শিরোনাম
প্রগ্রামিংয়ের আনন্দ : স্কুলের ছেলে-মেয়েরা
প্রকাশ : ০৭ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:০৩
প্রগ্রামিংয়ের আনন্দ : স্কুলের ছেলে-মেয়েরা
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রিন্ট অ-অ+

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মাস্টার্সে পড়ি। আমাদের স্যাররা একদিন ঠিক করলেন আমাদের কম্পিউটার শিখতে হবে। শুনে আমরা খুবই উত্তেজিত, কম্পিউটারের নাম শুনেছি, কখনো দেখিনি, সত্যি কথা বলতে কি জিনিসটা দেখতে কেমন, সেটা নিয়ে কোনো ধারণাও নেই। মাঝেমধ্যে কাউকে কাউকে দেখেছি বিশাল কম্পিউটার ‘প্রগ্রাম’ ঘাড়ে করে নিয়ে যাচ্ছেন।

 

শুনে যারা অবাক হচ্ছে তাদেরকে বলছি, তখন কম্পিউটার প্রগ্রামিং করার জন্য সেটা কার্ডে পাঞ্চ করতে হতো, প্রগ্রামটা কম্পিউটারে চালাতে হলে সেই কার্ডগুলো নিয়ে যেতে হতো। যার প্রগ্রাম যত বড় তার কার্ডের বান্ডেল তত বিশাল! সেগুলো আসলেই ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে হতো।

 

যাই হোক, আমাদের ক্লাসের ১০ জনকে একদিন স্ট্যাটিস্টিক্যাল ব্যুরো কিংবা এ ধরনের কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে একজন কম্পিউটারের ওপর একটা লেকচার দিলেন, তারপর এক বান্ডেল কম্পিউটার কার্ড কোথায় জানি ঠেসে দিলেন, কার্ডগুলো ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে কোথায় জানি অদৃশ্য হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পর তিনি জানালেন, প্রগ্রামটা সাফল্যের সঙ্গে ‘রান’ করেছে।

 

কী ঘটেছে, কী হয়েছে আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমি উঁকিঝুঁকি মেরে ঘরের ভেতরে কম্পিউটার নামক বস্তুটা দেখার চেষ্টা করলাম। বিশাল ঘরের বাইরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভেতরে কী আছে জানি না। তাই কম্পিউটার নামক বস্তুটা আর নিজের চোখে দেখা হলো না, তাতে অবশ্য আমাদের কোনো ক্ষতি হলো না। কম্পিউটারের ওপর জ্ঞান অর্জন করে খুবই গম্ভীরভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ছাত্রছাত্রীরা হিংসাতুর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল!

 

এর কিছুদিন পর আমি পিএইচডি করার জন্য আমেরিকা চলে এসেছি। যে নিউক্লিয়ার ফিজিকস ল্যাবরেটরিতে কাজ করি, সেখানে প্রথমবার সত্যিকারের কম্পিউটার দেখতে পেলাম। দেয়াল ঘিরে এক মানুষ সমান উঁচু ঘরের একমাথা থেকে অন্য মাথাজুড়ে বিশাল কম্পিউটার! সেখানেও কার্ড পাঞ্চ করে প্রগ্রামিং করতে হয়, আমিও প্রগ্রামিং শুরু করেছি, দেখতে দেখতে আমারও বিশাল বিশাল কার্ডের বান্ডেল জমা হতে শুরু করল!

 

বছরখানেক পর ঘরের একমাথা থেকে অন্য মাথাজুড়ে থাকা বিশাল কম্পিউটার সরিয়ে নতুন একটা কম্পিউটার বসানো হলো, সেটা আকারে অনেক ছোট, স্টিলের আলমারির সাইজ। কম্পিউটারের ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে। শুধু তাই না, কার্ড পাঞ্চ করার যন্ত্র, কার্ড রিডার—সব উধাও হয়ে গেল। এখন আমাদের রুমে রুমে ছোট ছোট টেলিভিশনের মতো মনিটর, সঙ্গে একটা কী বোর্ড দেয়া হলো। আমরা নিজেদের রুমে বসে কম্পিউটারে প্রগ্রাম চালাতে পারি, দেখে আমরা হা হয়ে গেলাম। দূর দূর থেকে মানুষজন এই প্রযুক্তি দেখার জন্য আমাদের ল্যাবরেটরিতে আসতে থাকে।

