জাতিসংঘের ঘোষণা অনুসারে প্রতি বছর ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালিত হয়। এদিন বিশেষভাবে আদিবাসীদের নিয়ে অনেক কথা হয়, তাদের আশা-আকাঙক্ষার কথা বলা হয়, অনেক আশ্বাস দেয়া হয়। তবে দিন শেষে আদিবাসী মানুষেরা আসলেই কী ভাল আছে? প্রায় সব দেশেই ভোটের রাজনীতিতে আদিবাসীরা বিশেষভাবে বিবেচ্য হয় বটে, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তাদের নিয়ে কেউ আর তেমন একটা ভাবে না। তাদের চিরাচরিত জীবনে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না।
বাংলাদেশে, ‘আদিবাসী’ শব্দটি নিয়ে অনেক দ্বিমত রয়েছে। সেটি কৌশলগতও হতে পারে, আবার ভাবনার দৃষ্টিকোণের ভিন্নতার দিক থেকেও হতে পারে। সে যাই হোক, বাস্তবতা হলো একই জাতি বিশ্বের কোথাও আদিবাসী আবার কোথাওবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে। তাই আমি এ বিতর্ক এড়িয়ে যাচ্ছি।
এবার মূল কথায় আসি, “আমরা খেলার মাঠে বসে থাকতে পারি না। স্বাধীন রাষ্ট্রে বাস করেও মেয়েরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমাদের কী স্বাধীনতা নেই? স্বাধীন দেশে যদি নারীরা স্বাধীনতা না পায় তাহলে থাকবে কোথায়? পরিবার, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব জায়গায় প্রতিনিয়তই নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু আমি কোনো বিচার পাইনি। কেন বিচার পাইনি সে প্রশ্নের উত্তরও কী পাবো না?” কথাগুলো বিচিত্রা তির্কী’র (৩৭)।
তিনি ২০১৮ খ্রীষ্টাব্দের ১১ মে রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘যৌন সন্ত্রাস বিরোধী গণ কনভেনশন’ তার ক্ষোভ উগরে অসংকোচে কথাগুলো বলেছিলেন। তিনি বর্তমানে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার সভাপতি। জাতিগতভাবে তিনি ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষ। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ খ্রীষ্টাব্দের ০৪ আগস্ট। সেদিন জনসম্মুখে বিচিত্রা তির্কীকে গণধর্ষণ করা হয়। প্রাণের ভয়ে নরপিশাচদের এমন পৈশাচিক হিংস্রতা দেখেও সেদিন কেউ এগিয়ে আসেনি। পরবর্তীতে তিনি দিনের পর দিন বিচারের জন্য ঘুরেছেন, কিন্তু বিচার পাননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “ধর্ষণের বিচার যদি হতো, তাহলে আর কোনো মা-বোনকে ধর্ষণের শিকার হতে হতো না”। কতদিন পেরিয়ে গেছে। এখনও তাকে দেখে সেই নরপিশাচরা বাঁকা হাসি হাসে! তবুও, স্যালুট জানাই বিচিত্রা তির্কী’কে, কারণ তিনি দুঃসময় অতিক্রম করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছেন।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী ধর্ষণ ও অত্যাচার-নিপীড়নের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। খবরের কাগজে চোখ রাখলেই দেখা যায় হরহামেশায় এসব ঘনটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ভুক্তভোগীরা দিনের পর দিন বিচারের আশায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে নিরব হয়ে যায়। মনের কষ্ট মনে পুষে নিয়েই জীবন যাপন করছে।
সম্প্রতি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো দেখে নেওয়া যাক। এক. ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি সকালে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের হাবিবপুর গ্রামে (চিড়াকুটা) জমি-জমার বিরোধকে কেন্দ্র করে শত শত লোক সাঁওতাল গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, তাদের গরু-ছাগল, হাড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে সব কিছু লুট করে। এখানেই থেমে ছিল না, সুযোগ বুঝে তারা মহিলা, যুবতী ও উঠতি বয়সী মেয়েদের শ্লীলতাহানি করে। জমি-জমার বিরোধ না হয় ছিল একটি পরিবারের সাথে, তাহলে পুরো গ্রামের মানুষের কী দোষ ছিল? নারীরা কী দোষ করেছিল যে, তাদের সম্ভ্রম নিয়ে খেলতে হবে?
