শিরোনাম
৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের এক মহামুল্যবান শিল্প
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২১, ২৩:০৫
৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বের এক মহামুল্যবান শিল্প
ড. মো: নাসির উদ্দীন মিতুল
প্রিন্ট অ-অ+

যথাযথ সংগ্রহ, সংগঠন, বিতরণ ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ছাড়া মানসম্পন্ন কোনো শিল্পকর্ম বা সাহিত্য মানুষের মনে দাগ কাটেনা। আবার মানুষের মনে যে শিল্প বা সাহিত্য দাগ কাটেনা তা কালোত্তীর্ণ হয় না। অর্থাৎ ব্যক্তিমনে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ তৈরিতে সক্ষম সবকিছুই অনন্তকাল স্বমহিমায় টিকে থাকে। যেমন-পুথিশিল্প, টেরাকোটার শিল্প, মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন, কষ্টিপাথরে খোদাই করা মূর্তি, মুসলিম স্থাপত্য। এগুলো সবই প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে।


আবার প্রাচীন কালের বিভিন্ন লেখার সামগ্রী যেমন রোসেটা পাথর, ক্লে-ট্যাবলেট, পার্চমেন্ট, ভেলাম, ওয়াক্স সহ এ যাবৎকাল পর্যন্ত প্রাপ্ত ব্যক্তিগত বা সরকারী-বেসরকারী সব দুর্লভ দলিল-দস্তাবেজ ও লেখনী প্রাচীন ও বর্তমান সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আর্কাইভে। ঠিক তদ্রুপ, প্রাচীন সাহিত্য যেমন-আরব্য উপন্যাস, ঠাকুরমার ঝুলি, ঈশপের গল্প, মহাভারত, সেক্সপিয়রের রচনাবলী, ইলিয়াডের কাব্য, রবীন্দ্র রচনাবলী, নজরুলের কাব্য যা মানুষের মনে যুগের পর যুগ প্রচন্ড আবেগ সৃষ্টি করে চলেছে সেগুলো স্থান করে নিয়েছে লাইব্রেরিতে।


এগুলো মানুষের চিরদিনের সম্পদ। জাদুঘর, আর্কাইভ ও লাইব্রেরি সেই সম্পদকে ধারণ করে এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতায় বহন করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথ চলা সুগম করে। তাই জাদুঘর, আর্কাইভ ও লাইব্রেরি ক্রমেই জীবন্ত উপকরণ হয়ে বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎকালের মধ্যে এক অপূর্ব সেতুবন্ধন তৈরী করে চলেছে। সে কারণে সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে এই তিনের গুরুত্ব সর্বজনবিদিত।


বঙ্গবন্ধুর কালো চশমা, পাইপ, রক্তমাখা সাদা গেঞ্জীসহ ব্যবহৃত প্রতিটি নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরনই এখন মানুষের ভালোবাসায় লালিত যা যাদুঘরে সংরক্ষিত। এগুলো মানুষের মনে দারুন এক আবেগের তৈরী করে। ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসে। মানুষ তাঁর কর্মময় জীবন ও অবদান সম্পর্কে জানতে পারে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়ে গৃহীত চুক্তিনামা, পরিকল্পনা, দ্বিতীয় বিপ্লব (১৯৭১-১৯৭৫) এর নকশা, উন্নয়নের মাষ্টার প্ল্যান, রোডম্যাপ, মন্ত্রী পরিষদের কর্মকাণ্ড, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বৈদেশিক সহায়তা চুক্তি, উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে সমঝোতার দলিল, নতুন সংবিধান, অধ্যাদেশ ইত্যাদি যা বর্তমান সময়ের পথ চলার পাথেয় তা শোভা পাচ্ছে আর্কাইভে।


কেন এগুলো আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে? আর্কাইভসের সংজ্ঞার মধ্যেই পাঁচটি অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য বিদ্যামান যার একটি কম হলেও তাকে আর্কাইভস হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। যেমনঃ ১। যে সকল সামগ্রীর ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে; ২। যেগুলোর গবেষণা মূল্য রয়েছে; ৩। যাদের ঐতিহ্যগত ও সংস্কৃতি মুল্যমান অতীতে বজায় ছিল এবং চাহিদা ক্রমবর্ধমান; ৪। এর জন্য একটি নিরাপদ মহাফেজখানা বা কাস্টোডি থাকতে হবে এবং ৫। একজন দায়িত্বশীল পেশাগত আর্কাইভিষ্ট (যার ইতিহাস ও তথ্য বিজ্ঞানের ওপর সম্যক জ্ঞান রয়েছে) কাস্টোডিয়ান হিসেবে থাকতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিসই এখন আর্কাইভ। কারণ তাঁর ৫৫ বছরের জীবন-ইতিহাস এক আত্ম-উৎসর্গের ইতিহাস। আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস।


মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস। তাঁর রচিত কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও আমার দেখা নয়াচীন বই তিনটি প্রকাশিত না হলে অগোচরেই থেকে যেতো এ মহান নেতার অনেক অজানা ইতিহাস। এগুলো আজ জাতীয় সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে লিখিত ছোট ছোট চিরকুট, ডায়েরী এসবের ভাঁজে ভাঁজে ছিল ইতিহাস। কালের উজান বেয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে বাঙ্গালীর হৃদয়ে তা নির্যাস ছড়াচ্ছে। তাই গ্রন্থগুলো লাইব্রেরীকে যেমনি সমৃদ্ধ করেছে তেমনি লাইব্রেরীও বঙ্গবন্ধুকেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তাঁকে অমরত্ব দান করে চলেছে।


প্রশ্ন হল একটি ভাষণ কিভাবে বিশ্বজুড়ে মহামুল্যবান শিল্প হিসেবে সকল জাতির নিকট রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে? চলুন, জেনে নিই এর সঠিক ব্যাখ্যা। ৭ই মার্চের ভাসণের প্রতিটি শব্দ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে সেদিন স্বতঃস্ফুর্তভাবে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল। কোথাও এতটুকু ভাটা পড়েনি। অপশাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে সাহস, শক্তি, বজ্রকন্ঠ একাকার হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি শব্দ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বাক্যে ছিল যুক্তি। শব্দচয়ন, বাচন-ভঙ্গিমা আর তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় মাত্র ১৮ মিনিটের এ ভাষণ উপস্থিত ১০ লক্ষ দর্শক-শ্রোতার রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। স্বাধীনতা অর্জনে উম্মাদনা তৈরী করে। এ ভাষণ আবেশী চুম্বকের মত মুহূর্তেই আবিষ্ট করে দেয় গোটা জাতিকে। যে ভাষণের মধ্যে নিহিত ছিল একটি জাতির মর্মকথা। বাঙ্গালীর জন্মকথা। একটি জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাস। তাইতো সার্বিক বিবেচনায় এ ভাষণ উপমিত হয় ভাষাবাহিত সুকৌশল এক অপরুপ শিল্পকর্মে যা আজ বিশ্ব ঐতিহ্য-সম্পদ।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর এ ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর মধ্যে অন্যতম। কৌশল ও সুনিপুণ উপস্থাপনায় বঙ্গবন্ধু আগাগোড়াই প্রমাণ করেন তিনি একজন সুদক্ষ রাজনীবিদ। এ জন্য নিউইয়র্ক টাইমস্ তাঁকে উপাধি দিয়েছে ‘The Poet of Politics’ বা ‘রাজনীতির কবি’। ইউনেস্কো অবিস্মরণীয় এ ভাষণকে ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।


এর উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে-এটাই বিশ্বের একমাত্র অলিখিত ভাষণ যা প্রথমবারের মত ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিলো। এটি এখন সমগ্র বিশ্বের জন্য ঐতিহাসিক প্রামাণ্য-দলিল। এ ভাষণের মূল আকর্ষণ কোথায় একটু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করি। ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বুঝিয়ে দিলেন রক্ত-মাংস-অস্থিমজ্জায় আমি তোমাদেরই লোক। তাইতো তাঁর সরল উচ্চারন ‘ভাইয়েরা আমার’। এরপর অত্যন্ত শান্ত গলায় জনগনের প্রতি বঙ্গবন্ধু তাঁর অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেন এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়েই তিনি প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করবেন মর্মে প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। লাখো জনতার দরবারে একে একে শুধালেন তিনি কি চান আর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কি করছে? তুলে ধরেন পাকিস্তান সরকারের শোষণ-বঞ্চনার নিষ্ঠুর ইতিহাস।