 

আমি তখন আমার পিএইচডির জন্য কাজ করছি, মাঝেমধ্যেই কম্পিউটারে কাজ করতে হয়। তখন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমার প্রফেসর আমাদের গ্রুপের জন্যই একটা কম্পিউটার কিনে ফেলেছেন। একেবারে খেলনার মতো কম্পিউটার, টেবিলের ওপর রাখা যায়। দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আমি সেটাতে কাজ করি, যে ক্যালকুলেশন করার জন্য মাথায় চুল ছিঁড়ে ফেলেছি, সেটা এখন চোখের পলকে করে ফেলা যায়।

 

একদিন ল্যাবরেটরিতে কিছু-একটা কাজ হচ্ছে, আমি ঢুকতে পারছি না, কম্পিউটারে কাজ করতে পারছি না। উপায় না দেখে কম্পিউটার আর মনিটরটা একটা ট্রলির ওপর তুলে ঠেলে ঠেলে আমার অফিসে নিয়ে যাচ্ছি। আমার একজন প্রফেসর কিছুক্ষণ হা করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘আমি নিজের চোখে এই ঘটনাটি দেখছি! বিশ্বাস হচ্ছে না!’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বিশ্বাস হচ্ছে না?’ প্রফেসর বললেন, ‘একজন মানুষ আস্ত কম্পিউটার এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নিয়ে যাচ্ছে! কী অবিশ্বাস্য ঘটনা!’

 

কিছুদিন পর সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা থেকেও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল। শুনতে পেলাম স্টিভ জবস নামের একজন মানুষ তাঁর ‘আপেল’ কম্পানি থেকে ম্যাকিনটোশ নামে একটি কম্পিউটার তৈরি করেছেন, সেটা হাতে করে নেয়া যায়। শুধু তাই নয়, সেই অবিশ্বাস্য যন্ত্রটি অনেক ডিসকাউন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে বিক্রি করা হবে।

 

আমি শুনে মোটামুটি ক্ষেপে গেলাম। ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক সেটা কিনতে হবে। পিএইচডি স্টুডেন্টদের মাসিক বেতন খুবই কম; কষ্ট করে কোনোমতে খেয়ে-পরে থাকা যায়। কিন্তু তত দিনে বিয়ে করে ফেলেছি। আমার স্ত্রীও আমার সঙ্গে পিএইচডি করছে। সে কিভাবে কিভাবে আমার জন্য কিছু ডলার ম্যানেজ করল এবং সেটা দিয়ে আমি ম্যাকিনটোশ নামের সেই কম্পিউটারটি কিনে আনলাম। সেই থেকে আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে গেল।

 

প্রথম যেদিন নিজের হাতে তৈরি করা ফন্টে সেই কম্পিউটারের স্ক্রিনে বাংলা লেখা দেখতে পেলাম, সেই দিনটির কথা আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না। একজন মানুষের জীবনে একেবারে নিজের জন্য ব্যক্তিগত একটা কম্পিউটারের চেয়ে বড় একটা কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য এর থেকে বড় কিছু আমি আমার জীবনে পাইনি!

 

মজার কথা হচ্ছে, এখন যারা ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ ব্যবহার করে, তারা নিশ্চয়ই আমার সেই ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের কথা শুনে হাসতে হাসতে মারা যাবে। সেই কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম, লেখালেখির জন্য ওয়ার্ড প্রসেসর ও ছবি আঁকার জন্য একটি সফটওয়্যার—সব কিছু থাকত ১২৮ কিলোবাইটের একটা ফ্লপি ডিস্কে! (না, আমি মেগাবাইট লিখতে গিয়ে ভুল করে কিলোবাইট লিখে ফেলিনি! আসলেই ১২৮ কিলোবাইট। সেই ফ্লপি ডিস্কে তার পরও কিছু জায়গা রাখা হতো নিজের কাজকর্ম রাখার জন্য!)

