শিরোনাম
নভেল করোনাভাইরাস ও শেখ হাসিনার শত্রু-মিত্র
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২০, ১৮:৫৩
নভেল করোনাভাইরাস ও শেখ হাসিনার শত্রু-মিত্র
মুহাম্মদ সামাদ
প্রিন্ট অ-অ+

নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবীর মানুষ আজ দুর্বিষহ মানবিক সংকটে নিপতিত। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রনায়ক পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করে চলেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জ্ঞানী-গুণী-বিজ্ঞানীরা এই ভয়াবহ সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে এক বৈশ্বিক যৌথতা অবলম্বন করে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রসমূহ, জাতিসংঘ, বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট, বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে খ্যাতিমান অভিনেতা-খেলোয়াড়সহ সকলে মিলে নভেল করোনার চিকিৎসা, ভ্যাক্সিন উদ্ভাবন ও ওষুধ তৈরির জন্যে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন। অসহায় মানুষ দুই হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে সংকট থেকে মুক্তির জন্যে অশ্রুসজল প্রার্থনা জানিয়ে চলেছেন।


ব্রিটেনের বর্ষীয়ান রানী এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘এবার আমরা সবার চেষ্টায় বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে এক হয়েছি। আমরা সবাই মিলে সফল হবো। এই সফলতার দাবিদার হবেন সবাই।’ এই ঐক্যমত্য ও উদ্যোগ আমাদের জীবনে এক অনন্য সৌভাগ্য।


সকল দেশের মানুষের হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আমরাও কোয়ারেন্টাইন বা ঘরবন্দী জীবনযাপন করছি। পৃথিবীব্যাপী করোনার আতঙ্ক, সংক্রমণ ও মৃত্যুর খবরে অসহায় বোধ করছি। আবার ভ্যাক্সিন-ওষুধ আবিষ্কারের অগ্রগতিতে আশান্বিত হচ্ছি। প্রতিদিনই বন্ধু-স্বজনদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। এসবের বাইরে অনলাইনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু ফুটেজ, ডকুমেন্টারি ও দলিলপত্র দেখেছি। আবুল ফজল আল্লামির আইন-ই-আকবরী পড়ে শেষ করেছি।


বলা বাহুল্য, সম্রাট আকবরের বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য শাসনে জ্ঞানী-গুণী-কবি-দার্শনিকদের পরামর্শের কদর ও আল্লামির বিশ্লেষণ আজও যে কতো প্রাসঙ্গিক তা কল্পনা করা যায় না। অতঃপর, মানবজাতির ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি রচিত জুভেল হারারির বিখ্যাত বই সেপিয়েন্স পড়া শুরু করেছি। এসবের মধ্যেই কেউ কেউ আবার করোনা নিয়ে কবিতা লিখছি কিনা জানতে চেয়েছেন। প্রতিমুহূর্তে বুকের ভেতর প্রবল বেদনা অনুভব করলেও করোনা নিয়ে কিছু লিখবো তা আমি ভাবিনি। তবু, পত্র-পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিক পরিস্থিতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-আমলাবর্গ এবং চিকিৎসকসমাজের মধ্যে আন্তঃকলহ; সরকারি ও বিরোধী দলীয় কিছু রাজনৈতিক নেতার অনাকাঙ্খিত মন্তব্য; করোনা নিয়ে বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি বিবৃতি; পত্রিকার কিছু কলাম; খাদ্য সহায়তার চাল-আটা-তেল বিতরণে অনিয়ম; এক দরিদ্র শিশুকন্যা ধর্ষণ; এবং চলতি সপ্তাহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আত্মস্বীকৃত খুনি বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের আকস্মিকভাবে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া ও ঢাকায় রহস্যজনক অবস্থানের পর গ্রেফতার হওয়া ইত্যাদি দেখে-শুনে এই লেখাটি না লিখে আর পারলাম না। করোনাভাইরাসকে উপলক্ষ করে প্রধান বিরোধীদল তাদের নেত্রীকে ছয় মাসের জামিনে মুক্ত করেছে।


এখন তারা নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি করছে। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ আইইডিসিআরের করোনায় আক্রান্ত মানুষ ও মৃতের হিসেবের মধ্যে গরমিলের কথা উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ করোনা সংকটকালে সরকারের কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতার কথা বলছেন। এরা নিশ্চয়ই বিপর্যস্ত মানবসমাজ ও দেশের বিপন্ন-অসহায়দের হিতাকাঙ্খী। অধিকাংশের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু কে যে কার শত্রু আর কার মিত্র তা বোঝা খুবই দুষ্কর। তবু, এসব ঘটনা দেখে এবং কারো-কারোর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস উপলক্ষ হলেও এদের মূল লক্ষ্য হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা।


বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ও চিকিৎসায় সীমিত সামর্থের মধ্যে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে চলেছেন। গত ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় সেদিনই তাৎক্ষণিকভাবে গণভবনে সভা ডেকে মুজিববর্ষের সব অনুষ্ঠান স্থগিত করেন। সেই সভায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা বলেছিলেন, আমার বাবার রাজনীতি ছিলো গরিব-দুঃখী মানুষের জন্যে। ছয় মাসের জন্যে বিদেশে গিয়ে বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বজনদের হারিয়ে আমরা দুইবোন ছয় বছর পর দেশে ফিরেছি। কাজেই মানুষের জীবনকে দুর্দশার মধ্যে ফেলে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব আমরা দুইবোন নেবো না। অতঃপর ২৫ ও ৩১ মার্চ যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে এরং বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ-সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য সেবাসংস্থার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরকারের গৃহীত কার্যক্রম এবং সকলের করণীয় পর্যালোচনা করেন।