পরিস্কারভাবে আভাস দিলেন ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্রের কথা। সংখ্যগরিষ্ঠ হয়েও যদি কেউ যুক্তি দিয়ে কথা বলে তাহলেও তা মানার ঔদার্য তাকে উপস্থিত জনসভায় তো বটেই বিশ্ব দরবারের একজন মানবতাবাদী গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে অন্যন্য এক উচ্চতায় আসীন করেছে। তাছাড়া ভাষণের এক পর্যায়ে জনসম্মুখে ভুট্টোর চরিত্র ফাঁস করে দিলেন বঙ্গবন্ধু। জনগনের নিকট বিচারের দ্বায়ভার অর্পণ করে তিনি ভাষণে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য ভুট্টো-ইয়াহিয়া এদেশের সহজ সরল মানুষকে এমনকি তাকে সরাসরি তাঁকে দোষারোপ করছে তা-ও ব্যাখ্যা করেন।


কিভাবে এদেশের জনগনের সাথে বেইমানী করা হয়েছে ভাষণে সেই বঞ্চনা, প্রতারণা, উপেক্ষা আর দোষারোপের ষড়যন্ত্র আরেকটু বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু যাতে জনগণের ভিতর আবেগ উৎসারিত হয় এবং দেশপ্রেমে ব্রতী হয়। ভাষণের মাঝামাঝি তিনি আবির্ভূত হলেন শোষিত বাংলার সাধারণ মানুষের ত্রাতার ভুমিকায়। মহানায়কের মতো বলিষ্ঠ অবয়বে দাঁড়িয়ে বজ্রকন্ঠে পাকিস্তানী সামরিক সরকারের নিকট পূর্ব বাংলার জনগণের দাবীসমূহ ইস্পাত কঠিন ভাষায় পেশ করতে লাগলেন। বঙ্গবন্ধু এসময় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে প্রবঞ্চক পাকিস্তানি সরকার কি কি সমস্যা তৈরী করতে পারে সেই ব্যাপারেও জনগণ কে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন।


দীর্ঘ সংগ্রামের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে আর সময় নেননি এ মুক্তিকামী মহানায়ক। ডাক দিলেন মুক্তিযুদ্ধের। বলেই ফেললেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ এবং সরাসরি শত্রু হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আখ্যায়িত করতেও ছাড়েননি তিনি। সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’কেননা, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না’। জীবনের ঝুঁকি থাকলেও সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর দায়িত্ব নিতে ভোলেননি তিনি। নিজের হাতেই তুলে নিলেন শাসনভার। নির্দেশ দিলেন সকল সরকারি কর্মচারী, ব্যাংক কর্মীদের করণীয় সম্পর্কে। ভাষণে এক বাক্যে তিনি তাঁর আজন্ম অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় তুলে ধরে বলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়’।


বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানী হায়েনারা এমনিতেই ছেড়ে দিবে না। রক্তের বন্যায় রঞ্জিত হবে বাংলা। তবুও এটাই সময় যুদ্ধের যাবার। তাই সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করে বাঙালীকে সেই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে তাঁর আশার বাণী, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাহল্লাহ’। শেষের বাক্যদু’টি যেন জ্বলন্ত বারুদ! বঙ্গবন্ধু অবহেলিত বাংলার ভাগ্য নিয়ে যারা খেলা করছে তাদের সকল জল্পনা কল্পনাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাঁর অন্তরের লালিত স্বপ্নের সফল পরিনতির কথা ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। যা কিনা আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ ভূখন্ডের আপামর জনগণের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়।


বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ সর্বকালে সমসাময়িক। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে নবীন প্রজন্ম, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাষ্ট্রনায়ক, সমরকুশলী সবার জন্যই এ ভাষণে রয়েছে অনেক কিছু শিক্ষণীয়। ৭ই মার্চের ভাষণ একটি জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টির মহাকাব্য। বহুমাত্রিকতায় এ ভাষণ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ মহাকাব্য বাঙ্গালীর হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। ইতোমধ্যে ভাষণটি বিশ্বজুড়ে মহামুল্যবান শিল্পে পরিণত হয়ে আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে আর কোনো অপশক্তিই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। এ ভাষণ আমাদের মুক্তির মন্ত্র, সংগ্রামের চেতনা, আত্মত্যাগের প্রেরণা।


লেখক: ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


বিবার্তা/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com