শিরোনাম
বঙ্গমাতা : স্বাধীনতা সংগ্রামের নিভৃতচারী সৈনিক
প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২১, ১২:০২
বঙ্গমাতা : স্বাধীনতা সংগ্রামের নিভৃতচারী সৈনিক
ফাইল ছবি
শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল
প্রিন্ট অ-অ+

‘সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছো, তুমি জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছো, তুমি জানো যে এ দেশের মানুষের জন্য কী চাই, তোমার থেকে বেশি কেউ জানে না, তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি শুধু সেই কথাই বলবে, কারো কথা শুনতে হবে না। তুমি নিজেই জানো তোমাকে কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সে কথাই বলবা।’


যে মহীয়সী নারীর এমন দৃঢ়প্রত্যয় সাহস জোগানোর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন ৭ই মার্চের অমর ভাষণ দিয়েছিলেন, বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন, ৭ই মার্চের ভাষণের নেপথ্য শক্তি—তিনি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ডাকনাম রেণু।


১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা শেখ জহুরুল হক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতি সম্পর্কের চাচা এবং গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবার।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন যে আমার সাথে তার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিলো, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।’


বঙ্গবন্ধুর মা বেগম সায়রা খাতুন পাঁচ বছর বয়সে মাতৃহীন রেণুকে ঘরে তুলে নেন এবং নিজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা ও গৃহকর্মে বড় করে তোলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন, ‘আটপৌরে সাধারণ বাঙালি গৃহবধূ কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন, ধৈর্যশীল, সংগ্রামী এবং স্নেহ-ভালোবাসার আধার।


শেখ মুজিবের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেগম ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন অফুরান প্রেরণার উৎস। ১৯৬৬-তে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে শেখ মুজিব যখন বারবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বেগম মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাঁদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাতেন। জেলখানায় দেখা করার সময় ছেলে-মেয়েদের শিখিয়ে নিতেন একটু হৈচৈ করার জন্য, আর ওই ফাঁকে বাইরের সমস্ত রিপোর্ট স্বামীর কাছে দেয়া আর তাঁর কাছ থেকে পরবর্তী করণীয় নির্দেশনা জেনে নেয়া। নির্দেশনাগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।


বঙ্গবন্ধু এমএনএ, এমপি-মন্ত্রী থাকাকালে অনেকবার করাচি গেছেন। বেগম মুজিব একবারের জন্যও তাঁর সঙ্গী হন নাই। কখনো যেতে চাইতেন না। সবার আগে তিনিই বুঝেছিলেন এ দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। তাঁর মধ্যে এই চেতনা অত্যন্ত তীব্র ছিল এবং বিশ্বাসও ছিলো।


আগরতলা মামলা নিষ্পত্তির জন্য আইয়ুব খান লাহোরে গোলটেবিল বৈঠক ডাকে। প্রস্তাব দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে ছাড়া হবে প্যারোলে। বেগম মুজিব স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন যেন তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত না নেন। জানালেন দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ আছে।


বাংলা নামে দেশ, বইয়ের লেখক পৃ. ১৪৮, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর রেসকোর্স ময়দানে সারেন্ডার করার পর বেগম মুজিবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা করেছেন এভাবে ‘গতকাল বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজি নাকে খত দিয়েছে। সাংবাদিক চঞ্চল সরকার পরদিন সকালে ঢাকা দেখতে বেরিয়েছেন। এর আগে কোনদিন আসেননি। হাঁটতে হাঁটতে ধানমন্ডি। ১৮ নম্বরে গেলে কেমন হয়? কাছাকাছি যেতেই সবাই বললেন, আর এগোবেন না। কাল ৬জনকে খানসেনারা গুলি করে মেরেছে। ওরা চোরাগোপ্তা গুলি চালাচ্ছিলো ঠিকই। কিন্তু তাই বলে– অবাক কান্ড! চঞ্চলবাবু এগোলেন।


ঘড়িতে তখন বেলা দশটা। ডিসেম্বরের সকালে গায়ে রোদ লাগতে ভালই লাগছিলো। আর এগোনো গেল না। সেই আঠারো নম্বরের বিখ্যাত বাড়ির ছাদে খাকি উর্দির পাক আর্মি ব্যাংকার বানিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। এল এম জি তাক করে রয়েছে। ওরা কি সারেন্ডারের খবর রাখে না! ফাইট টু দি লাস্ট–নিয়াজির হক‌ কথাটুকু আঁকড়ে রয়েছে। চঞ্চলবাবু কাছাকাছি গোর্খা রেজিমেন্টের মেজর তারাকে পেলেন।