 

২.

এতক্ষণ যে কথাগুলো লিখেছি সেটা হচ্ছে ভূমিকা। এখন আসল কথায় আসি।

 

দেশের সবাই জানে কি না জানি না, আমাদের দেশে হাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য কম্পিউটারের প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ‘প্রতিযোগিতা’ বিষয়টি আমার খুব পছন্দের বিষয় না। কারণ, প্রতিযোগিতার অর্থ হচ্ছে অন্যদের কোনোভাবে পেছনে ফেলে নিজে সামনে এগিয়ে যাওয়া। প্রতিযোগিতা মানেই হচ্ছে এক ধরনের স্বার্থপরতা। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কোনো ধরনের সৃষ্টিশীল কাজে ডেকে আনার জন্য এর থেকে কার্যকর অন্য কোনো উপায় আমার জানা নেই।

 

আমরা যখন প্রথম এ দেশে গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করেছিলাম তখন কল্পনাও করিনি এত সাড়া পাব, এত ছেলেমেয়ে অংশ নেবে! আমি নিজে যদি কখনো এ ধরনের অলিম্পিয়াড বা প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকি, তাহলে সারাক্ষণই ছেলেমেয়েদের বোঝাই, প্রতিযোগিতাটা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি উৎসব!

 

যাই হোক, হাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের এই প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতাটাও মোটামুটিভাবে একটা উৎসবের মতো। সিলেট এলাকায় এই উৎসবটির আয়োজন করা হয়েছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঠিক তখন সিলেট এলাকায় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান হচ্ছে, সারা শহরে এক ধরনের টেনশন। শত শত ছেলেমেয়েকে নিয়ে এ রকম অনুষ্ঠান না করার জন্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপদেশ দিচ্ছে, তার মধ্যে শত শত ছেলেমেয়ে সময়মতো হাজির হয়ে গেছে। আয়োজক আমাদের বিভাগের তরুণ শিক্ষকরা, তাঁরা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রক্তচক্ষু না দেখার ভান করে আমি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক কথা বলেছি। তারা আমাকে যে কথাগুলো বলেছে, সেই কথাগুলো সবাইকে জানানোর জন্য আমি এই বিশাল ইতিহাস লিখতে বসেছি।

 

ছেলেমেয়েরা আমাকে বলেছে, তাদের অভিভাবকরা মোটেই চায় না যে তারা কম্পিউটারে প্রগ্রামিং করা শিখুক। তাদের মা-বাবারা চান ছেলেমেয়েরা কোচিংয়ে, প্রাইভেটে মাথা গুঁজে পাঠ্য বই মুখস্থ করতে থাকুক; কারণ তাঁদের ধারণা কম্পিউটার প্রগ্রামিং শিখে কোনো লাভ নেই। মা-বাবাদের ধারণা, জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া।

 

ছেলেমেয়েদের কথা শুনে আমি একই সঙ্গে বিস্ময় ও আতঙ্ক অনুভব করেছি। এটি কেমন করে সম্ভব যে আমাদের দেশের মা-বাবারা এত বড় একটা ভুল ধারণা নিয়ে থাকতে পারেন? আমি বিষয়টি নিয়ে যখন একটু চিন্তা করেছি, তখন আমার মনে পড়েছে, এই বয়সী ছেলেমেয়েরা আমার কাছে মাঝেমধ্যেই আরো একটি অভিযোগ করেছে। তারা বলেছে, তাদের মা-বাবারা পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়তে দেন না। আমি তাদের বলি, একজনকে বই পড়তে না দেয়া আর খেতে না দেয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কোনো মা-বাবা যদি তাঁদের সন্তানকে না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে চান তখন চুরি করে হলেও কিছু খেয়ে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখার মধ্যে যে রকম কোনো দোষ নেই; ঠিক সে রকম চুরি করে, গোপনে বাথরুমে বসে, গভীর রাতে চাদরের নিচে বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ার মধ্যেও কোনো দোষ নেই।

 

এই দেশের মা-বাবারা আমাকে যতই শাপশাপান্ত করুন না কেন, আমি ছেলেমেয়েদের যেকোনো মূল্যে বই পড়ার কথা বলে এসেছি এবং বলে যাব।

