নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিক্ষোভকে কেন্দ্র করে দেশের কতিপয় ‘সংবাদমাধ্যমের’ পরিবেশিত খবরে আমাদের ‘সাংবাদিকতার’ কদাকার চেহারা সামনে চলে এসেছে। ইরাক কিংবা আফগানিস্তান আগ্রাসনের সময় ইঙ্গ-মার্কিন বিবিসি, সিএনএন যে ধরনের 'সাংবাদিকতা, করেছে বা এখন যেমন সিরিয়া ইস্যুতে করছে, নর্থসাউথ ইস্যুতে দেশের গুটিকয়েক ‘সংবাদমাধ্যম’ও ওইরকমই ‘নটোরিয়াস জার্নালিজমই’ করতে চেয়েছে।
করেছে ঠিকই, কিন্তু ধরা পড়ে গেছে। চীনে একটা কথা প্রচলিত আছে - ‘ডোন্ট বি সো সিএনএন (Biased)’। বিবিসি, সিএনএন যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারে আমাদের মিডিয়ার ওই অংশটি এখনো সে লেভেলে পৌঁছুতে পারেনি।
এদেশের সংবাদমাধ্যম-মালিক, রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক অভিজাতরা ম্যাস পিপলকে কী মনে করেন, তারাই জানেন। ‘পাবলিক’ বলে পরিচিত জনসাধারণের সাথে আছে বদনকিতাব (ফেসবুক), ইউটিউব। কোটি কোটি মানুষের হাতে স্মার্টফোন। এখন আর কিছুই লুকিয়ে রাখার উপায় নেই। সবকিছুই এখন রেকর্ড হয়, প্রকাশিত হয়, প্রচারিত হয়। ফলে এই জমানায় প্রতিটি ব্যক্তিই যেন একেকটা গণমাধ্যম! ফলে আগের মত মানুষকে বোকা বানিয়ে তথ্যপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখার কাজটি না করতে যাওয়াই ভালো। এইজন্য তথাকথিত ‘মূলধারার’ সংবাদমাধ্যমগুলোকে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি সতর্ক হয়ে চলতে হবে।
সত্য বলতে না পারেন, মিথ্যা বলার দরকার কী? বদলে যাওয়া পৃথিবীতে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন দূরে থাক, দিন দিন যেন মানুষের মগজ নিয়ন্ত্রণ করার অপরিণামদর্শী প্রয়াস কিছু সংবাদমাধ্যমের আরও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রের 'চতুর্থ স্তম্ভ' বলে গরিমা করা সংবাদমাধ্যম এখন সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা হারাচ্ছে। ক্রমেই রাষ্ট্রের পঞ্চম স্তম্ভ হয়ে ওঠা সোশ্যাল মিডিয়া এখন মানুষের অনেক বেশি কাছের, অনেক বেশি আপন হয়ে উঠেছে।
সব মিডিয়া হাউজেরই নিজস্ব পলিসি থাকে। এই পলিসিকে যে হাউজ যত পেশাদারিত্বের সাথে, বস্তুনিষ্ঠতার মোড়কে মেইনটেইন করতে পারে সেই সবচেয়ে সফলকাম হয়। এমন কোনো সাংবাদিক বা সংবাদকর্মী পাওয়া যাবে না, যারা নিউজ কিল করেনি। রিপোর্টার, সাব-এডিটর, নিউজরুম এডিটর থেকে সম্পাদক পর্যন্ত প্রতিটি স্টেজেই নিউজ ফিল্টারিং করতে হয়। নিউজ মেকিং প্রক্রিয়ার নিত্যদিনের যে চর্চা তার ফলেই তো সমাজের সংবাদযোগ্য অনেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না। ঘুরেফিরে সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসা/অফিস, বিরোধীদলীয় নেতার বাসা/অফিস, আওয়ামী লীগ/বিএনপির খবর, মন্ত্রীদের কথা, বিজ্ঞাপনদাতাদের খবর, মালিক কিংবা সম্পাদকের ব্যক্তিগত কোনো অনুষ্ঠান - এগুলোই তো প্রধান খবর হয়ে আসে। উপর থেকে নিচে আসে খবর, নিচ থেকে উপরে যায় না। কোনো কোনো ঘটনা এমন বড় হয় যে কাভারেজ না দিয়ে উপায় থাকে না। বড় কোনো ঘটনা/দুর্ঘটনা না থাকলে, সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য টাইম পাস করা কঠিন হয়ে পড়ে। নিজেদের অনুসন্ধানী/ব্যাখ্যামূলক সাংবাদিকতা নেই বললেই চলে। এর মধ্যে আবার যদি সাংবাদিকতা হয়ে যায় দুর্বৃত্তদের হাতিয়ার তাহলে আর থাকে কী?