ক'জন জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ছুটে এলেন। কিন্তু পাক সোলজাররা বোঝে না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেজর তারা ওদের নিরস্ত্র করলেন। ততক্ষণে ভারতীয় জওয়ানরা পজিশন নিয়েছে। পাক পতাকা নামিয়ে ফেলে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল। ফজিলাতুন্নেছা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাতিল চাঁদ তারা মার্কা লাগানো পতাকা আচ্ছা করে পায়ে মাড়লেন।


তাদের মায়ের পেছনে হাসিনা, রেহানা, রাসেল। ছোটমামা রাসেলের কোলে ভাগ্নে জয়। ওঁদের সঙ্গে ঘরে ঢুকলেন চঞ্চলবাবু। সঙ্গে ফটোগ্রাফার তারাপদ ব্যানার্জী। সারা বাড়িতে একখানা চৌকি নেই। মেঝেতেই বিছানা। ঝোলানো দড়িতে শাড়ি, কাপড়। বসার কোন চেয়ারও নেই। চঞ্চল, তারাপদ প্রণাম করলেন বেগম মুজিবকে। চোখে জল এসে গেলো।


আস্তে বললেন, কোনো খবর জানেন ওর? ন'মাস কিচ্ছু জানি না। পাহারাদার সোলজারদের হাতে অপমান, লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে। হাসিনার বাচ্চা হলো। চিঠি লিখেছিলো ওর বাবাকে। ওরা চিঠি পাঠায়নি। তবে একজন ভালো ব্যবহার করেছে।


পাক আর্মির মেজর হোসেন। কথা বলতে বলতে তিনি মেজর তারাকে একটা হাতঘড়ি উপহার দিলেন। চোখের জল মুছে বেগম মুজিব বললেন, হাসিনা হাসপাতালে। বাচ্চা হয়েছে। মাত্র চল্লিশ মিনিটের জন্যে দেখতে যেতে দিয়েছিলো। কোনো কিছু খাবার পাঠাতেও দেয়নি। কোনোরকম কিছুই দেয়নি। সংসার চালাবার কোন ব্যবস্থাই ছিলো না। গতরাতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আসতে চেষ্টা করেছিলো। ছাদ থেকে গুলি করে ৬ জনকে শেষ করে দিলো ওরা। দানবের হাতে ছিলো আধুনিক মারণাস্ত্র। ন্যায়নীতির কোন ধার ধারেনি ইয়াহিয়া। তার দাপাদাপির ভেতরে থেকেও এই সামান্য বাঙালিনী অসামান্য সাহসের পরিচয় দিয়েছেন আগাগোড়া। এতটুকু মচকাননি। কিন্তু এবার পাথর কিছু টলে গেলো।’


নেপথ্যে থেকে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে এবং ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। বন্দি থেকেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে দলের নেতাদের নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন। বেশ কয়েকবার গোয়েন্দা সংস্থা জিজ্ঞাসাবাদ ও শাস্তি-নির্যাতনের হুমকি দেয়, তবু তিনি ছিলেন অকুতোভয়। দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতেও প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন জাতির জনককে। পাঁচ সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন এই মহীয়সী নারী। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইতিহাসে শুধু একজন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণী নন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যের অন্যতম অনুপ্রেরণাদানকারী মহীয়সী নারী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন তিনি।


ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের সময়ও জীবনের মতো মরণের সহযাত্রী হলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। জীবনের পাট চুকিয়ে, যার সঙ্গে সারা জীবন একসঙ্গে সুখে-দুঃখে কাটিয়েছেন সেই স্বামীর সঙ্গে একই সঙ্গে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সবকিছু পেছনে ফেলে চলে গেলেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালি তার অসামান্য অবদানের কথা মূল্যায়ন করবে, গবেষণা করবে, তিনি জাগরুক থাকবেন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের নিভৃতচারী একজন সাহসী কারিগর হিসেবে।


লেখকঃ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ


বিবার্তা/বিদ্যুৎ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com