শিরোনাম
নব্য রাজাকারেরা আবার নড়ে চড়ে উঠছে
প্রকাশ : ১২ জুন ২০২০, ২১:৩৫
নব্য রাজাকারেরা আবার নড়ে চড়ে উঠছে
শাহীন রেজা নূর
প্রিন্ট অ-অ+

ঝোপ বুঝে কোপ মারাটাই এখন ওদের একমাত্র কাজ। ডেডলি করোনা ভাইরাসের ক্রুদ্ধ ছোবলে ছোবলে যখন দেশের সকলেই দিশেহারা ঠিক তখনই একে বিশেষ মওকা সমঝে নব্য রাজাকারেরা আবার সরকার বিরোধী মিথ্যা ও অলীক সব প্রচার প্রচারণায় মেতে উঠেছে। একাত্তরের রাজাকারদের অনেকেই এখন আর শারীরিকভাবে বেঁচে নেই বটে, তবে তাদের সেই পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক নব্য রাজাকারেরা কিন্তু ময়দান সরগরম করে তুলতে সদা তৎপর!


করোনা মোকাবেলায় সরকারকে স্বাভাবিকভাবেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আর এ শুধু বাংলাদেশ সরকারের বেলাতেই প্রযোজ্য নয়, বলতে গেলে তাবৎ বিশ্বের দেশে দেশে সরকারগুলির অবস্থাও তথৈবচ! বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী দেশ আমেরিকা আর ইউরোপের সব জায়গানটিক ও অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী দেশসমূহ, যেমন : ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, স্পেন, ইতালি সকলেরই কুপোকাত হবার দশা!


সে যাই হোক, বিএনপি'র নেতা মির্জা ফখরুল, রিজভী প্রমুখ প্রায়শ:ই করোনা প্রশ্নে সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে পা বাড়িয়ে ঝগড়া করার নীতি অবলম্বন করে চলেছেন। এই ভাইরাস মোকাবেলার ব্যাপারে তাদের জনগণের আশে-পাশে দেখা যায়না, অথচ সরকারের তুখোড় সমালোচনা করতে এরা সিদ্ধহস্ত এবং সর্বক্ষণ তৎপর। মালোচনা নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অগ্রগতির সহায়ক যদি তা ধ্বংসাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণ না হয়ে গঠনমূলক হয়। কিন্ত, বাংলাদেশে মতলবী স্বার্থে মিথ্যা, গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টাই হয় কেবল! সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাড়াটিয়া চরদের নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে দেদারসে চলে এই কর্মকাণ্ড। আর এদের যারা মেন্টর তারা দূর দেশে বসে কলকাঠি নাড়ে।


বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকালে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের ভূমিকা আমাদের প্রতি কি পরিমান বৈরিতাপূর্ণ ছিল তা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই বিস্তারিতভাবে জানা নেই। তবে তাদেরও এ বিষয়টি জেনে রাখা ও বোঝা দরকার যে, এখনও সেই সব দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচার ও কর্ম-তৎপরতা মাঝে মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়!


এই দুর্বিষহ করোনা পরিস্থিতিতে ইদানিং সেই পুরাতন ট্র্যাডিশন মোতাবেক খুবই সযত্নে প্রচার করা হচ্ছে যে, ভারত বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা যে তেইশ বছর ছিলাম তখন প্রতিটি সামরিক-বেসামরিক সরকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শামিল অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ারদী, শেখ মুজিবুর রহমান সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ভারতের চর বলে অভিহিত করে এসেছে। ছয় দফা এদের কাছে কখনও ছিল 'সিআইএ'র' দলিল কখনো আবার 'ভারতের চক্রান্ত'। আমাদের স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন সবই ওদের চোখে ছিল ভারতীয় ষড়যন্ত্রের নামান্তর। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিন মাসের মাথায় অর্থাৎ, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের দিন ভারতীয় সেনা বাংলাদেশের মাটি থেকে প্রত্যাহার করা হয়।


অথচ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানপন্থীরা একনাগাড়ে ও ঢালাওভাবে প্রচার করে এসেছিল যে, যুদ্ধের পরে ভারত বাংলাদেশকে দখল করে নেবে। আর বিএনপি নেত্রী ও নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়াতো হরহামেশাই বলে এসেছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতীয় পতাকা উড়বে ইত্যাদি কত্ত সব গাঁজাখোরী কথা! এর সব কিছুই মিথ্যা প্রমাণিত হলেও বিএনপি-জামাত ও তাদের এদেশী ও বিদেশী প্রভুরা কিন্ত সেই ট্র্যাডিশনই বজায় রেখেছে সমান তালে। ইদানিং তারই আলামত ও নিদর্শন দেখা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মোদ্দাকথা, মিথ্যার ফাঁদ পেতে এই উপায়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে শেখ হাসিনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চলছে আবার!


উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার এক যুগব্যাপী শাসন আমলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বিশেষ উচ্চতায় পৌঁচেছে আর তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে দেশের উগ্রবাদী ও জঙ্গি অপশক্তিকে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আর এক্ষেত্রে ভারত তার নিজের নিরাপত্তার প্রয়োজনে বর্তমান সরকারকে সকল ফ্রন্টেই সম্ভাব্য সব রকম সহযোগিতা প্রদান করছে বলে উভয় দেশের ওয়াকিবহাল ও অভিজ্ঞমহল বার বার জানিয়েছেন। তবে জঙ্গি দমনে হাসিনা সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি ও এক্ষেত্রে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টি যে উগ্রপন্থীদের চক্ষুশূল সে কথাতো বলাই বাহুল্য!


