শিরোনাম
ভেজাল খাদ্যে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৪৬
ভেজাল খাদ্যে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

কাপড়ে ব্যবহৃত রং, কৃত্রিম ফ্লেভার, ঘনচিনি ও স্যাকারিনের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুস এবং জেলিসহ ভেজাল খাদ্য পণ্য। আর এসব পণ্যের প্রধান ভোক্তা হচ্ছে শিশুরা। এতে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।


চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরের একটি কারখানায় গিয়ে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখতে পান, কাপড়ে ব্যবহৃত রং, কৃত্রিম ফ্লেভার, ঘনচিনি ও স্যাকারিনের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের জুস এবং জেলি। কাদের ফুড প্রোডাক্টস নামে ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবদুল কাদেরকে ভেজাল খাবার তৈরির দায়ে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমান আদালত। কিন্তু কারাদণ্ড দেয়ার আগে গত দুই বছর ধরে এ প্রক্রিয়ায় ভেজাল জুস আর জেলি উৎপাদন করেছেন কাদের।


র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, মূলত ঢাকার বস্তি এলাকা বা বাইরের শহরগুলোতে বিক্রির জন্য এ ধরনের ভেজাল পণ্য উৎপাদন করা হয়। আর মূলত শিশুরা এগুলোর ভোক্তা। প্রায়ই এরকম কারখানায় অভিযান চালানো হচ্ছে, কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না এ ভেজাল খাদ্যের ব্যবসা।


আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও গবেষকেরা বলছেন, ভেজাল খাবার খেয়ে শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। তাদের শরীরে এসব উপাদান ‘স্লো পয়জনিং’-এর মতো কাজ করছে। মূলত দুভাবে শিশুরা বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণ করছে।


প্রথমত, শিশুদের পছন্দের খাবার যেমন জুস, চকোলেট, জেলি ইত্যাদিতে নিম্নমানের ও ভেজাল রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ধরণের দেশী-বিদেশী ফল, সব্জিতে অতি মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার, মাছ বা সব্জিতে ফরমালিনের ব্যবহার।


জাতিসংঘ রেডিওর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসেব মতে, ভেজাল বা দূষিত খাবার প্রতিবছর প্রায় চার লাখ কুড়ি হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটাচ্ছে। যাদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হচ্ছে পাঁচ বছরেরও কম বয়সী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক পরিচালক ড. কাযুয়াকি মিযাগিসিমা বলেন, যে পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র নয় শতাংশ হলেও খাদ্য দূষণজনিত মৃত্যুর ত্রিশ শতাংশই তারা।


সম্প্রত ঢাকা শিশু হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় নাহিদা আক্তার ও খোরশেদ আলম দম্পতির সঙ্গে। ১৪ মাস বয়সী একমাত্র ছেলে রোদের জন্মের পরে দ্বিতীয় দফায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। সরকারি চাকুরে খোরশেদ বলেন, চিকিৎসকেরা বলেছেন তাঁদের ছেলে খাবারে বিষক্রিয়ায় শিকার হয়েছে। শিশুটির প্রচণ্ড পেট খারাপের পরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। শিশুটির জন্য তার বাবা-মা দু’রাত ধরে ঘুমান না। পরিবারের সবারই মন খারাপ।



বাংলাদেশের রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কারিগরি উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রচুর পেটের পীড়ার শিশু রোগী পাই যারা সরাসরি ভেজাল খাদ্যের জন্য আক্রান্ত হয়। এর বাইরেও ভেজাল খাবার শিশুদের নানাভাবে ক্ষতি করে। কিন্তু কোনো শিশু শ্বাসতন্ত্র বা কিডনি বৈকল্যের শিকার হয়ে হাসপাতালে গেলে তখনতো আর খাদ্যে ভেজালের বিষয়গুলো সামনে আসে না। তখন শুধু রোগগুলোর চিকিৎসা হয়। আবার খাবারে ক্ষতিকারক রঙের ব্যবহার, কীটনাশক ইত্যাদির কারণে শিশুর কিডনি ও লিভারসহ যেসব জায়গায় বেশি রক্ত চলাচল করে সেসব অঙ্গ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে। এর বাইরে পেটের পীড়া, পেটে ঘা, আলসার, চর্মরোগ ইত্যাদি প্রভাবতো খুব বেশি দেখাই যাচ্ছে।’


