শিরোনাম
৬ দফা: সমাজ-প্রগতির অনন্য দলিল
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০১৭, ১১:০৯
৬ দফা: সমাজ-প্রগতির অনন্য দলিল
হুসাইন সাদ্দাম
প্রিন্ট অ-অ+

বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষায় ৬ দফা ‘স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার সাঁকো’। সম্ভবত ৬ দফা নিয়ে এটি সবচেয়ে বাস্তবানুগ বিশ্লেষণ। জনগণের উদ্দেশ্যে এর প্রচারের সময় শেখ মুজিব এর নাম দেন ‘আমাদের বাঁচার অধিকার’। পাকিস্তানের ক্ষমতা-কাঠামোর নিয়ন্ত্রক সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজি শোষণ করে অর্থবিত্তের মালিকদের জন্য এটি ছিল কফিনের শেষ পেরেক। পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ ৬ দফার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের বাসনাকে ‘দাবি’তে রুপান্তরিত করে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও নেতৃত্বের কর্মকৌশল নির্ধারণে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে একটি ‘রাজনৈতিক জনসমাজ’ সৃষ্টি করা, যারা স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে আপসহীন থাকবে, ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুঁজি শোষণ ও সম্পদ পাচার প্রতিরোধে সক্রিয়তা দেখাবে এবং এ জনপদের ভাগ্য নির্ধারণে নিজেরাই নিয়ন্তা হয়ে উঠবে।



৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তবতা বাঙালি জনগণকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এবং সার্বভৌমত্বের ভুয়ো দর্শনের অসারতা যখন উন্মোচিত করে এবং তাসখন্দ চুক্তির পরে জাতীয়ভাবে আইয়ুব যখন কিছুটা কোণঠাসা সে সময় বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কনভেনশনে সাবজেক্ট কমিটির বৈঠকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান ৬ দফা আলোচনার জন্য উত্থাপন করেন এবং পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতায় তা অগ্রাহ্য হয়। ৬ দফার দাবিগুলো প্রকারান্তরে নতুন কিছু ছিল না, বরং এটি ছিল ৪০এর লাহোর প্রস্তাব, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, গণপরিষদে আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমানের বক্তৃতা-বিবৃতি, দুই অর্থনীতি তত্ত্বের আলোকে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ, ৫৭তে আওয়ামী লীগে ভাঙনের সময়ে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাব, ৬৪তে আওয়ামী লীগের দলীয় ১১ দফা; এসবের সম্মিলিত স্বতঃসিদ্ধ বহিঃপ্রকাশ। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যূর পরে পূর্বের ‘কেন্দ্রের গণতান্ত্রয়ণের’ মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের অধিকার রক্ষার কৌশল থেকে সরে এসে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে তীব্র করার কৌশল গ্রহণ করেন শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগ এ রণকৌশলের অংশ হিসেবে তৃণমূলে স্বায়ত্তশাসনের দাবিগুলোকে জনদাবিতে রূপায়ণ করে এবং জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার স্তর একটা বিপ্লবী কাঠামোতে পৌঁছে দেয়। ৬ দফা ছিল লোহা গনগনে থাকতে থাকতেই আঘাত করার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।


ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৬ দফার কর্মসূচি অনুমোদনের পর বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন সহ অন্যদের টীকা-ব্যাখ্যা সংবলিত পুস্তক, এবং পরে বঙ্গবন্ধুর ‘আমাদের বাঁচার অধিকার’ শীর্ষক লেখা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়। এর সরাসরি ফলাফল হল ১৮-১৯-২০ মার্চে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে এর গঠনতান্ত্রিক অনুমোদন এবং শেখ মুজিব-তাজউদ্দীনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়া; আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে স্বায়ত্তশাসনের দর্শন ও লক্ষ্য এবং ৬ দফার বিরোধিতাকারী অংশের কোণঠাসা হয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধু এ কর্মসূচির জনভিত্তি নিয়ে নিঃসংশয় ছিলেন এবং তিনি জানতেন স্বাধিকার আন্দোলনকে আরো অগ্রবর্তী করে বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটি বিকল্পহীন রণকৌশল। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ‘আঞ্চলিক শোষণের’ প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে শোষণ নিরসনের কৌশল খুঁজতেন, যা স্পষ্টতই ছিল রাজনৈতিক ভ্রান্তি। ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ছিল আরেক কাঠি সরেস; জাতীয় সংহতি আর ইসলাম নিয়ে বিপজ্জনক খেলা তাদের সহ্য হত না!