 

কম্পিউটার প্রগ্রামিং শেখার বেলাতেও একই কথা বলা যায়। যারা কম্পিউটারে কোনো ধরনের প্রগ্রামিং করেছে তারা সবাই জানে বিষয়টি আসলে কিছু নিয়ম মেনে যুক্তিতর্ক বা লজিকের সাহায্যে কম্পিউটারকে কিছু নির্দেশ দেয়া ছাড়া আর কিছু নয়। যারা কাজটি করে, দেখতে দেখতে তাদের যুক্তি বা লজিকমাফিক কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায়। কাজটি করার জন্য মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে হয়, তাই তাদের মস্তিষ্ক দেখতে দেখতে শাণিত হয়ে যায়। একটি ছেলে বা মেয়ে যত বেশি তার মস্তিষ্ককে চিন্তা করার কাজে লাগাবে, তার মস্তিষ্ক তত বেশি শাণিত হয়ে উঠবে—এটা বোঝার জন্য কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না।

 

কম্পিউটারের সামনে বসে ফেসবুক করা যতখানি খারাপ, প্রগ্রামিং করা ঠিক ততখানি ভালো। সবচেয়ে বড় কথা যে ছেলেটি বা মেয়েটি প্রগ্রামিং করতে শিখে গেছে তার সামনে একটা নতুন জগৎ খুলে দেয়া হয়েছে; সেই জগতে সে কী করবে, কতখানি করবে তার কোনো সীমারেখা বেঁধে দেয়া নেই।

 

মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে অনেক সময় এক ধরনের পরিশ্রম হয়। অন্যদের কথা জানি না, আমার নিজের বেলায় ঠিক তার উল্টো। ক্লান্তির কারণে যখন আমি কিছুই করতে পারি না, একটা বই পর্যন্ত পড়তে পারি না, তখনো কোনো বিচিত্র কারণে আমি কম্পিউটার প্রগ্রামিং করতে পারি। আমার জন্য সেটা এক ধরনের বিনোদন।

 

সেদিন একটি ছেলে আমার কাছে একটা ই-মেইল পাঠিয়েছে। সে লিখেছে তার খুব প্রগ্রামিং শেখার ইচ্ছা কিন্তু তার বাবা তাকে বলছেন যে সে প্রগ্রামিং শেখার জন্য ছোট, তার এখনো বয়স হয়নি।

 

কথাটি সত্যি নয়, প্রগ্রামিং শেখার জন্য কোনো বয়সের দরকার হয় না। যারা লিখতে শিখেছে তারাই প্রগ্রামিং করতে পারবে। সত্যি বলতে কি, ছোট শিশু যারা এখনো লিখতে শিখেনি, তারাও যেন কম্পিউটার প্রগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি করতে পারে সে জন্য বিশেষ প্রগ্রামিংয়ের ভাষা তৈরি হচ্ছে, যেখানে বাচ্চারা ছবি বা নকশা জুড়ে জুড়ে প্রগ্রামিং করতে পারে। এমআইটির মিডিয়া ল্যাবে আমি নিজে সে রকম একটা কাজ দেখে এসেছি।

 

এত কথা অবশ্য বলারও প্রয়োজন নেই, কম্পিউটার প্রগ্রামিংয়ে বয়স যে কোনো বাধা নয়, সেটার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে। প্রগ্রামিংসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে আমাদের দেশের যে প্রতিযোগীরা মেডেল নিয়ে এসেছে তারা ক্লাস নাইনে পড়ে! শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ঘাগু প্রগ্রামারদের যখন প্রতিযোগিতা হয় তখন মাঝেমধ্যে এই ‘বাচ্চাদের’ তাদের সঙ্গে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়া হয়, তখন অবলীলায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের হারিয়ে দিতে পারে! কাজেই বয়স কোনো বাধা নয়। ছোট ছেলেমেয়েদের উৎসাহ থাকলেই তারা কাজ করতে শুরু করে দিতে পারবে।

 

যারা প্রগ্রামিংয়ের কিছুই জানে না তারাও যেন একেবারে শূন্য থেকে প্রগ্রামিং শুরু করতে পারে সে জন্য চমত্কার কিছু বইও লেখা হয়েছে। কাজেই বিষয়টি আর জটিল নেই। প্রগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি করার জন্য দরকার এ রকম একটা বই ও একটা কম্পিউটার।

 

৩.

