বাংলাদেশে দেশে দিন দিন মরণ নেশা মাদকের চাহিদা ও সরবরাহ বাড়লেও সে হারে বাড়ছে না মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সুযোগ। দেশে অপ্রতুল ও হাতেগোনা সরকারি-বেসরকারি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে বছরে অল্প সংখ্যক মাদকাসক্তের চিকিৎসার সুযোগ মিলছে। যা শতকরা একভাগ তো নয়ই, অর্ধভাগের চেয়েও কম মাত্র।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ড্রাগ হলো এমন বস্তু যা গ্রহণ করলে ব্যক্তির এক বা একাধিক কার্যকলাপের পরিবর্তন ঘটায়। একটা ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ভর করে তার রাসায়নিক গঠন বৈশিষ্ট্যের ওপর। এই ড্রাগ অপব্যবহারের কারণে রোগী তার রোগের জন্য ওষুধের গুণাগুণ পাওয়ার বদলে হয়ে যায় বিষ। তাই অনেক সময় বিষ স্বল্প মাত্রায় প্রয়োগ করলে হয় ওষুধ, কিন্তু বেশি মাত্রা বা অযথা গ্রহণ করলে হয় বিষাক্ত যা শরীরকে নিস্তেজ করে, মৃত্যু ডেকে আনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অপব্যবহারের মাধ্যমে মাদকাসক্তির সূচনা হয়। অপব্যবহার থেকে অভ্যাস, অভ্যাস থেকে আসক্তি। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে আসক্তদের শতকরা ৯০ ভাগকে কিশোর-তরুণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার এবং ৬৫ ভাগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ।
তবে আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতিবছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বর্তমানে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোন তথ্য না থাকলেও বেসরকারীভাবে দেশে ৮০ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
সূত্র মতে, মাদকের অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাওয়া সাড়ে ৯৯ ভাগ মাদকাসক্তই চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভাবে আলোর পথে ফেরার সুযোগ পাচ্ছে না। ভুল বুঝতে পারার পরও চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের অভাবে পরিবার, সমাজ এবং দেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনাগুলো আর স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ নিতে পারছে না। হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। জড়াচ্ছে নানা অপরাধে। দেশে সংঘটিত অপরাধের ৭০ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত।
মাদকাসক্তরা ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, গাঁজা, বিভিন্ন ধরনের মদ, প্যাথেড্রিন, বুপ্রেনরফিন, মরফিন, রিকোডেক্স, বিয়ার, পঁচুই, তাড়ি, ফার্মেন্টড ওয়াশ, টলুইন, সানাগ্রা ট্যাবলেট, বাখার, মুলি, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, ডায়াজিপাম, ঘুমের ট্যাবলেটসহ অন্তত তিন ডজন মাদকে আসক্ত। কিন্তু এই বিশাল মাদকাসক্ত জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে সারা দেশে মাত্র ৬৫ শয্যার চারটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে।
রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাশে অবস্থিত কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটিতে সর্বোচ্চ ৫০ শয্যার (পেয়িং ও নন পেয়িং) কার্যক্রম চলছে। তবে কেন্দ্রীয় নিরাময় কেন্দ্রে ২৫০ শয্যার কার্যক্রম চালুর কথা রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগীয় শহরে মাত্র পাঁচ শয্যার তিনটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র (পেয়িং ও নন পেয়িং) রয়েছে। এর বাইরে কুমিল্লা, যশোর ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালগুলোকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আবাসিক সার্জন ও মনোচিকিৎসক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, মাদকাসক্তদের অনেকেই আসক্তির পর ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু নেশায় ব্যাপক আসক্তির কারণে তারা ইচ্ছা করলেই ফিরতে পারে না। তবে চিকিৎসা পেলে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। কিন্তু দেশে মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন অপ্রতুল হওয়ায় অল্প কিছু লোকই সে সুবিধা পাচ্ছে। ফলে মাদকের ক্ষতি থেকে সিংহভাগ মাদকাসক্তকেই রক্ষা করা যাচ্ছে না।
জানা যায়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০-এর ১৫, ১৬ ও ৪৮ ধারা এবং একই আইনের আওতায় প্রণীত ‘বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তি পরামর্শ কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা বিধিমালা ২০০৫’ একই বছর প্রণীত হয়েছে।
এই বিধির আওতায় গত জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে ১৪৩টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী দেড়শ’ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল।
বিবার্তা/জিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]