এতে মানুষের মধ্যে দেশে করোনার সংক্রমণ এবং সরকারের গৃহীত কার্যক্রমের একটি পরিস্কার চিত্র উঠে আসে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য গোপন না করার জন্যে জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। প্রতিদিনই তিনি সারা দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দীপিত করে চলেছেন। করোনা যুদ্ধের সম্মুখ সারিতে দাঁড়িয়ে সেবাদানকারী নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যে বীরত্বসূচক পুরস্কার ও প্রণোদনা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের সাংবাদিক, সংবাদকর্মী ও সংবাদ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঠিক তথ্য পরিবেশনের অনুরোধ জানিয়ে আসছেন।


ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্বপালনের জন্যে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। যেখানে সৌদি আরব ও ইংল্যান্ডের মতো ধনী দেশের সরকারগুলো বেসরকারী খাতের কর্মীদের বেতনের যথাক্রমে ৬০% এবং ৮০% দেবে আর বাকিটা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা কোস্পানিকে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্যে আপদকালীন শতভাগ বেতনের জন্যে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। সব মিলিয়ে করোনাকালে দেশের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করেছেন। ভর্তুকি বাবদ আগামী বাজেটে নয়শ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এভাবে কৃষিতে অর্থের যোগান বাড়িয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের কাছে বীজ-সার-কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করার যাবতীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। করোনা পরবতী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে তিন বছরের পরিকল্পনা তৈরি করছেন। এমনকি এই ঘোরতর দুর্দিনে বিভিন্ন ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থার আর্থিক সহায়তা লাভে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক মিলিয়ে, দিনে ২ হাজার ২২৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়। করোনার মৃত্যুহার সারা পৃথিবীতে কম হলেও এর সংক্রমণ মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রেই খুবই বিপজ্জনক। তাই, করোনা ভাইরাসের আক্রমণে কোয়ারেন্টাইনের শুরুতে এবং লকডাউনের সময় আমার প্রধান উদ্বেগ ও দুঃশ্চিন্তা ছিলো গরিব-অসহায় মানুষের ক্ষুধা বা খাদ্যের কষ্ট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক আহ্বানে সকল স্তরের প্রশাসনযন্ত্র, সেবাসংস্থাসমূহ, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিবর্গ গরিব-অসহায় মানুষের জন্যে বাড়ি-ঘরে, মসজিদে-উপাসনালয়ে, হাটে-বাজারে ও পথে-ঘাটে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে চলেছেন। এতে অনেকের মতো আমিও এক ধরনের স্বস্তির মধ্যে রয়েছি। কারণ, কোয়ারেন্টাইন ও লকডাউনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় ১৯৭৪ সালের কৃত্রিম খাদ্য সংকটের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আমাকে আতঙ্কিত করে ফেলেছিলো। আমি আতঙ্কিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, অনাহারে মানুষের মৃত্যু হলে সেটা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর শত্রুরা আবারো হইচই বাঁধিয়ে ঘোলাজলে মাছ শিকারে লিপ্ত হতে পারে।


১৯৪৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর শত্রুরা নানা নামে, নানা মোড়কে, নানা পোশাকে, দেশে-বিদেশে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সব সময় তৎপর রয়েছে। তারাই শেখ হাসিনার সদা-সক্রিয় শত্রু। উল্লেখ্য, এ কথা আমি শেখ রেহানা সম্পাদিত নবপর্যায়ে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা-এর প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলাম। এখনও বলি, শেখ হাসিনার নেতৃরূপ আজ কোমলে-কঠোরে উদ্ভাসিত। তিনি ডানহাতে পূর্ণ করেন জনতার ভালোবাসার পাত্র আর বামহাতে চূর্ণ করেন শত্রুর মারণাস্ত্র। তাই তো এই করোনা সংকটকালেও বঙ্গবন্ধুর খুনির ফাঁসির রায় তাকে কার্যকর করতে হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শেখ হাসিনার জীবনের ওপর চরম হুমকী না থাকলে তিনি সারা দেশের করোনা উপদ্রুত এলাকায় ঘুরে ঘুরে মায়ের মমতা নিয়ে বিপন্ন মানুষের পাশের দাঁড়াতেন।


অতএব, করোনাভাইরাসকে উপলক্ষ করে ছদ্মবেশী ও মুখচেনা শত্রুদের অপতৎপরতা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি ও শেখ হাসিনার মিত্রদের গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। মোকাবিলার জন্যে সদা-সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। নিজেদেরকে দোষারোপের সময় এটা নয়। অন্যদিকে, আমরা যাতে অতিসংবেদনশীল হয়ে শেখ হাসিনার শত্রুদের হাতে অস্ত্র তুলে না দিই, সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। সারা পৃথিবীর সকলের সঙ্গে মিলে-মিশে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমাদের প্রধান কর্তব্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি শেখ হাসিনা। দেশের কল্যাণে তার নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রনায়কত্ব পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে করোনার মহাসংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে নিশ্চয়ই অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান আমরা সহজে করতে সক্ষম হবো।


লেখক: ড. মুহাম্মদ সামাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com