সত্যি কথা বলতে কি, প্রগ্রামিং করার জন্য এখন কম্পিউটারেরও প্রয়োজন নেই। তার কারণ স্মার্ট ফোনেও প্রগ্রামিং করার জন্য ‘কম্পাইলার’ (যেটা ব্যবহার করে কম্পিউটার প্রগ্রাম লিখে সেটা চালানো হয়) পাওয়া যায়। আমি চালিয়ে দেখেছি, ছোট কীবোর্ডে আমার ভোটকা আঙুল দিয়ে সঠিক অক্ষর স্পর্শ করার জটিলতা ছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি। কাজেই বলা যেতে পারে, কম্পিউটার প্রগ্রামিং করার বিষয়টি এই প্রথম শহরের সচ্ছল পরিবারের গণ্ডি থেকে বের হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে গেছে। আমি মনে করি, এই প্রথমবার আমাদের দেশের ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ দূর করার একটি সত্যিকারের সুযোগ এসেছে।

 

হাইস্কুলের ছেলেমেয়েদের প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতা আয়োজন করার সময় আমাদের মাথায় রাখতে হয় কয়টি ল্যাবরেটরিতে কয়টি কম্পিউটার আছে, তাই সর্বোচ্চ কতজনকে প্রগ্রামিং করার সুযোগ দিতে পারব। সবাইকে সুযোগ দেওয়া সম্ভব হতো না। আমার ধারণা, ঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারলে ইচ্ছা করলে এখন থেকে আমরা যতজন ইচ্ছা ততজনকে প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সুযোগ করে দিতে পারব। ছেলেমেয়েরা শুধু বাসা থেকে তাদের মা-বাবা-মা, বড় ভাই-বোন কিংবা নিজের স্মার্ট ফোনটি নিয়ে হাজির হবে। একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতার একটি গিনেস রেকর্ড করাও এখন এমন কিছু কঠিন নয়।

 

৪.

আমাদের এইচএসসির সিলেবাসে সি প্রগ্রামিং নামে একটা বিষয় ছেলেমেয়েদের পড়তে হয়। যেহেতু দেশের সব কলেজে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি নেই, তাই ছেলেমেয়েদের কখনোই সত্যিকার প্রগ্রামিং করার সুযোগ হয়নি। তাদের পরীক্ষা নেয়া হয় লিখিত পরীক্ষা দিয়ে। কম্পিউটার প্রগ্রামিংয়ের লিখিত পরীক্ষা নেয়া যে কথা, খেলার মাঠে সাঁতারের পরীক্ষা নেয়া সেই একই কথা। পুরো বিষয়টি বিড়ম্বনার মতো। যে খুব সুন্দর নাচতে পারে তাকে যদি আমি বলি তুমি কাগজে লিখে দাও নাচার সময় হাত-পা, মাথা-চোখ কখন কিভাবে নাড়াও আমি তোমার নাচটি উপভোগ করব, আমি নিশ্চিত সেই মানুষ আর যা-ই করুক, জন্মের মতো নাচা ছেড়ে দেবে। এখানেও সেই একই ব্যাপার। কম্পিউটার প্রগ্রামিংয়ে লিখিত পরীক্ষার কারণে ছেলেমেয়েরা প্রগ্রামিং সম্পর্কে শুধু যে ভুল ধারণা পাচ্ছে তা নয়, প্রগ্রামিংয়ের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে।

 

এই প্রথম একটা সুযোগ এসেছে সবাইকে সত্যিকারভাবে প্রগ্রামিং শিখিয়ে তাদের সৃষ্টিশীলতার একটা নতুন জগতে নিয়ে যাওয়ার। আমাদের ছোট একটি জীবন, সময়টা যদি উপভোগ না করি তাহলে কেমন করে হবে?

 

লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। 

 

বিবার্তা/হুমায়ুন/নিশি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com