শিরোনাম
রোহিঙ্গারা যেভাবে বাংলাদেশি ভুয়া পাসপোর্ট পায়
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২০:০১
রোহিঙ্গারা যেভাবে বাংলাদেশি ভুয়া পাসপোর্ট পায়
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি গত এপ্রিলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।


প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গারা এই পাসপোর্ট পায় কীভাবে?


মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ভুয়া পরিচয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করার বিষয়টি ডয়চে ভেলেকে খুলে বলেন কক্সবাজারের উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘‘ধরুন, ময়মনসিংহে এক নারীর নাম মরিয়ম। তিনি বাংলাদেশী। তাঁর ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে। ওই আইডি কার্ডটি জোগাড় করা হয়। নাম ঠিকানা, পিতা বা স্বামীর নাম সবই ঠিক থাকে, ছবিও তাঁর। এই একটি ডকুমেন্ট ধরেই আরো প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। এরপর ওই নামেই আরেক রোহিঙ্গা নারীর জন্য পাসপোর্টের আবেদন করা হয়। কেউ ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে গিয়ে ধরা পড়ে, কেউবা অন্য কোনো পর্যায়ে। আর যারা ধরা পড়ে না, তারা পাসপোর্ট পেয়ে যায়।’’


বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেতে রোহিঙ্গাদের কারা সহায়তা করে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অনেক রোহিঙ্গা মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের আরো অনেক দেশে থাকে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশিদের পরিচয় হয়। তাদেরই কেউ কেউ দেশে লোক ধরে এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে। এর বাইরে একটি দালালচক্রও গড়ে উঠেছে।’’


তবে এর সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের একশ্রেণির কর্মচারীর যোগসাজশেরও অভিযোগ আছে। কারণ, তা না থাকলে ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই ধরা পড়ে যাওয়ার কথা। তাছাড়া পুলিশও সহায়তা করে। কারণ, পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট ছাড়া তো পাসপোর্ট হয় না।


তিনি আরো জানান, ‘‘ভাষার কারণে অনেক রোহিঙ্গা ধরা পড়ে যায়। তবে যারা ভাষা রপ্ত করতে পারে, তাদের ধরা কঠিন।’’


জানা গেছে, গত অক্টোবর থেকে কক্সবাজার পুলিশ ও জেলা প্রশাসন বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ৩ শতাধিক রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করেছে।


শুধু কক্সবাজার নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় প্রতিদিন পাসপোর্ট নিতে গিয়ে রোহিঙ্গা আটকের খবর আসে। বগুড়ায় গত ১২ অক্টোবর আটক হয় ইন্দোনেশিয়াপ্রবাসী রোহিঙ্গা আবু সালেহর স্ত্রী হাজেরা বিবি (২২), তার ছেলে ওসমান গণি (৫) ও হাজেরার মা আমেনা খাতুন ওরফে রমিজা (৪৫)। তারা কক্সবাজারের একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকত।


বগুড়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক শাহজাহান কবির জানান, হাজেরা বিবি ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য পাসপোর্ট করার জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। ১২ অক্টোবর বিকেলে তাঁরা অফিসে ফরম জমা দিতে আসেন। এ সময় হাজেরা বিবির কাছে তার নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা জানতে চাইলে অসংলগ্ন আচরণ করে। তখন ফরমসহ হাজেরাকে আটক করে সদর থানা পুলিশে দেয়া হয়। পরে জানা যায়, এরা দালালের মাধ্যমে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া সদর ইউনিয়ন কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন সনদও সংগ্রহ করেছিল।


বগুড়ার সাংবাদিক নাজমুল হুদা নাসিম জানান, ‘‘এই অপপ্রক্রিয়ায় আব্দুল মান্নান নামে এক দালাল জড়িত। তার বাড়ি দুপচাঁচিয়ায়। সে এখন পলাতক। রোহিঙ্গাদের সে-ই জাতীয় পরিচয়পত্র ও অন্যান্য কাগজপত্র জোগাড় করে দেয়।’’


জানা গেছে, দালালরা প্রথমে তাদের মক্কেলের সমবয়সি স্থানীয় বাংলাদেশির আসল জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। এরপর ওই পরিচয়পত্র দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে আসল পরিচয়পত্র, প্রকৃত ব্যক্তির ছবি ও জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে। রোহিঙ্গার আসল পরিচয় তখন গোপন করা হয়।


এরপর তারা পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করে, পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলে। অসাধু কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে তাদের সাহায্য করে। রোহিঙ্গাদের একটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট করে দেয়ার জন্য ৪০-৫০ হাজার টাকা নেয় দালালরা।


সূত্র জানায়, পাসপোর্ট অফিসের যোগসাজশ ছাড়া রোহিঙ্গাদের পক্ষে বাংলাদেশি পরিচয়ে পাসপোর্ট করা অসম্ভব। কারণ, যার জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হয় সেটা আসল, সেখানে যার পরিচয়পত্র তারই ছবি ও নাম-ঠিকানা থাকে। দালালরা বয়সের সঙ্গে মিল রেখে এ ধরনের পরিচয়পত্র জোগাড় করে। আবেদনপত্রে রোহিঙ্গার ছবিই থাকে, তবে নাম, ঠিকানা প্রকৃত পরিচয়পত্রের। একটু খেয়াল করলেই তা ধরতে পারার কথা।


গত মে মাসে নরসিংদীতে পাসপোর্ট করতে আসা চার রোহিঙ্গা নারীকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, তাদের পাসপোর্টের আবেদনপত্রে সত্যায়ন করেন নোটারি পাবলিকের সনদপ্রাপ্ত স্থানীয় আইনজীবী রেজাউল করিম বাসেত। আবেদনপত্রে তার সত্যায়নটি অনেকটা অস্পষ্ট। অস্পষ্ট্তা সত্ত্বেও আবেদনপত্রটি প্রাথমিক যাচাই-বাছাই করেন নরসিংদী আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (এডি) জেবুন্নাহার বেগম।


পুলিশ জানায়, নরসিংদি পাসপোর্ট কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুজন হাওলাদার ও কোষাধ্যক্ষ আরিফুল হক সুমনের সহযোগিতায় রোহিঙ্গা চার নারীর প্রাথমিক আবেদনপত্রে ছবি উঠানো ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়ার অনুমোদন দেন এডি জেবুন্নাহার বেগম।


নরসিংদী সদর মডেল থানার ওসি মো. সৈয়দুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এ নারীরা তাদের কথাবার্তা ও ভাষার কারণে ধরা পড়ে যায়। রায়পুরার একজন দালাল তাদের নিয়ে এসেছিল। পাসপোর্ট অফিসই শেষ পর্যন্ত তাদের ধরে ফেলে। আমরা এখন পার্সপোর্ট অফিসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এ ধরনের আরো কোনো অপচেষ্টা হয় কিনা সে ব্যাপারে নজরদারি করছি।’’


ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এখনো এ ধরনের কোনো ঘটনা পাইনি। ঢাকার বাইরে জেলা পাসপোর্ট অফিসগুলোয় এরকম ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ আছে। আমরা ঢাকায়ও নজরদারি করছি।’’


উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর আগেও সহিংসতা থেকে বাঁচতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। সূত্র : ডয়চে ভেলে


বিবার্তা/হুমায়ুন/সোহান

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com