিগত যে অভিজ্ঞতা, তা খুব একটা সুখকর নয়। আমি তাঁর দাম্ভিকতা, প্রতিহিংসাপরায়নতা এবং উন্মাদ আচরণের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে, যখন তিনি আমাকে কোনো এক বিষয়ে বিতর্কের মাঝামাঝি পর্যায়ে ফেসবুক থেকে ‘অবান্ধব’ বিবেচনায় ‘ব্লক’ করেছিলেন!


যারা ফেইসবুকে অভ্যন্ত, তাঁরা নিশ্চয়ই ‘আনফ্রেন্ড’ ও ‘ব্লক’ শব্দদু’টির সাথে পরিচিতি। যাইহোক, বিতর্কের এক পর্যায়ে তিনি আমাকে ‘জ্ঞানহীন’ বলে উপহাস করেছিলেন। অথচ আজ তাঁর যে লেখা নিয়ে এই সামাজিক মাধ্যমেই হইচই, বাদ-প্রতিবাদের উত্তাল দেখছি, পূর্বাভিজ্ঞতার কারণে আমার তা পড়ে দেখার আগ্রহ হয়নি। না পড়ার কারণ তাঁর সাথে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য নয়। সব সময় সব কিছু যে পড়তে হবে বা আমি পড়ি, তা নয়! আবার কোনো কোনো লেখা আমি কুড়িবারও পড়ি, শেখার জন্য বা জানার ব্যাকুলতা থেকে! আমি কখনই বিশ্বাস করি না যে, পৃথিবীর সবাই লেখকের মতের সাথে একমত হবেন বা একজন লেখক তাঁর পাঠকদের মনতুষ্টিতে নিজের ভাবনার পরিবর্তন আনবেন।


যে কোনো লেখকের লেখার কোনো বিষয়ে যদি পাঠক বা সমাজের আপত্তি থাকে, সেবিষয়ে কথা বলা বা আলোচনা করা যেতেই পারে। সে আলোচনায় শব্দচয়ন অত্যন্ত মার্জিত ও গঠনমূলক হতে হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমস্যা হচ্ছে, আমরা আমাদের চিন্তা এবং মতের বাইরের কোনো মতবাদ বা ভাবনাকে সহজ মানষে গ্রহণ করতে পারি না। ফলে তখন ব্যক্তি বা সমাজে দেখা দেয় একধরনের অস্থিরতা। যা স্পস্টতই দৃষ্টিগোচর হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা প্রতিহিংসাপরায়ণতায়ও রূপ নেয়।


আমাদের ভেতরের ঘুমন্ত ‘কুপ্রবৃত্তিগুলো’ জেগে ওঠে মুহূর্তেই, সাপের মত ফনা তুলে আছড়ে পড়ে, ক্ষতবিক্ষত করে ভাবনার প্রতিপক্ষকে! আধুনিক প্রযুক্তির যুগে কি-বোর্ডের ক্লিক-ক্লিক শব্দে চারপাশটা লেপ্টে যায় অশুভতা- ও অসুন্দরতায়! সবকিছুকে কেন নিজের বলেই ধরে নিই সবসময়! কেন ভিন্ন ভাবনাকে স্বাগত জানাতে পারি না! সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেখেছি, ভিন্ন ভাবনাকে স্বাগত জানানো তো দূরের কথা, সবার আচরণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেন শব্দবাণেই অন্যকে ক্ষতবিক্ষত করছে।


ফেসবুকে কোনো লেখার নিচে মন্তব্যগুলোতে চোখ রাখাই দায়, শুধুমাত্র শব্দদূষণের অসভ্যতার কারণে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আমরা আসলে কোথায় আছি? ফেইবুকে এসব মানুষগুলোর প্রোফাইল ঘেটে দেখলে আরো হতাশা হতে হয়। এরা তো ভিন্ন কেউ নয়; যাদের সাথে চলতে ফিরতে দেখা হয় প্রতিনিয়ত। আমাদের সমাজেরই সবচেয়ে ভালো মানুষটি অথবা ভদ্রলোকের তকমা পাওয়া মানুষটিরই প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে!


একটা বিষয় খেয়াল করেছি যে, কোনো লেখক যদি নারী হন, তাহলে যেন ষোলকলা পূর্ণ সেক্ষেত্রে। অনলাইনে তাঁর চরিত্রহনন থেকে শুরু করে ভ্যার্চুয়াল ধর্ষণ যেন নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার! দেখতে বিষয়টা যেন অনেকটা ছেলেবেলার দুধ-ভাত খেলার মত হয়ে গেছে! যা হচ্ছে তার আসলে প্রতিকার কী। এর শেষ কোথায় বা আমরা কোথায় গিয়ে থামবো!


