শিরোনাম
কুসিক নির্বাচন থেকে যে শিক্ষা নিতে হবে
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০১৭, ১২:৫৩
কুসিক নির্বাচন থেকে যে শিক্ষা নিতে হবে
আমিনুল হক পলাশ
প্রিন্ট অ-অ+

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা। এই পরাজয়ের কারণ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মী সমর্থকরা নিজেদের মতো করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, দলের হাইকমান্ড থেকেও বক্তব্য দেয়া হয়েছে। চিহ্নিত হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের বেশ কিছু কারণ। দেড় বছর পর জাতীয় নির্বাচন, তার আগে অনুষ্ঠিত হবে আরও পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। কুসিক নির্বাচন থেকে তাই অনেক কিছু শিক্ষা নেয়ার আছে যা আসন্ন নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সহায়ক হবে।


প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা ভাল। একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে দলের অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে এমন নয়। পরাজয় সব সময় খারাপ লাগার অনুভূতি দেয়। তবে ক্ষুদ্র পরাজয় থেকে শিক্ষা নিলে বড় জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। তাছাড়া একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নবগঠিত নির্বাচন কমিশন নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পেরেছে যা প্রকারান্তে সরকারের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে।


পরাজয়ের কারণ নিয়ে ইতিমধ্যে নানা ব্যাখ্যা মিলেছে। তাই পয়েন্ট ধরে ধরে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। দলীয় কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় ঘটেছে এটা মোটামুটি সবার জানা। তবে কোন কোন বিষয়ে আরও ভাল করার সুযোগ ছিল সেই ব্যাপারগুলো আলোচনা করা যেতে পারে যা পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে প্রয়োগ করার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা সম্ভব হবে।


প্রথমে আসা যাক প্রার্থী নির্বাচন বিষয়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে প্রার্থীকে মনোনয়ন দিবেন তার পক্ষে নিষ্ঠার সাথে কাজ করা আওয়ামী লীগ এবং এর সকল সহযোগী সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের পবিত্র দায়িত্ব। নেত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করা বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। কুমিল্লার রাজনীতিতে আ ক ম বাহার এবং আফজাল খানের ঐতিহাসিক বিরোধ রয়েছে। এটা তৃণমুল থেকে দলীয় হাইকমান্ড পর্যন্ত সবার জানা। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে উনারা স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে একে অন্যের বিরোধিতা করেছেন। দলের পক্ষ থেকে উনাদের বিরুদ্ধে কখনই তেমন কোন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর এ কারণে এই বিরোধিতা এখনও বিরাজমান।


কুমিল্লার আওয়ামী রাজনীতিতে প্রভাবশালী এই দুই পরিবারের বিরোধ শুধু নির্বাচনকালীন সময়ের কার্যক্রম দিয়ে মিটানো সম্ভব নয়। যেহেতু আফজাল খান পরিবারের একজনকে মনোনয়ন দেয়া হবে সেহেতু প্রার্থিতা ঘোষণার অনেক আগে থেকে এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কাজ করা উচিৎ ছিল। সেটা সম্ভব না হলে বিকল্প ভাবা যেত।


কুমিল্লার নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে এই বিরোধিতার পালে নতুন হাওয়া লেগেছে বলেই মনে হয়। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য এই ব্যাপারটা থেকে দলকে শিক্ষা নিতে হবে। সারাদেশের অধিকাংশ আসনেই পদধারী এবং সুযোগসুবিধাপ্রাপ্ত নেতাদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বিরোধ রয়েছে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য এখন থেকেই কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় কোন্দল নিরসন না করে জাতীয় নির্বাচনে গেলে তার ফল কুসিকের মতোই হবে।


এবার আসা যাক নির্বাচনী প্রচার ইস্যুতে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনী প্রচারে এসেছেন। এটার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে। ইতিবাচক দিক হলো এতে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়, নব উদ্দীপনায় কাজ করে। তবে এই ক্ষেত্রে একটা বিষয় বিবেচনায় আনা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ কিংবা এর সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের গুরুত্ব বা আবেদন মূলত দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। দোদুল্যমান ভোটারদের মাঝে এই আবেদন স্বভাবতই কম, কিন্তু নির্বাচনে এরাই মূল ফ্যাক্টর। এই অংশের ভোট নিশ্চিত করতে হলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে করতে হবে যারা এলাকার লোকজনের পালসটা বুঝেন। কাকে কিভাবে বললে ভোট নিশ্চিত করা যাবে সেটা বুঝেন। কেন্দ্রীয় নেতারা সর্বোচ্চ ইন হাউস গ্রুমিং করতে পারেন, পলিসি মেকিং করতে পারেন, স্থানীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে পারেন এবং প্রচারের কাজ মনিটর করতে পারেন। কিন্তু উনারা ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাইলে আসলে কতটা লাভ হয় সে ব্যাপারে একটা সেকেন্ড থট দেয়ার সুযোগ রয়েছে।