দুই. ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দের ২১ মে সন্ধ্যায় রাজধানীতে ২১ বছর বয়সী এক গারো নারী ডিউটি শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কের উল্টো দিকে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। তখন হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে তার সামনে থামে এবং দুই যুবক তাকে জোর করে গাড়িতে তোলে। গাড়ির ভেতরে আরো তিনজন ছিল। তারা পাঁচজন মিলে চলন্ত গাড়িতে তরুণীকে গণধর্ষণ করে। এই দুটো ঘটনা সারা দেশে এমনি দেশের বাইরে অনেক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
তিন. গত কয়েক বছর আগে একটি স্কুলে ওঁরাও মেয়ের সাথে একটি বাঙালি ছেলের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ৯ আগষ্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে পরে ছেলেটি তাকে নানাভাবে ফসলিয়ে গভীর সম্পর্কে জড়ায়। পরে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সেটি ধামাচাপা দেওয়া হয়। ছেলের পরিবারও নানাভাবে হুমকী দিতে থাকে। ফলে, মেয়েটির পরিবার মেয়ের ভবিষ্যত ও পরিবারের বিপদের কথা ভেবে সরে আসতে বাধ্য হয়।
চার. ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি রাঙামাটির বিলাইছড়ির দুই মারমা তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। একই বছরের ১৩ এপ্রিল বান্দরবানের আলীকদমে এক ত্রিপুরা কিশোরীকে গণধর্ষণ ও হত্যা করা হয়। সিএইচটি কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, শুধুমাত্র ২০১৮ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম ৬ মাসেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মতো ১৫টি ঘটনা ঘটেছে।
পাঁচ. মূলত সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা অন্যের জমিতে কাজ করতে যায়। অনেকে দিনমজুর হিসেবেও কাজ করে। গত বছরের ঘটনা: সোহাগী লাকড়া (ছদ্মনাম) তার মজুরী না পাওয়ায় পরের দিন গেরস্তের বাড়িতে যায়। সেদিন লোকটির বাড়িতে কেউ ছিল না। এই সুযোগে লোকটি মহিলাকে ঘরের মধ্যে বেঁধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় মামলা হয়; কিন্তু প্রভাব প্রতিপত্তি ও টাকা-পয়সার জোরে লোকটি অনায়াসেই সেই জাল থেকে বেরিয়ে আসে। এখন সে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, দম্ভভরে হাঁটা-চলা করে। আদিবাসী নারীটি নিজের সম্ভ্রম, সম্মান, মর্যাদা, অর্থ সবই হারালো। কিন্তু ধর্ষকের কিছুই হল না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা সংখ্যালঘু মানুষেরা প্রতিনিয়ই নানাভাবে হেনস্থা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। জানা অজানা কতো ঘটনা যে ঘটে যাচ্ছে তার হিসেব নেই। কারণ বিচারহীনতা। পেশীর শক্তির জোর ও অর্থের ঝনঝনানীতে অপরাধীরা দিনের পর দিন পার পেয়ে যাচ্ছে; আর সংখ্যালঘু মানুষেরা বছরের পর বছর এভাবে বলি হয়ে চলেছে।
ধর্ষণের ঘটনা থেমে নেই কেন? ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের সাথেই কি এগুলো বেশি ঘটে? এ প্রসঙ্গে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘ আদিবাসী (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী) মানুষ মূলত সরল প্রকৃতির হয়। বৃহত্তর সমাজে চলতে গিয়ে অনেকের সাথে তাদের ভাল বন্ধুত্ব হয়। বর্তমানে ফেসবুক, মোবাইলের মাধ্যমেও অনেকের সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু তাদের সেই সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে নানাভাবে হেনস্থা করে এবং যৌন হয়রানি করে। অনেক সময় হয়রানীর শিকার হওয়ার পরও সম্মান হারানোর ভয়ে নারীরা কারও কাছে কিছু বলতে পারে না। এছাড়াও আরো বড় বিপদের ভয়ে চুপ করে থাকে। ফলস্বরূপ পরবর্তীতে তারা আবার নানাভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়। তাই এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যে সমাজের পুরুষদের দায়িত্ব নিতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। পাশাপাশি, সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখতে হবে।”
প্রতি বছর ৯ আগষ্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন করা হয়। এ বছরের মূলসুর নেওয়া হয়েছে ‘করোনাভাইরাস মহামারীতে আদিবাসীদের জীবন জীবিকার সংগ্রাম’। মূলসুরটি বাস্তবসম্মত। কেননা, সারা বিশ্বের মূল-স্রোতের জনগোষ্ঠীর মতো আদিবাসীরাও করোনাভাইরাসের সাথে সংগ্রামরত; এমনকি তারা আরও বেশি সংকটের মুখে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষর অবস্থাও অনেকটা তেমনই; তাদের জীবন জীবিকা এখনও কৃষিনির্ভর হলেও একটি বড় অংশ এখন গার্মেন্টস্, ফ্যাক্টরি ও বিভিন্ন ধরণের কায়িক শ্রম নির্ভর জীবিকায় যুক্ত হয়েছে। তাই এই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তারা বেকার হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, কৃষিজমি না থাকা এবং দীর্ঘদিন কৃষিজমিতে কাজের অনভ্যস্থতার কারণে তারা বেশ বিপাকে পড়েছে। অন্যদিকে, ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ বন্যা পরিস্থিতি মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিসহ করে তুলেছে। তাই চলমান পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের জন্যও বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।
প্রকৃতির বৈচিত্র্যতার পাশাপাশি, জাতি-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যতার বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক চেতনা বহুকাল ধরে বিরাজমান। সেই চেতনা লালন করে সকলে একটি শান্তিপূর্ণ ও অসাম্প্রদায়িক ৯ আগষ্ট বিশ্বি আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ গড়ে তুলবে এই স্বপ্ন আমাদের সকলের। কেননা বৈচিত্র্যতার মধ্যেই তো প্রতিটি সৌন্দর্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। কিন্তু কোন অসুন্দর ঘটনাই যেন আমাদের বিচিত্রা তির্কী’কে বারবার স্মরণ করিয়ে না দেয়; কেননা বিচিত্রা তির্কী’রা বার বার আমাদের ক্যানভাসে লজ্জ্বার প্রতিবিম্ব হয়ে ফিরে আসুক তা আমরা কখনই চাই না।
লেখক : ধর্ম যাজক, সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারস্ চার্চ, ফৈলজানা, চাটমোহর, পাবনা
বিবার্তা/উজ্জ্বল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]