‘উইমেন চ্যাপ্টার’ নামের উল্লিখিত অনলাইন পোর্টালটি আমি দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি। এখানে নারীবাদ চর্চার নামে যা কিছু লেখা হয়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোকে পরিশীলিত লেখা না বলে বরং সুনির্দিষ্ট একটা বিষয়ের বিরুদ্ধে ‘হেইট স্পিচ’ বা হিংসাত্মকমূলক বিষবাষ্প ছড়ানোর সাথে তুলনা করলেই যথার্থ হবে।


নারীবাদ মূলত নারীর অধিকার বিষয়ে এবং তার বিরুদ্ধে অমানবিকতা ও বঞ্চনার যৌক্তিকভাবে সোচ্চার হতে শেখায়। কিন্তু উইমেন চ্যাপ্টারের কনটেন্টগুলো দেখলে কারো বুঝতে অসুবিধা হবেনা যে, সেগুলোর উপস্থাপনার কৌশলগত ও ভাষাগত কুরুচিপূর্ণতা আমাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আবহের সঙ্গে সংমিশ্রনতো হয়ই না, বরং সমাজে ও পরিবারে তা একধরনের নেতিবাচক-অসভ্য সংস্কৃতির জন্ম দেয়।


লেখক যদিও আমার কথার যৌক্তিকতা অগ্রাহ্য করতে পারেন। তাহলে আমি প্রশ্ন করতেই পারি, পোর্টালটির গ্রহণযোগ্যতা সর্বময় নয় কেন এবং শুধুমাত্র এক শ্রেণীর চিহ্নিত নারীরাই সেই পোর্টালের একক ধারক ও বাহক কেন?


আমি নিজে একজন নারী। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন থেকেও আমি উইমেন চেপ্টারকে ধারণ করতে পারি না। বেগম রোকেয়াকে নারী সমাজের অগ্রদূত বলা হয়। তিনি সামাজিক প্রেক্ষাপটগুলোকে পুংখানূপুঙ্খরূপে অনুধাবন করেই নারীসমাজকে উত্তরণের পথ বাৎলে দিয়েছিলেন। তাদের মত বিদূষীদের দেখানো পথ ধরেই নারীকূল আলোর রেখা দেখেছিল বাংলার এই পূর্বকোণে। তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে পাওয়া নীতি এবং তাঁর মার্জিত ও সংস্কৃতির যে সুসংহতীকরণ আমরা দেখতে পাই, তা-ই হওয়া উচিত আমাদের অণুকরণীয় এবং অনুসরণীয়।


কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ না করে, সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কি সুন্দরভাবেই না তিনি তাঁর কাজের ইতি টেনে গেছেন। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর মত জাঁদরেল এবং বিজ্ঞ নেতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু বাঙালির অবিসংবিদিত নেতা হতে পেরেছিলেন শুধু একটি কারণেই, ‘তিনি তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিভাবে রাষ্ট্রের অবকাঠামোকে ভেঙ্গে নতুনভাবে সজ্জিত করতে হবে সেটা জানতেন’। তিনি বুঝতেন বাঙালির মনের ভাষা।


নেতিবাচক সিস্টেম বা নিয়মের পরিধি সম্বন্ধে আমরা সচরাচরই বলে থাকি। কিন্তু সেটা ভেঙ্গে নতুন করে কিভাবে গড়তে হবে, তা বলি না! আকাশ-কুসুম আর অলীক চিন্তাধারা থেকে উদ্ভুত যে কর্মকাণ্ড, তাই অসুন্দর ও অসভ্যতায় ভরা বলে আমি মনে করি। উইমেন চ্যাপ্টারের অনেক ভাবধারাই আমাদের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অপসংস্কৃতির সমান্তরাল রেখায় প্রবাহমান বলেই আমি বিশ্বাস করি। সে চ্যাপ্টারের লেখা থেকে কোনো নারী যদি প্রভাবিত হয়ে বিপ্লবী হন, তাহলে তিনি অবধারিতভাবে হয়তো ‘সিস্টেম ব্রেক’ করবেন। কিন্তু তার পরবর্তী পরিস্থিতিতেতিনি নিজেকে সামলে নিতে পারছেন কি-না বা উদ্ভুত নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে সামষ্টিক বাঙালি নারীজাতিকে প্রবাহিত করাতে পারছেন কি-না, তা দেখাই বিবেচ্য।


সাবলীল ভাষায় সবচেয়ে বেশি সমুচিত জবাব দিয়ে প্রতিউত্তর করা যায়। আমাদের উচিত সেভাবেই ভাবতে শেখা। শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা মানুষকে বিনয়ী করে। ধৈর্যশীলতা মানুষকে উন্নত করে। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক, সামাজিক সচেতন হিসেবে এটাই আমার চাওয়া!


বিবার্তা/নূসরাত/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com