জাতীয় নির্বাচনে তিনশ আসনে একদিনে নির্বাচন হবে। তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে সব আসনে গিয়ে প্রচার চালানোর সুযোগ থাকবে না। প্রত্যেকে নিজেদের আসন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। অতএব নিজ নিজ আসনের ভোট স্থানীয় নেতা, কর্মী এবং সমর্থকদেরই নিশ্চিত করতে হবে। এই প্রস্তুতি এখন থেকে নেয়া শুরু করতে হবে, কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে লাভ হবে না। এলাকার মানুষ এলাকার নেতাদের চিনে, সুবিধা অসুবিধায় তাদের কাছে যায়। অতএব স্থানীয় নেতাকর্মীদের কথায় যদি ভোট না দেয় তাহলে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাময়িক প্রচারে ভোট দিবে এমনটা আশা করা বোকামি।


তাছাড়া একমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগে আর একজন নেতাও নেই যার কথায় যেকোন অঞ্চলের মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে নৌকায় ভোট দিবে। এটাই বাস্তবতা এবং কিছুটা হতাশারও। কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের অবস্থানটা জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারছেন না অর্থাৎ দল কিংবা এলাকার পরিচয়ের বাইরে সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারছেন না।


সমস্যার দিকে আলোকপাত করা হলো। এবার সমাধানের বিষয়ে আসি। প্রথমেই প্রার্থী মনোয়নন সংক্রান্ত ব্যাপারে বলা দরকার। ইচ্ছা থাকলেও সব আসনে সর্বজন গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাছাড়া কেউই ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নয়। তবে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থী যেন কোনভাবেই ভোটারদের অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত না হয়। এটা নিশ্চিত করার জন্য এখন থেকেই সম্ভাব্য তিন চারজন প্রার্থীকে নিজ নিজ আসনে গিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করার কথা বলা যেতে পারে।


তারা আগামী দেড় বছর নিজ নিজ আসনে সরকারের উন্নয়নের কথা তুলে ধরবেন, মানুষদের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াবেন। দলীয় নেতাকর্মীদের আস্থায় আনার চেষ্টা করবেন। এই কাজে যিনি সবচেয়ে ভাল করবেন তার হাতেই নৌকা প্রতীক তুলে দিতে হবে। আর এই কাজে যারা বাধা দিবে কিংবা নতুন করে গ্রুপিং করবে তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচনের যথেষ্ট আগেই কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকবে এবং নিতে হবে।


এবার আসা যাক প্রচারের ব্যাপারে। ধরা যাক একটি আসনের মোট ভোটার তিন লাখ। তাহলে মোটামুটি দেড়শোটি কেন্দ্রে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এই দেড়শোটি কেন্দ্রের প্রতিটির জন্য দুই ধরনের টিম গঠন করতে হবে। প্রতিটির সদস্য হবে আনুমানিক ১৫/২০ জন করে। একটি টিমে থাকবে ঐ এলাকার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতারা যারা প্রচার দেখভাল করবেন, যেকোন সমস্যা হাইকমান্ডকে সরাসরি জানাবেন। দ্বিতীয় টিমে থাকবে সেই এলাকার সাধারণ আওয়ামী লীগ ভোটার, যারা পরীক্ষিত এবং দীর্ঘদিন ধরে নৌকায় ভোট দিয়ে আসছেন। আমার মতে এই টিমটাই হতে পারে নির্বাচনী ট্রাম্পকার্ড। বাস্তবতা হলো সাধারণ মানুষ বিশেষ করে দোদুল্যমান ভোটাররা দলীয় নেতাকর্মীদের চেয়ে সাধারণ মানুষদের কথাই বেশি শুনে। তাই দ্বিতীয় টিমটা সহজেই সাধারণ মানুষদের কনভিন্স করে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারবেন।


যথেষ্ট সময় আছে এখনও জাতীয় নির্বাচনের। সদিচ্ছা থাকলে সারাদেশের প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য এমন দুটি করে টিম এখনই করা সম্ভব। এই টিম দুটির গঠন প্রক্রিয়া, কাজের পরিধি এসব নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা এখানে লিখলাম না। তবে এমন কিছু সময় নিয়ে করতে পারলে প্রচারের কাজ অনেক সহজ এবং কার্যকর হবে, নৌকার বিজয় নিশ্চিত করা যাবে।


আসন্ন জাতীয় নির্বাচন দেশের জন্য একটি বিশাল টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে বাংলাদেশকে উনি এমন এক জায়গায় পৌঁছে দিবেন যেখান থেকে আর কখনো আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। কিন্তু এর অন্যথা হলে যতটা না আওয়ামী লীগ হারবে; তার চেয়ে বেশি এই দেশ হারবে, দেশের জনগণ বঞ্চিত হবে। সেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্য আওয়ামী লীগ এবং এর প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের সর্বোচ্চ পরিশ্রম করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জনসভায় ভোট চাওয়া শুরু করেছেন নৌকার পক্ষে।


লেখক: সাবেক ছাত্র নেতা


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com