প্রসঙ্গত, লাহোরে ৬ দফা উপস্থাপনের পূর্ব মুহূর্তে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি তার এক বর্ধিত সভায় অনুরুপ দাবি-দাওয়া সংবলিত এক প্রস্তাব পাস করে। ঐ সভায় ‘পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মৃদু দরকষাকষির মাধ্যমে নয় বরং দৃঢ় প্রতিরোধের মাধ্যমেই যে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার উপায় খুঁজে নিতে হবে- এ সভায় তাও প্রকাশিত হয়। সামগ্রিকভাবে জনগণের সচেতন অংশের সক্রিয়তায় শহর-গ্রামের দূরত্ব অতিক্রম করে সাধারণ্যে এ জনমত প্রোথিত হয় যে, ঔপনিবেশিক শোষণ চালু রেখে জাতীয় ঐক্য গঠন সম্ভব নয়। ছাত্রসমাজের আরেকটি অংশ একে ‘সীমিত কর্মসূচি’ বলে সমালোচনা করে।


তবে এ অংশটি ১১ দফা এবং ছয় দফার ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস নেয়। আরেকটি অংশ, ৬ দফাকে সিআইএর দলিল বলে অভিহিত করে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মসূচির দিকে অগ্রসর হয়। সমাজতন্ত্রের নামাবলী গায়ে দিয়ে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছার বিপ্রতীপে এদের কর্মকৌশলের মুখোশ উন্মোচিত হয় যখন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়েও জনযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ নাম দেয়ার মধ্য দিয়ে!



৬ দফার প্রাণ হল এর স্বশাসনবোধ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন, জনগণের সার্বভৌমত্ব, সার্বজনীন ভোটাধিকার, সম্পদের উপর সর্বজনের মালিকানা, যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে গণমানুষের নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার। এর প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরোয়নি। না ফুরোনোর কারণ মানুষের মুক্তির আন্দোলনের জন্য ৬ দফার মধ্যে যে সারবত্তা রয়েছে তার চিরকালীন তাৎপর্য। নিজস্ব ভৌগোলিক গণ্ডি, জাতিগত পরিচয়, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, আদর্শ-বিশ্বাস-স্বপ্নের সম্মিলিত বোধ অনুযায়ী প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠী আর জনপদের স্বশাসনের অধিকার রয়েছে, জাতিগত-দেশগত ভাগ্য নির্ধারণের জন্মগত অধিকার রয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের এ আন্দোলন তাই ‘মানুষ’কে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় স্বাধীন সত্তা দেয়ারই আন্দোলন। বাংলাদেশের জন্য আরো সুন্দর বিষয় হল মানুষের মানবিক মর্যাদা, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ৬ দফা ক্রমান্বয়ে আমাদের ভৌগলিক স্বাধীনতা, জনগণের সার্বভৌমত্ব, নিজেদের মানচিত্র এবং আত্বপরিচয়ের পতাকাও দিয়েছে।


৬৬র ৬ দফা আন্দোলন ক্রমবিকাশের সাথে সাথে শুধু একটি দলের ‘রাজনৈতিক দলিল’ পরিচয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; আক্ষরিক অর্থেই এটি পরিণত হয় ‘আমাদের বাঁচার দাবি’তে। জনগণ ক্ষমতাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ‘সোনার বাংলা শ্নশান কেন?’; এ আন্দোলনের ঢেউ মিলিটারি-ব্যুরোক্রেটিক-ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট এস্টাবলিশমেন্টের দেয়ালে ধ্বনি তোলে ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’; সে ‘ক্ষমতার’, সে ‘দেয়ালের’ সাধ্য ছিল না নিজে ধংস না হয়ে তার ন্যূনতম জবাব দেবে। মানুষ শোষণের দানবদের জানিয়ে দিয়েছিল, এ কূল ভেঙ্গে ওকূল গড়ার খেলা বন্ধ করতে হবে, নয়তো ‘সংগ্রাম’ নিজস্ব গতিতেই ঠিক করে নেবে কি করে ‘মুক্তি’ আদায় করে নিতে হয়।


