শিরোনাম
আলেম সমাজের কাছে একজন মুফতির আবেদন
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২০, ০০:১৮
আলেম সমাজের কাছে একজন মুফতির আবেদন
মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
প্রিন্ট অ-অ+

মার্চের আট তারিখ থেকে শুরু আমাদের দেশে করোনার যাত্রা। যতই দিন যাচ্ছে প্রকট হচ্ছে সমস্যা। সংকটের মুখোমুখি পুরো দেশ। অভাবী মানুষ বড় কষ্টে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু চাল চোর তেল চোররা চরম দৌরাত্ম প্রদর্শন করে চলেছে। করোনাকেও তারা ভয় পাচ্ছে না। আল্লাহর গজবের ভয় যাদের অন্তরে নেই তারা কেমন মানুষ আল্লাহই ভালো জানেন। এই চরম সময়েও তাদের চুরি থেমে নেই।


এর ভেতরে ধর্ম নিয়ে বাহাস চলছে। মসজিদে মুসুল্লি সীমিত করা যাবে কি না এ নিয়ে হুজুররা বারবার বসছেন। একশ্রেণীর আলেম সংকটকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন। এসব বিষয় নিয়ে রাজনীতি করতেও তাদের বাধছে না। চাল ডাল তেল চোরদের মত অবস্থা রাজনীতিকদের। সবার উপর নিজের স্বার্থ তাহার উপর নাই। কে বাঁচল কে মরল তা দেখার তাদের প্রয়োজন নেই। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যে আমাদের এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন তা সত্যি মালিকের বড় দয়া ও রহমত। তিনি সাত্তার ও গাফফার। রাহিম ও কারিম।


ভাবছি আমাদের প্রিয় নবী সা. যদি এই করোনাভাইরাসের সময় থাকতেন তাহলে কী করতেন? রাসূল সা. কি সবাইকে নিয়ে মসজিদে যেতেন? সরকারের সাথে এ নিয়ে দেন দরবার করতেন? রাজনীতিক আলেমরাই ভালো বলতে পারবেন।


আমরা তো দেখি খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূল সা. তিন চার ওয়াক্তের নামাজ কাজা করেছেন। কারণ তখন নামাজ পড়তে গেলে মানুষের প্রাণের শঙ্কা ছিল। যুদ্ধ অবস্থায় ছিল মদীনার মানুষ। সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে চার ওয়াক্ত নামাজ একসাথে আদায় করেছেন রাসূল সা.। নামাজ কাজা করার নজীর রাসূল সা. আমাদের সামনে রেখে গেছেন। প্রয়োজনে ইসলামে কত বেশি অবকাশ দেয়া হয়েছে। মক্কার কাফেরদের সাথে যুদ্ধের মতই ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ। সেই শত্রুকে চোখে দেখা যেত এ কে তো দেখাও যায় না। করোনা ভাইরাস মুকাবিলা তাই কোনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। যা খালি চোখে দেখা যায় তা থেকে আত্মরক্ষা তুলনামূলক সহজ। যা চোখেই দেখা যায় না তা থেকে কী ভাবে বাঁচব? এ জন্যই রাসূল সা. বলেছেন সিংহকে যেভাবে ভয় করো ভাইরাসকেও সেভাবে ভয় করে চলো।


সাহাবিদের যুগে ১৮ হিজরি সনে আমওয়াস নামে মহামারি হয়েছিল। বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ ও মুআয ইবন জাবাল সেই মহামারীতে মারা গিয়েছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর মুসলমানদের গভর্নর হন আমর ইবনুল আস। দায়িত্ব পেয়েই তিনি বলেন, এই মহামারি আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে। দলবদ্ধভাবে থাকলে দ্রুত ছড়াতে পারে। আগুন যেমন জ্বালানোর মত কিছু না পেলে দ্রুত নিভে যায় এই ভাইরাসও সংক্রমণের মত কাউকে কাছে না পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যাবে। তাই তোমরা সবাই পাহাড়ে পর্বতে উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়।


হযরত আমর ইবনুল আস সবাইকে আইসোলেশনে চলে যেতে বলেছিলেন। তখনও লকডাউন হয়েছিল। সঙ্গনিরোধ ও অবরুদ্ধতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল তখন। নামাজের জন্য সেই দিনগুলোয় জমায়েত হওয়ার কোনো কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। পাহাড়ে পর্বতে ছড়িয়ে পড়েছিল সবাই। এরপর আরো বহু মহামারি হয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। প্রচুর কিতাব লেখা হয়েছে মহামারি নিয়ে।


ইবন হাজার আসকালানি নিজে বর্ণনা দিয়েছেন তার সময়ের ঘটনার। ৮৩৩ হিজরী সনে মিসরের মহামারিতে যখন মানুষ মরা শুরু হলো লোকজন একত্র হয়ে দুআ কান্নাকাটি করল। তাতে কোনোই সুফল ফলল না। সমবেত হবার আগে মানুষ মরত দিনে চল্লিশজন। জমায়েত হবার পর প্রতিদিন এক হাজার মানুষ মরা আরম্ভ হলো। এসব নজীর আমাদের সামনে আছে। চক্ষুষমানদের উচিত এসব থেকে শিক্ষা নেয়া।


