শিরোনাম
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১১:০৪
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু
মাহমুদুল বাসার
প্রিন্ট অ-অ+

কবি অন্নদা শঙ্কর রায়কে বলেছেন বঙ্গবন্ধু, হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে গেলাম ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। (মিনার মনসুর সম্পাদিত শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ- ইন্দ্রপাত)। আরেক বক্তৃতায় বলেছেন বঙ্গবন্ধু, ‘১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ যখন করাচিতে গণপরিষদে এ মর্মে প্রস্তাব পাস করা হলো যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, তখন থেকেই বাংলাভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। তখন কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একমাত্র এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন। আমি অবাক হয়ে যাই ঐ সময়ে আমাদের বাঙালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ কি করেছিল? (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি-বাংলা একাডেমি)।


১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ ভারতে হিন্দি ভাষার অনুকরণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদ করেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লা ও আবদুল হক, পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান ১৯৪৭ সালের ১৮ মে তারিখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে মতামত দেন। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বাঙালি মন্ত্রী ফজলুল রহমান ও হবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী।


রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত পাকিস্তানি শাসকদের আচরণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্রসমাজ ও বিভিন্ন স্তরের জনগণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরে ছড়িয়ে যেতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার প্রস্তাব করেছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তা নির্মমভাবে উপেক্ষিত হয়।


রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ১০ মার্চ তারিখে রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি সভা বসেছিল, সেখানে বঙ্গবন্ধু আপসকামীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জোর দিয়ে বলেছিলেন, ১১ মার্চ হরতাল পালিত হবে, সচিবালয়ের সামনে পিকেটিং হবে। অলি আহাদ বলেছেন, ‘সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছতেন তাহলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না।’


বঙ্গবন্ধু সেদিন রাতে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা চলে আসেন। ফজলুল হক হলের সভায় যোগদান করেন। ১১ মার্চ হরতালে পিকেটিং করার সময় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ১১ মার্চের আন্দোলন তীব্র হওয়ার ফলে নাজিমুদ্দিন সরকার নমনীয় হয়। ছাত্রদের একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিটি বঙ্গবন্ধুসহ বন্দি ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। চুক্তি মোতাবেক বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ কারামুক্ত হন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পুকুর ধারে একটি ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু। তাজউদ্দীন আহমদ তার ডাইরিতে বলেছেন, ‘১৬ মার্চ ৪৮, মঙ্গলবার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টায় সভা শুরু হলো। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। ...যদিও সংগ্রাম কমিটির কোনো কর্মসূচি ছিল না। তবুও অ্যাসেম্বলি হাউস অভিমুখে ছাত্রদের একটা বিক্ষোভ মিছিল পরিচালিত হলো এবং সরকারি দলের এমএলএদের নিন্দা করে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করল। অনুরোধ সত্ত্বেও ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করা গেল না।’


বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বলেছেন. ‘১১ মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিংয়ের দরকার হয়নি। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হলো। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল, কিছু খোলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহরে পুরাপুরি হরতাল পালন করে নাই। সকাল ৮টায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হলো। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেক দল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এভাবে গোলমাল, মারধর চলল অনেকক্ষণ। ৯টায় ইডেন বিল্ডংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হলো। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার, শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ ওয়াদুদ গুরুতর রূপে আহত হলো। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আরও অনেকে আহত হলো। ... আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার পর।’


আরও বলেছেন, ‘আমাদের ১১ তারিখ জেলে নেয়া হয়েছিল, আর ১৫ তারিখ মুক্তি দেয়া হয়। জেলগেট থেকে শোভাযাত্রা করে আমাদের সলিমউল্লাহ মুসলিম হলে নিয়ে যাওয়া হলো। ... ১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সবাই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সবাই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো।’


১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল জিন্নার ফ্যাসিবাদী ঘোষণার কারণে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন বিস্ফোরণ আকারে দেখা দিয়েছিল ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণায়। তিনি জিন্নার কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’


বঙ্গবন্ধু তখন কারাগারে। মহিউদ্দীন আহমদও কারাগারে। খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণায় জেলের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি’ বইতে বলা হয়েছে, ‘উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য মতে, তারা উভয়ে যুক্তি করে ঠিক করলেন মুজিব অসুস্থতার ভান করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবেন। সে ভাবেই মুজিবকে ডাক্তারের সাহায্যে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাতে সক্ষম হলাম। ভাষা আন্দোলনকে তীব্র গতিশীল করার উদ্দেশ্যেই এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে তার প্রতিফলন লক্ষণীয়। ঢাকা জেলে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ বন্দি অবস্থা থেকে শামসু হক চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ ও গোলাম মাওলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ১১ ফেব্রুয়ারি হরতাল ডেকে অ্যাসেম্বলি ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দান করেন।’


বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমদকে ঢাকা মেডিকেল থেকে আবার জেলে পাঠানো হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বন্দি মুক্তির দাবিতে ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমদ জেলে আমরণ অনশন শুরু করেন। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।


যাওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে বঙ্গবন্ধু শামসুদ্দোহাসহ ছাত্র নেতাদের বলেছিলেন, হরতাল মিছিল শেষে আইন সভা ঘেরাও করে যেন বাংলাভাষার সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয়।


কারাগারে বঙ্গবন্ধুর অনশনের বিষয়টি ২০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য আনোয়ারা খাতুন মুলতবি প্রস্তাব হিসেবে উত্থাপন করেন। তখন নুরুল আমীন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তার সরকার আনোয়ারা খাতুনের প্রস্তাবের গুরুত্ব দেয়নি। ২৭ ফেব্রুয়ারি গণদাবির মুখে ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেলেও পাকিস্তানের গোয়েন্দা পুলিশ বঙ্গবন্ধুর ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখে। একটানা আড়াই বছর বঙ্গবন্ধু জেল খাটার পর তার শরীরের অবনতি ঘটেছিল। অনশনের সময় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘আমরা জেল গেটে এসে দেখি, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব এসে গেছেন। আমাদের তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে যেতে বললেন। জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন, তবে রাজবন্দিদের সঙ্গে নয়, অন্য জায়গায়। আমরা তাড়াতাড়ি ওষুধ খেলাম পেট পরিষ্কার করার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। দু'দিন পর অবস্থা খারাপ হলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের দুই জনেরই শরীর খারাপ। চারদিন পরে আমাদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। মহাবিপদ! নাকের ভেতর নল দিয়ে পেটের মধ্যে পর্যন্ত দেয়। তারপর নলের মুখে একটা কাপের মত লাগিয়ে দেয়। একটা ছিদ্রও থাকে। সে কাপের মধ্যে দুধের মত পাতলা করে খাবার তৈরি করে পেটের ভিতর ঢেলে দেয়। এদের কথা হলো ‘মরতে দেব না।’


‘আমার দুটি নাকের ভেতরেই ঘা হয়ে গেছে। তারা হ্যান্ডকাপ পরানোর লোকজন নিয়ে আসে। বাধা দিলে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে জোর করে ধরে খাওয়াবে। আমাদের শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাঁচ-ছয় দিন পরে বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।’ (পৃঃ ২০১)।


লেখক: প্রাবন্ধিক


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com