আওয়ামী লীগ শহর-গ্রাম নির্বিশেষে জনগণের সকল স্তর কৃষক-শ্রমিক-মধ্যবিত্তের কাছে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার, আত্ববিকাশের আন্দোলনে রুপান্তর করে। দোলায়মানতাকে অতিক্রম করে পূর্ব বাংলার মানুষ অধিকার আদায়ে এবার ‘সর্বস্ব পণ’ করতে শেখে। তাদেরই লড়াই-সংগ্রামের আপনজন শেখ মুজিব তাদের জানান দিয়ে যান যে নির্যাতনের কষাঘাতই সাফল্যের স্বর্ণদ্বার। জেলের মধ্যেই তিনি জীবন অতিক্রম করে চলেছিলেন প্রায়, Emesion যেটাকে বলেছেন ‘Jail Graduation’, বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘নাবালকত্ব ঘুচে যাওয়া’; এবার উচ্চারণ করেন বুলেটের আঘাত পরখ করার প্রস্তুতির কথা।


রাষ্ট্র বুলেট চালিয়েছে; জনতা পিছু হটেনি। রঞ্জিত রাজপথ স্মরণ রেখে দৈনিক সংবাদ ৮ জুন পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রাখে, তার পরের দিন যেন ভাষা দেয় মানুষের রক্তের কালিতে মানুষের সংগ্রামের লেখাকেই, ‘যে মর্মান্তিক বেদনাকে ভাষা দেয়া যায় না, সেখানে নীরবতাই একমাত্র ভাষা। তাই গতকল্য ‘সংবাদ’ প্রকাশিত হয়নি।’ ইতিহাস নীরব থাকেনি, ইতিহাসকে স্তব্ধ করা যায় না। ৬৬র গর্ভে তাই জন্ম নিয়েছে ৬৯র গণঅভ্যুত্থানের সন্তান; আঁতুরঘরের অপাপবিদ্ধ শিশুর মত নয়, রণচণ্ডী-বিদ্রোহী-বেপরোয়া যৌবনের আগুনের মত। ফাঁসির জন্য অপেক্ষমাণ থাকা শেখ মুজিবকে জনতার উন্মত্ত মিছিল আওয়াজ শুনিয়েছে, ফরাসি বিপ্লবের মত জেলের তালা ভেঙ্গে শেখ মুজিবকে নিয়ে আসার হুংকার দিয়েছে।


১২১৫ সালে কিং জন ম্যাগনা কার্টা সাক্ষর করেন অভিজাত ব্যারনদের সাথে। রাজার শাসনের ধারণা প্রথমবারের মত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এবং সীমিত অর্থে হলেও রাজাকে আইনের শাসনের অংশে পরিণত করে। মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা, সম্পত্তির উপর অধিকার এক ধরনের যাত্রা শুরু করে, যা উত্থান-পতনের মধ্যে এখনো গতিময় আছে। যুক্তরাজ্যের পিপলস চার্টার, যুক্তরাষ্ট্রের বিল অফ রাইটস, জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের মতই ৬ দফা মানুষের ইতিহাসের জন্য, ভবিষ্যতের সংগ্রামের প্রাসঙ্গিকতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ৭৫০ বছর আগের রাজার সাথে ২৫ জন্ ব্যারনের চুক্তি ৬৬তে এসে গণবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সীমা পেরিয়ে সার্বজনীনতা অর্জন করে এমন একটি দলিলে পরিণত হয় যা ছিল সকল জনগণের কাছে পবিত্র আমানত।


এর অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য এর চিরকালীনতা; যার জন্য স্বায়ত্তশাসনের ধারণা কে অতিক্রম করে এটি স্বাধীনতায় পর্যবসিত হয় এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপকাঠামো নিয়েও তার বলিষ্ঠ বক্তব্য অব্যাহত রাখে। পুজির পাচার প্রতিরোধে, স্থানীয় শাসনের কার্যকরতায়, জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদীয় সরকার কাঠামোর নির্মাণে; সর্বোপরী মানুষের আত্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার যার অর্থ নিজস্ব পছন্দ বা সার্বভৌম ইচ্ছা অনুযায়ী আপন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো গঠনের অধিকার মানুষের রয়েছে এবং এ অধিকার ন্যুনতম অর্থেও হস্তান্তরযোগ্য নয়। মানুষ ইতিহাসের অনিবার্যতায়, সংগ্রামের পরিণতিতে সে অধিকার অর্জন করে নেবেই নেবেই; এও ইতিহাসের অমোঘ সত্য।


আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘এমন এক দিন নিশ্চয়ই আসবে যে দিন মানুষ অপ্রতিরোধ্য গণজোয়ারের মাধ্যমে তার মৌলিক মানবাধিকারগুলি ছিনিয়ে নেবে।’ ইতিহাস নির্ধারণ করেছিল কার বিজয় সুনিশ্চিত হবে।


লেখক: আইন বিষয়ক উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com