শিরোনাম
নানা মাত্রায় বেড়েছে শিশুনির্যাতন
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০১৬, ১৩:১৪
নানা মাত্রায় বেড়েছে শিশুনির্যাতন
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

দেশে নানা মাত্রায় শিশুনির্যাতন ও ধর্ষণ বেড়েছে। কম বয়সী শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা এ বর্বরতার শিকার হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মাসে গড়ে ৩৬ জন শিশুধর্ষণের শিকার হচ্ছে।


বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে এবং হারানো মনোবল ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিক কাউন্সিলিং। সেই সঙ্গে দোষীর বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত জরুরি।


জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী; চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৩২৫টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৮টি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৩১টি প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু, পাঁচটি শিশু গৃহকর্মী কর্মস্থলে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ১৫টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।


চলতি বছরের ৯ মাসে ধর্ষণের শিকার শিশুদের অধিকাংশের বয়সই পাঁচ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে চকলেট, খেলনা বা কোন সৌখিন জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কোন নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ১৩ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হয়েছে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে এবং কোন নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ৫২১টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৯৯ এবং ২০১৩ সালে ১৭০টি এবং ২০১২ সালে ৮৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।



বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিশুদের সুরক্ষায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ বিভিন্ন আইন থাকলেও তা উপেক্ষিত। অপরাধ করার পরও অপরাধীর আইনের আওতায় না আসা, চার্জশিটে আইনের ফাঁকফোকড়, মামলার ধীরগতি, অর্থ পেয়ে কিংবা সম্মান খোয়ানোর ভয়ে আসামির সঙ্গে আপস করে মামলা তুলে নেয়ায় শিশু ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে।


মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় শিশু মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। ভবিষ্যৎ জীবনে তারও এ ধরনের অপরাধ কর্মে জড়ানোর আশঙ্কা থাকে। এসব শিশু স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। সেও অন্যের প্রতি এমন আচরণ করে।


শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ শহীদ মাহমুদ বলেন, শিশুধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। পরিবারের সদস্যদের দ্বারাও শিশুধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। আর এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ শিশুধর্ষণ বা যৌননির্যাতনের ঘটনা এখনও চার দেয়ালের বাইরে আসছে না।


ধর্ষণসহ শিশুদের ওপর নির্যাতন বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যে সংখ্যক অপরাধ ঘটছে সে সংখ্যক অভিযোগ আমাদের কাছে আসে না। অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতার কোন কমতি নেই।’


তবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেনের মতে, নির্যাতনের ঘটনাগুলো আগের মতোই ঘটে চলেছে। তবে তা প্রকাশ পাচ্ছে আগের তুলনায় বেশি। সাম্প্রতিক মিডিয়ার কারণে খবরগুলো আসছে। বিষয়গুলো ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কমিউনিটিতে সেটা জানাচ্ছে।


সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মহিলা পরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড লবির পরিচালক অ্যাডভোকেট মাসুদা আক্তার লাইলী বলেন, জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। অপরাধ করে সহজে জামিন পাওয়া গেলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। শিশুধর্ষণের ঘটনায় আলাদা সেল গঠন, মামলার গতি তদারকি করার ব্যবস্থা করা হলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমতে পারে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।


বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির মনোবিজ্ঞানী সাহিদা সুলতানা বলেন, ‘ধর্ষণের পর যারা আইনি সহায়তা এবং বিভিন্ন ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে বা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন কেবল তাদেরই আমরা সহায়তা দিতে পারি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। অজ্ঞতার কারণে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অনেকেই আদালত বা পুলিশের কাছে যান না। আবার অনেক শিশু বা অভিভাবকই জানে না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আর অনেকে দেখছেন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিচার হচ্ছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।


বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, আমাদের দেশে ধর্ষণের পর একজন নারী ও শিশুকে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা আজও নারী ও শিশুবান্ধব নয়। নারী বা শিশুটি ওই ঘটনাটি ভুলতে চাইলেও তিনি তা ভুলতে পারেন না। মেডিকেল টেস্ট থেকে শুরু করে থানা, কোর্ট প্রতিটি ক্ষেত্রেই যিনি ধর্ষণের শিকার তাকেই প্রমাণ করতে হয় তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অথচ এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দরকার সহমর্মিতা নিয়ে সবার ওই মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো। দোষীর শাস্তি না হলেও তারা এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগেন।


কয়েকটি কেস স্টাডি: ১৮ অক্টোবর দুপুরে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় দিনাজপুরের পাঁচ বছর বয়সী এক কন্যাশিশু। মাইকিং, মসজিদে ঘোষণা দেয়াসহ নানাভাবে শিশুটির খোঁজ করতে থাকে পরিবারের সদস্যরা। ওই দিন শিশুটির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরের দিন ভোরে বাড়ির কাছে একটি হলুদ ক্ষেতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায় শিশুটিকে। জ্ঞান ফেরার পর শিশুটি জানায়, তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের পরিচিত ৩৮ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম তাকে ব্যথা (ধর্ষণ) দিয়েছে। শিশুটিকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতালে। তারপর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে শিশুটিকে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। শিশুটি এখন আছে ঢামেকের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসিতে)।


২৪ অক্টোবর রাজশাহীর পবা উপজেলায় চার বছর বয়সী এক কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করে রুহুল আমিন (২২)। ঘটনার দিন সন্ধ্যার একটু আগে ফাঁকা মাঠে একা পেয়ে রহুল আমিন ওই শিশুকে ধর্ষণ করে। পরে বাড়িতে গিয়ে ওই শিশু তার মাকে বিষয়টি জানায়।


চলতি বছরের ১৬ মে মৌলভীবাজারে চকলেট খাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে স্বপন রাজভর (২০) নামের এক যুবক। ঘটনার দিন দুপুর বেলায় শিশুটির মা পাশের একটি বাড়িতে কাজে যান। এ সময় দুই টাকার একটি নোট বের করে শিশুটিকে চকলেট খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে স্বপন তার ঘরে নিয়ে যায় এবং শিশুটিকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে শিশুটিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে স্বপন পালিয়ে যায়। পরে শিশুটি তার মাকে ঘটনাটি খুলে বলে।


২৭ এপ্রিল লালমনিরহাট শহরে আপেল খাওয়ার লোভ দেখিয়ে বাসায় নিয়ে ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে মকবুল হোসেন (৫০)। ঘটনার দিন রাতে শিশুটির বাসায় আর কেউ না থাকার সুযোগে মকবুল তাকে অপেল দেয়ার কথা বলে নিজের বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে।


বিবার্তা/জিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com