একই রকম অবস্থা বর্ণনা করেছেন ঐতিহাসিক ইবন কাসির। ৭৪৯ হিজরী সনে। সে সময়ে যে মহামারি হয়েছিল সেখানেও মানুষের জমায়েতের ফলে মৃত্যুর মিছিল লেগে গিয়েছিল।


বাজার খোলা রাখা হচ্ছে বলে মসজিদ খোলা রাখতে হবে। এমন হাস্যকর যুক্তি দেয়া হচ্ছে। রাসূল সা. যেসব হাদীসে ঘরে নামাজ পড়ার কথা বলেছেন সেখানে কিন্তু একথা বলেননি যে, দেখ বাজার ঘাটে যাওয়া বন্ধ হলে তারপর তোমরা মসজিদে আসা বন্ধ করো।


বাজারের সাথে মসজিদের তুলনা। মসজিদ ধর্ম পালনের স্থান। এখানে দায়িত্ববোধের ব্যাপার আছে। হাট বাজারে কোনো দায়িত্ববোধের বিষয় নেই। এই সহজ বিষয়টিও বুঝতে পারছে না আমাদের আলেম সমাজ। মাত্র একটি জুমা কোনো রকমে সীমিত পরিসরে আদায় করা সম্ভব হয়েছে। মনে হচ্ছে আগামী জুমা আগের মত সীমিত পরিসরে আদায় করা আর সম্ভব হবে না। প্রিয় নবী সা. বৃষ্টি ও ঠাণ্ডার কারণেও জুমা ও জামাতে না আসার অবকাশ দিয়েছেন। ফিকহের কিতাবে অন্যান্য ওযরের কারণেও জুমার ফরজ রহিত হবার কথা লিখেছেন। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের কিছু অবিবেচক আলেম মানুষকে মসজিদমুখি করার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করে চলেছেন। আরবের আলেমরা সর্বসম্মতভাবে মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে। মক্কা মদীনা সহ আরবের সব মসজিদ দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ। জাযিরাতুল আরবের সবকটি দেশেই এ সিদ্ধান্ত অনুসারে মসজিদ বন্ধ রাখা হয়েছে। আরবের আলেমদের প্রতি অধিক ভক্তি আমাদের নেই। কিন্তু তাদের সম্পর্কে এমন ধারণা রাখাও ঠিক হবে না যে তারা সব ইসলামের শত্রু হয়ে গেছে। অকারণে বাইতুল্লাহ ও মসজিদে নববী বন্ধ করার মত ইসলাম দুশমন তারা নয়। তারা ইসলামের সাথে শত্রুতা করে নয় বরং বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই মসজিদ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের দেশেও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে আমাদেরকে। যতদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় ততদিন ঘরে নামাজ পড়াই শ্রেয়। ইসলামী শরিয়ার দৃষ্টি থেকেই। আমাদের মনে রাখতে হবে সব ধর্ম কর্ম মানুষের জন্যই। মানুষ যদি বেঁচে না থাকে তাহলে এসব মসজিদ ঘর এমনিতেই বিরাণ হয়ে যাবে। মানুষ বাঁচুক। মসজিদের দরজা আবারো খুলে দেয়া যাবে। যারা এখনো মসজিদ বন্ধের কথা বলছেন তাদের কেউ মসজিদের প্রতি শত্রুতা করে এ ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছে না। ধর্মের শত্রু আছে সন্দেহ নাই কিন্তু এসময় কারোরই ধর্মবিদ্বেষ প্রকাশের মত হীন মানসিকতা নেই। কারো এমন মনন থাকলেও তা ধৈর্তব্যের বাইরে। এদিকে মনোযোগী না হয়ে আমাদের ভাবা উচিত সমাজের মানুষের সমস্যাগুলো দূর করায় কার্যকরী পদক্ষেপ।


এখনো মানুষ করোনাভাইরাসের প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে পারছে না। যত দিন আমাদের অবস্থা ইতালি বা স্পেনের মত না হচ্ছে ততদিন সাধারণ মানুষ এমনই উদাসীন হয়ে থাকবে। এসময় আলেম উলামা ও অন্য শিক্ষিত মহলের উচিত মানুষকে সচেতন করতে সর্বাত্মক প্রয়াস করা। মানুষকে সাবধান না করে যারা অবিবেচক কথা বলবেন জাতি তাদের কখনও ক্ষমা করবে না। আলেমদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। সমগ্র দেশ ও জাতিকে রক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে ভবিষ্যতে নিজেদের আবশ্যকতা প্রমাণ করা। তা না হলে আবর্জনার মত ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া। বাজারি বক্তাদের মত যোগ্য দক্ষ সচেতন বিদগ্ধ আলেমরা অবশ্যই নিজেদের দায়িত্ব জ্ঞানের ব্যাপারে আরো সচেতন হবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।


লেখক: মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ, খতীব, মসজিদে মদীনা, বাড্ডা।


বিাবর্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com