শুধু প্রক্রিয়াজাত খাবার নয় সাধারণ শাকসব্জি, মাছেও অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক ও প্রিজারভেটিভ ব্যবহারের প্রমাণ মিলছে।


বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) গবেষণায় সাধারণ শাকসবজি, চিংড়ি ও শুঁটকিতে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের ১২টি জেলার বিভিন্ন বাজার থেকে সংগৃহীত ৪৫৪টি নমুনা পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে গতবছর বারি এই তথ্য জানিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে শুঁটকিতে। গত বছরের মার্চে প্রকাশিত ‘খাদ্যে কীটনাশকের অবশেষ: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক বারির ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এখনই ব্যবস্থা না নিলে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘কীটনাশক একবার শরীরে ঢুকলে তা আর বেরোতে চায় না। জীবনভর ক্ষতি করে যায়। কীটনাশকের উপস্থিতির কারণে অস্থিমজ্জা যা কিনা শরীরে রক্ত তৈরি করে তা-ও কার্যকারিতা হারাতে পারে। দেশে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ খাবারে কীটনাশকের উপস্থিতি। এ ছাড়া গর্ভবতী নারী কীটনাশকযুক্ত খাবার খেলে শারীরিক ও মানসিক বিকারগ্রস্ত শিশুর জন্ম দিতে পারেন।’


কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২০১৩ সালে দিনাজপুরে ১৩টি শিশুর মৃত্যু হয়। তখন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ওই শিশুদের মলমূত্র, রক্ত পরীক্ষা করে জানায় এসব মৃত্যুর কারণ ছিল খাদ্যে ব্যবহৃত কীটনাশক। আইইডিসিআরের গবেষকেরা নিশ্চিত হন যে, বাগান থেকে কীটনাশক দেয়া বিষাক্ত লিচু খেয়ে ওই শিশুরা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।


দু’ বছর পরে আবার একই জেলায় একইরকম ঘটনা ঘটে। গত বছরের ২৯ মে থেকে ১৮ জুনের মধ্যে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। এদের বয়স দেড় থেকে ৬ বছরের মধ্যে। এদেরও মৃত্যুর কারণ ওরা কীটনাশক দেয়া লিচু খেয়েছে বলে পরে জানা যায়।


আইইডিসিআরের তৎকালীন পরিচালক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, ওসব শিশুদের মৃত্যুর কারণ ‘কীটনাশক মিশ্রিত লিচুর সংস্পর্শ’। মৃত শিশুদের রক্ত ও সেখানকার বাগানের লিচু পরীক্ষা করে বিষাক্ত কীটনাশকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ওই শিশুদের বাড়ি ও লিচু বাগান পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে এসব নিশ্চিত হওয়া গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে ওই শিশুদের বাড়ি লিচু বাগান সংলগ্ন।


ওই শিশুদের অভিভাবকেরা বলেছিলেন, শিশুরা বাগান থেকে কুড়িয়ে লিচু খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে।


আইইডিসিআর’র গবেষণায় দেখা গেছে, লিচু বাগানে ২৩ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরেও কিছু অপরিচিত কীটনাশক ব্যবহার করছেন চাষিরা। এছাড়া ‘এন্টি ফাঙ্গাল’, ‘গ্রোথ হরমোন’ নাম দিয়ে আরও কিছু রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে; যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।


যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক কীটনাশকের সঙ্গে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলেও দাবি করেছেন। তাদের দাবি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এমন খামারের পাশে বসবাসকারী গর্ভবতী মায়ের সন্তানের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দুই-তৃতীয়াংশ বেশি। ২০১৪ সালের জুন মাসে ‘এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পারস্পেকটিভ’ সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনটির প্রধান গবেষক ইরভা হার্ত্জ-পিচ্চিওতো বলেন, ‘গবেষণায় অংশ নেয়া মায়েরা তাদের গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন কোথায় বাস করেছিলেন, আমরা তা শনাক্ত করেছি। আমরা দেখতে পেয়েছি, যে মায়েদের সন্তান অটিজমে আক্রান্ত হয়েছে বা তাদের (সন্তান) অবধারণ ও অন্যান্য দক্ষতা বিলম্বিত হয়েছে, তারা এমন এলাকার কাছে বাস করেছেন, যেখানে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে।’


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com