খালেদা জিয়ার আমলে বাংলাদেশ ভারতীয় চরমপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল সরকারি যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএস আই এবং বিএনপি-জামাত সরকারের পূর্ণ মদদে তখন বাংলাদেশকে প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশে ও ভারতে সন্ত্রাসী ও সহিংস তৎপরতা চালিয়ে গেছে তারা। এইসব অপতৎপরতা বন্ধের জন্য ভারতের তরফ থেকে তদানীন্তন বিএনপি-জামাত সরকারকে বার বার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও তারা তা বন্ধ করেনি বরং ভারত এই অজুহাতে তখন বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ না করে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে বাংলাদেশ সরকারের শুভবুদ্ধির উদয়ের আশায়।


অতঃপর, হাসিনা সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই ভারত বিরোধী কর্মকাণ্ড সফলতার সঙ্গে বন্ধ করা হয় ও বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভকারী ভারতীয় জঙ্গিদেরকে ভারতের নিকট হস্তান্তর ও পবিত্র ধর্ম ইসলামের নাম ভাঙ্গানো ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দমন করা হয়।


ভারত, রাশিয়া, ভুটানসহ আরো কিছু দেশ আছে যারা কিনা একাত্তরের দুঃসময়ের পরীক্ষিত বন্ধু আমাদের। যুক্তরাষ্ট্র, চীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও স্বাধীনতার পর এদের সঙ্গেও আমাদের নানাবিধ বাণিজ্যিক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চীন সামরিক ক্ষেত্র ছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমান ঋণ দিয়েছে। চীনের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্টের কাজও চলছে। ভারত এই জাতীয় সাহায্যের ব্যাপারে কোনো বাঁধ সেধেছে এমন তথ্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মহলে খোঁজ-খবর নিয়ে পাওয়া যায়নি। চীন বাংলাদেশে ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ( টাকার হিসেবে ৩,২২,২৯৬ কোটি) বিনিয়োগ করেছে যার মধ্যে কেবল প্রতিরক্ষা খাতেই হচ্ছে শতকরা ৭২ শতাংশ।


পটুয়াখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াটের থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, পদ্মায় দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও রয়েছে চীনা বিনিয়োগ। তাছাড়া, বাংলাদেশ চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডে'র অংশীদারও বটে। আর এক্ষেত্রে ভারতের তরফ থেকে কোনো ওজর-আপত্তি উঠেছে এমন কোনো প্রমান নেই।


২০০২ সালে বিএনপি আমলে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল কিন্ত তখনও সে চুক্তির ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি ওঠেনি কিংবা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এমন অভিযোগও ওঠেনি। অথচ, সেই সময়টাতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা দিচ্ছিলো খালেদা সরকার। এমনকি মেঘালয় সীমান্তের পীরদিয়াহ এলাকায় ১৬ জন বিএসএফ জোয়ানের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারেও ভারত তখন সামরিক ব্যবস্থার পরিবর্তে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করেছিল।


এদিকে, ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে (যা কিনা করোনার প্রাদুর্ভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়) ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আসার কথা উঠতেই ভারত বিরোধী পাকিস্তানী ও চীনা মহল থেকে এই প্রচার চালাতে দেখা যায় যে, মোদির এই সফরের (নাকি) উদ্দেশ্যই হচ্ছে 'বাংলাদেশের উপর ভারতীয় সামরিক নিয়ন্ত্রণ অধিকতর জোরদার করা'।


উল্লেখ্য, বিগত ২০১৬ তে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ও ভারত বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলারের ঋণ প্রদান করে। এই ঋণের আওতায় ভারত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রতিরক্ষা পরিকাঠামোটি ব্যবহারের মাধ্যমে নেপাল, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সন্ত্রাস দমন বিষয়ে যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ লাভ করে থাকে। অথচ, ভারত ও বাংলাদেশ-বিদ্বেষীরা এই ব্যবস্থাকে 'বাংলাদেশের উপর ভারতের সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ' বলে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে আসছে।


এ প্রসঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানানো হয়েছে যে, ইতোপূর্বে শ্রীলংকা, ভুটান ও মালদ্বীপের সরকারগুলির অনুরোধে ভারত বিচ্ছিন্নবাদীদের দমনে সহযোগিতার জন্য সৈন্য পাঠিয়েছে, কিন্ত কাজ শেষ হবার পর ভারতীয় সেনারা এক দিনও সে সব দেশে অবস্থান করেনি। কারণ, 'ভারত জোরপূবক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা আধিপত্যবাদে বিশ্বাস করেনা'। এ প্রসঙ্গে ঐ সূত্র আরো জানায় যে, 'মনে রাখতে হবে যে, এর পররাষ্ট্র নীতি ভঙ্গিটাই গড়ে উঠেছে সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে। সুতরাং, বাংলাদেশে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বলে যে অভিযপ্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা সর্বৈব বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্য প্রনোদিত'।


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com