কিছু দুর্বৃত্তের জন্য পুরো প্রফেশনকে গালি খেতে হয়। অথচ সাংবাদিকতা করে বাংলাদেশে এখনো সমাজ বদলে দেয়া সম্ভব। কিন্তু তা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আমার মতে মূল সমস্যা মালিকানায়। সারাজীবন দুনম্বরি করে টাকা-পয়সার মালিক হয়ে পত্রিকা খুলে সংবাদমাধ্যমের মালিক হয়ে যায় এরা।
দারুণ সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সাংবাদিকতা করতে আসছেন। কিন্তু সাংবাদিকতার মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের পাশাপাশি সমাজকে বদলে দেয়ার পরিবেশ পাচ্ছেন না। স্যাররা ক্লাসে শুধু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কথা বলেন, কর্পোরেট সাংবাদিকতার কথা বলেন। শেয়ার বাজার লুট করা, ভুমি দখলকারী মালিক থেকে পেশাদার কর্পোরেট-মালিকানাধীন মিডিয়া অনেক বেশি কাম্য আমার কাছে। ব্যাংক লুট করে, দিনের পর দিন রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাত করে, চোরাকারবারি করে বিত্তবান হয়ে কালো টাকা সাদা করে দেখানোর জন্য কোম্পানী খুলে বসলেই কর্পোরেট হওয়া যায় না।
সাংবাদিকতা কোনো ব্যাংকের চাকরি না, কোনো এনজিও কিংবা সরকারি দফতরের কেরানীর কাজও না। ডাক্তার, পুলিশ, আর্মিতে কাজ করতে গেলে যেমন ‘বাড়তি কিছু’ লাগে, সাংবাদিকতায় তার চেয়ে অনেক বেশি ‘বাড়তি কিছু’ লাগে। সাধারণ কাজের সাথে এর কোনো তুলনা চলে না। সাংবাদিকতা হল ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ মত পেশা। সমাজকে কলুষমুক্ত করার কাজ হল সাংবাদিকতা। শিক্ষকতা থেকেও মহান এই পেশা। এখানেও বেতন থাকতে হয়, বোনাস থাকতে হয়, ছুটি কাটাতে হয়। এখানেও প্রেমিক-প্রেমিকা থাকে, বিয়ে থাকে, সন্তান জন্মদান হয়, সন্তান বড় করা হয়। এখানেও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে হয়। সব আছে অন্য পেশার মতই। কিন্তু তারপরও সবার থেকে আলাদা এই পেশা।
সাংবাদিকতা কী? একটা প্রফেশন নাকি প্যাশন? বলা যায়, ‘অ্যা প্রফেশন উয়িথ প্যাশন’। এখানেও অফিস থাকে, বস থাকে, নিয়ন্ত্রণ থাকে। কিন্তু এখানে মূল অনুঘটক হল বিবেক, মূল্যবোধ, সংবাদমূল্য, সংবাদ চেতনা। সারাক্ষণ মানুষের জন্য কিছু করার একটা তাড়না থাকে। এটাও চাকরি। কিন্তু এই চাকরি দিয়ে নিজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার পাশাপাশি সমাজ বদলের জন্য কাজ করা যায়। কত মহান একটা পেশা। অথচ মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এত শক্তিশালী একটা কাজের কী বাজে ভাবেই না ব্যবহার হতে দেখছে দেশবাসী।
নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ইস্যুতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এবং দুয়েকটি পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো দেখলাম। মোটর সাইকেল রাখা নিয়ে গণ্ডগোল। গার্ডরা মারধর করে ছাত্রদের। এক পর্যায়ে স্থানীয় কিছু গুন্ডাও গার্ডের সাথে যোগ দেয়। ছাত্ররা একজোট হয়, আন্দোলনে যায়। রাস্তা অবরোধ করে রাখে। যানজট হয়। কয়দিন আগে শ্রমিকরাও তো সারাদেশ অচল করে দিয়েছিল। তখন কি শ্রমিকদের কেউ ‘জঙ্গি’ বলে পরিচয় দিয়েছে? পুলিশ, র্যা ব, আর্মি কেউ জানল না, দেশের ৯৮ শতাংশ মিডিয়া জানল না যে যমুনা ফিউচার পার্ক এবং সংলগ্ন এলাকায় জঙ্গি হামলা হয়েছে! কেবল একটি টেলিভিশন চ্যানেল আর কয়েকটি সংবাদপত্র শুধু জানল এবং রিপোর্ট করল। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের এভাবে জঙ্গি বলার অধিকার কে দিল এসব ‘সংবাদমাধ্যম’কে?
সর্বশেষ গুলশানে জঙ্গি হামলায় অংশ নেয়া সন্ত্রাসীদের অনেকে নর্থ সাউথের স্টুডেন্ট ছিল। জঙ্গিরা নর্থসাউথকে বেছে নিয়েছিল, নর্থসাউথ জঙ্গিদের বেছে নেয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিজবুত তাহরিরের লিডার হিসেবে শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছে, এই সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, সাংবাদিকতা বিভাগ থেকেই এক ছেলে হিজবুত তাহরিরের লিফলেটসহ গ্রেপ্তার হয়েছে। এখন কি বলা যাবে, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই জঙ্গি? যদিও কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা এমন একটি প্রতিবেদন করেছিল। আমাদের প্রতিবাদের মুখে আনন্দবাজার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
সর্বশেষ ঘটনায় কিছু সংবাদমাধ্যম যেভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নর্থসাউথের ছেলেমেয়েদের জঙ্গি বলে দেশবাসীর সামনে হেয় করার অপচেষ্টা করেছে, সেটা শুধু ন্যক্কারজনকই না, দেশের জন্য হুমকিস্বরূপও। রাষ্ট্রকে, সরকারকে, সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে। মালিকদের ফোন করে বলতে হবে, এমন সাংবাদিকতা করলে চ্যানেল, পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হবে।
কিন্তু এই সাহস কি রাষ্ট্রের আছে? মালিকদের কিছুই হয় না, তাদের লজ্জা লাগেনা। লজ্জা হয় আমাদের, সাংবাদিকদের। বদনাম হয় প্রফেশনের।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/হুমায়ুন/পলাশ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]