শিরোনাম
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনন্ত অপেক্ষা
প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:২৭
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনন্ত অপেক্ষা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

প্লাস্টিকের সাদা চালের ওপর বৃষ্টির শব্দের ছন্দ ছাড়া অন্য কিছুই শোনা যাচ্ছে না। নেই টেলিভিশন বা সংগীতের শব্দ, নেই শিশুদের কলকাকলি। বিশেষ করে কক্সবাজারের রাস্তায় যানজটের অভিজ্ঞতার পর সেই নীরবতা যেন আরো সরব হয়ে ওঠে। কেবল গাছে লাগানো রুপালি রংয়ের মাইক থেকে আসা আজানের ডাক সেই নীরবতা ভেঙে দেয়।


কুতুপালংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরের উত্তর-পূর্বে ৭ নম্বর ক্যাম্প। প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ৪০,০০০ মানুষের বসবাস। অবশ্য এই সংখ্যা ও আনুমানিক। ঠিক কতসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমার সীমান্তের কাছে এই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। বিভিন্ন ক্যাম্পে ১২ লাখ বা তার চেয়ে বেশি মানুষ থাকতে পারেন।


মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়


গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে শুরু করেন। তবে গত বছরের মতো একসঙ্গে এত মানুষের দেশত্যাগ আগে দেখা যায়নি। সহিংস তাণ্ডবের মুখে কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ৭ লক্ষ নারীপুরুষ মিয়ানমার ত্যাগ করেছেন। কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই।উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এত বড় গণহত্যার দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই।


যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন, ফাতিমা তাঁদেরই একজন। তাঁর বয়স ২। এ বয়সেই তাঁর দুই পুত্রসন্তান রয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালানোর আগে তিনি ৩০ থেকে ৪০ বার ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এক রাতেই সেই অত্যাচার চলেছিল। কতজন পুরুষ কতবার ধর্ষণ করেছিল, তা আর মনেও নেই। ক্ষীণ কণ্ঠে ও শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘নিজের শরীরটা সেখানেই রেখে এসেছি।’’


কুটিরে ঢোকার মুখে কামরায় গালিচার ওপর আমরা বসে আছি। ছোট একটি প্লাস্টিকের মোড়াও রয়েছে। তাঁর স্বামী আলির বয়স ২২ বছর। মিলিশিয়া বাহিনী আগমনের পর প্রাণ বাঁচাতে অনেকের মতো তাঁকেও গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। স্ত্রী, সদ্যজাত সন্তান ও ১৪ মাসের বড় ছেলেকে নিজের বাবা-মা'র কাছে রেখে যেতে হয়েছিল। সে প্রায় এক বছর আগের ঘটনা।


অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী নারীর একই দশা হয়েছিল। কয়েক রাত পরে তাঁরা ফাতিমাকে জঙ্গলে নিয়ে তাঁর শরীর ছিঁড়ে খেয়েছিল। আরো নারী তাদের হাতে বন্দি ছিলেন। আশেপাশের গ্রাম থেকেও আরো নারী ধরে আনা হয়েছিল। দুষ্কৃতকারীরা বারবার তাঁদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেউ তাঁদের আর্তনাদ শুনতে পায়নি। তাঁদের স্বামী বা ভাইরা, যাঁরা তাঁদের বাঁচাতে পারতেন, তাঁরা হয় নিহত অথবা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আলিও তাঁদেরই একজন।


ফাতিমা কোনোক্রমে নিজের গ্রামে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। পথে চিকিৎসার ফলে তাঁর ক্ষতগুলোর কিছুটা নিরাময় হয়েছিল। তা না-হলে রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হতো। সম্ভবত তিনি আর কোনোদিন মা হতে পারবেন না।


শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন ফাতিমা। আন্তর্জাতিক সাহায্যকারী সংগঠনগু্লো আলিকে খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিল। আলি বলেন, স্ত্রীর কাছে থাকতে তাঁর কোনো সমস্যা নেই৷ কারণ, সে তো স্বেচ্ছায় সেটা করেনি।


ধর্ষিতা স্ত্রীদের প্রায়ই ত্যাগ করা হয়


আলি না-করলেও অনেক রোহিঙ্গা তাঁদের ধর্ষিতা স্ত্রীদের সন্তানসহ ত্যাগ করেছেন। মনে কষ্ট নিয়ে স্ত্রীদের সেই পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়।


পশ্চিমা সমাজে বড় হয়ে ওঠা কোনো নারীর পক্ষে রোহিঙ্গা নারীদের অনেক কিছুই অসহ্য ও অচেনা মনে হয়। যেমন, রোহিঙ্গা সংস্কৃতিতে নারীরা বাধ্য না হলে বাসার বাইরে যান না, এমনকি অসহনীয় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি পেরিয়ে গেলেও নয়। রেড ক্রসের কর্মীদের ভাষায় ‘‘কোনো আইন নয়, নিজস্ব ঐতিহ্যের কারণেই তাঁরা এমনটা করেন।’’


ক্যাম্পের মধ্যে নিরাপদ জায়গা


শুধু নারীদের জন্য নির্ধারিত জায়গাগুলোতে কিছু শান্তি পাওয়া যায়। গোটা ক্যাম্পে ১৯টি এমন কুটির গড়ে তোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো সেখানে সক্রিয়। চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকায় কিছু নারী এমন পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ জায়গায় কয়েক ঘণ্টা সময় কাটানোর সাহস দেখান। বিদ্যুৎ সংযোগ চালু থাকলে ফ্যানও চলে। সেখানে চালু টয়লেটও রয়েছে, রয়েছে শিশুদের স্নান করানোর ব্যবস্থা।


টিলার উপর থেকে হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য চোখে পড়ে। অসংখ্য কুটিরের সারি, বাঁশের খুঁটির উপর প্লাস্টিকের ত্রিপলের দেয়াল, কখনো ত্রিপলের ছাদ। সামান্য কয়েকটি কুটিরে টিনের চাল রয়েছে।


আপৎকালীন আশ্রয়


আচমকা সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে যেসব ‘বেআইনি’ ক্যাম্প তৈরি করতে হয়েছিল, ফাতিমা ও আলি সেগুলির মধ্যে একটিতে থাকেন। প্রাথমিক আপৎকালীন আশ্রয়ের জন্য এমন জায়গা উপযুক্ত হতে পারে, দীর্ঘকালীন বাসস্থান হিসেবে নয়।


কিন্তু ফাতিমা ও আলির মনে সেই প্রত্যাশা কাজ করলেও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় নথিপত্র দেবার বা দেশে ফেরানোর কোনো লক্ষণ দেখাচ্ছে না। বৈধ নথিপত্র না থাকায় রোহিঙ্গাদের সরকারিভাবে রাষ্ট্রহীন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের বদান্যতার ওপর তাঁদের নির্ভর করতে হচ্ছে।


ক্যাম্পের মধ্যে তাঁরা আপাতত নিরাপদ, কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ফাতিমাকে অবশ্যই ভাবাচ্ছে। সূত্র : ডয়চে ভেলে


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com