শিরোনাম
উপেক্ষিত শ্রমিক, কর্মক্ষেত্র মৃত্যুকূপ
প্রকাশ : ২৮ এপ্রিল ২০১৮, ২০:৩৭
উপেক্ষিত শ্রমিক, কর্মক্ষেত্র মৃত্যুকূপ
মৌসুমী ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+

সময় কিংবা কর্মঘণ্টা – কোনো কিছুই নির্দিষ্ট নেই, শুধুই নিরন্তর ছুটে চলা। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে কতোটা নিরাপদ শ্রমিক? নিশ্চিত কি হচ্ছে ন্যূনতম জীবনমান? কর্মক্ষেত্রে কঠিন বাস্তবতাকে সঙ্গী করেই চলে জীবনযুদ্ধ। তবুও মেলে না ন্যায্য প্রাপ্তি। অনেক ক্ষেত্রেই নেই সাপ্তাহিক ছুটি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ। অ-প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে দেশের প্রায় ৮৫ ভাগ শ্রমিক, কর্মক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। এরই মধ্যে দরজায় কড়া নাড়ছে ‘মে দিবস’। বহু বছর আগে ওই দিনে কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে শ্রমিকরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।


স্বাধীনতার পর থেকেই কর্মক্ষেত্রে শুরু হয় বঞ্চনা। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে শ্রমিকদের নির্যাতন আর বঞ্চনার কথা। শ্রমিকদের গার্মেন্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে মেইন গেটে তালা মেরে দেয়ার অভিযোগও আছে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে তাদের কাজ করতে হয়। নিয়োগপত্রহীন মজুরি ছাড়া ১৪-১৬ ঘণ্টা ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। শ্রমিক মরছে আগুনে পুড়ে বা পদদলিত হয়ে বা বিল্ডিং ভেঙে- একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। কিন্তু প্রতিকার হচ্ছে কতোটুকু?


কর্মক্ষেত্র মৃত্যুকূপ


গেল পাঁচ বছরে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছে ৪ হাজার ১৫৫ জন শ্রমিক, আর আহত হয়েছে ৭ হাজার ১১২ জন। এর মধ্যে গতবছর কর্মক্ষেত্রে ৭৪৮ জন শ্রমিক নিহত ও ৫১৭ জন আহত হয়েছে। সদ্য শেষ করা এক গবেষণায় এমন তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। গবেষণায় আরো ধরা পড়ে, ২০১৬ সালে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয় ৬৯৯ জন এবং আহত ৭০৩ জন; ২০১৫ সালে নিহত ৩৬৩ জন আর আহতের সংখ্যা ৩৮২ জন। ২০১৪ সালে নিহত হয় ৬০৩ জন আর আহত ৬৮৫ জন এবং ২০১৩ সালে নিহত হয়েছে ১ হাজার ৭০৬ জন ও আহত শ্রমিকের সংখ্যা ৪ হাজার ৮২৫ জন। নিহত ৭৮৪ শ্রমিকের মধ্যে ২১ জন নারী।



কোন খাত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ


পরিবহন এবং নির্মাণখাতই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিলস’র তথ্য অনুযায়ী, পরিবহনখাতে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি ৩০৭ জন শ্রমিক মারা যায়। এছাড়া নির্মাণ খাতে মৃত্যের সংখ্যা ১৩১ জন। অন্যদিকে দিনমজুর ৫৫ জন, কৃষিশ্রমিক ৩৪ জন, ইলেক্ট্রিশিয়ান ২৪ জন, জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ২১ জন, পাথর উত্তোলনে ২১ জন, চাল কলে ২০ জন, মৎস শ্রমিক ১৭ জন এবং গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করতে গিয়ে ১৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে। পাশাপাশি আহত ৫১৭ জন শ্রমিকের মধ্যে সর্বোচ্চ গার্মেন্টস শিল্পে ১৫৮ জন, নির্মাণ কাজে ৯২ জন, দিনমজুর কাজে ৫৪ জন ও পরিবহন খাতে ৪৮ জন শ্রমিক আহত হয়েছে।


বেপরোয়া নির্মাণখাত


ক্রমেই বেপরোয়া হচ্ছে নির্মাণখাত। তদারকির অভাবে বাড়ছে মৃত্যু। ২০১৭ সালে এইখাতে মারা যায় ১৩৪ জন শ্রমিক, আর আহত হয় ৯২ জন। ২০১৬ তে মারা যায় ৮৫ জন, ২০১৫ সালে ৬১ জন। তবে, ২০১৪ সালে প্রাণ হারায় ১০২ জন শ্রমিক। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯৫ জন এবং ২০১২ সালে মারা যায় ১১৩ জন শ্রমিক। অর্থ্যাৎ নির্মাণখাতে দুর্ঘটনা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মৃতের ঘটনা। তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণেই এ অবস্থা বলে মনে করছে বিলস।


দুর্ঘটনার কারণ


কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাও দায়ী। ২০১৭ সালে দেশে ৪১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহত হয়। এছাড়া বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনা ১২৬টি, ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ৫৯টি, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ২৯টি এবং মাটি ধসের ঘটনা ঘটেছে ২৫টি। এছাড়া জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরে সংঘটিত সহিংসতায় ২৫৮ জন নিহত ও ১২০ শ্রমিক আহত হয়েছে। ২৭টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে এবং ২৭ জন শ্রমিক নিখোঁজ হয়। গেল বছর ১৮১টি শিল্প বিরোধের ঘটনার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পে ৯১টি, পরিবহন ক্ষেত্রে ৩৬টি, বিড়িশিল্পে ৭টি, কৃষি খাতে ৬টি, চিনি শিল্প ও নৌ পরিবহন খাতের প্রতিটিতে ৫টি করে বিরোধের ঘটনা ঘটেছে।



শিল্প অসন্তোষের কারণ


শিল্প অসন্তোষের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা। গেল বছরে সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ হয় বকেয়া মজুরির দাবিতে। এছাড়া অধিকার এবং দাবি-দাওয়া, কারখানা বন্ধ, শ্রমিক প্রহার-নির্যাতন, ওভারটাইম এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ চাইতে গিয়ে হয় আন্দোলন। দেখা যায়, দাবি আদায়ে গেল বছরে ৬৮টি বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন হয়েছে ২১টি। আর ধর্মঘট করা হয় ১৮টি, সড়ক অবরোধ ১৫টি এবং সমাবেশ হয়েছে ১২টি। এছাড়া বিক্ষিপ্ত কর্মসূচি ছিল।


বিলস এর নির্বাহী পরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, আট ঘণ্টা কাজের দাবি এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলন হয়, রক্তও ঝরে। কিন্তু সেই দাবি পূরণে এখনো উদাসীন মালিকপক্ষ। শ্রমিকদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রও তেমন উদ্যোগ নেয়নি।


তিনি বলেন, শুধু সমাবেশ, মিছিল করে দিনটি পালন না করে শ্রমিকদের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, শ্রমিকদের অধিকার না দিলে ভালো উৎপাদন সম্ভব নয়।


সাবেক শ্রম সচিব মিকাইল সিপার বলেন, শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে, শিল্পখাতের প্রসারের সঙ্গে তদারকি ব্যবস্থায় তাল মেলানো কঠিন।


বিবার্তা/মৌসুমী/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com