
এবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিবেশী ভারতে ইলিশ যাবে কি না তা নিয়ে ছিল শঙ্কা। অন্তর্বর্তী সরকার প্রথমে ইলিশ রফতানি করবে না বলে জানালেও অবশেষে ইলিশ পাঠাতে সম্মত হয়। তবে নির্ধারিত সময়ে সরকারের অনুমোদন দেওয়া পরিমাণের এক চতুর্থাংশ ইলিশও ভারতে যায়নি।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বা গত ১৭ দিনে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মোট ৪৮৩ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ রফতানি হয়েছে, যা সরকারি অনুমোদনের এক–পঞ্চমাংশ বা ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এ বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতে ২ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দেয়।
শনিবার (১২ অক্টোবর) ছিল ইলিশ রফতানির শেষ দিন। দুর্গোৎসব উপলক্ষে সরকার অনুমোদিত ২ হাজার ৪২০ টনের বিপরীতে বেনাপোল বন্দর দিয়ে শনিবার পর্যন্ত ১৭ দিনে ভারতে গেছে সর্বমোট ৫৩৩ টন ইলিশ। রফতানির জন্য সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশে ইলিশ সংকট আর দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে চাহিদা অনুযায়ী এবার তেমন একটা রফতানি করা যায়নি।
এ বছর ৭০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ গড়ে ১০ মার্কিন ডলারে রপ্তানি হয়েছে, যা দেশের ১ হাজার ১৮০ টাকার মতো। দেশের বাজারে অবশ্য আরও অনেক বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।
কেন আশানুরূপ ইলিশ এবার ভারতে রফতানি হয়নি সেটা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন নানা কারণ। তারা বলছেন, দেশে ইলিশ–সংকট ও উচ্চ দাম এবং পশ্চিমবঙ্গে চাহিদা কম থাকার কারণে অনুমোদিত রফতানি কোটা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে পক্ষে–বিপক্ষে নানা মতামত ও প্রতিক্রিয়া এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনার কারণেও রফতানিতে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকার প্রথমে ইলিশ দিতে চায়নি। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে ইলিশ না পাঠানোর কথা বলেছেন। এর প্রভাব পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাজারে। বাংলাদেশের ইলিশ না খাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চলে। এতে সেখানকার স্থানীয় বাজারে ইলিশের চাহিদা কমে যায় বলে মনে করেন রফতানিকারকেরা।
সময় স্বল্পতাকেও দুষছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, ইলিশ চেয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অনুরোধ আর বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া অনুমতির মধ্যকার সময় স্বল্পতার কারণে পুরো ইলিশ রফতানি করা যায়নি। পূজা শুরুর পর ভারতীয় অংশে আমদানি বন্ধ এবং রফতানির জন্য হাতেগোনা মাত্র কয়েকটা দিন থাকায় ইলিশ রফতানিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ইলিশ রফতানিকারক বেনাপোলের সততা ফিশের রেজাউল করিম জানান, দেশে ইলিশ সংকট আর বেশি দামের কারণে চাহিদা মতো রফতানি করা যায়নি। সময় বাড়ালে হয়তো আরও কিছু রফতানি সম্ভব ছিল।
তবে ইলিশ রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন জানিয়েছেন, শুধু এবার যে কম ইলিশ গেছে এমনটাই নয়। বিগত পাঁচ বছরেও রফতানির অনুমতি পাওয়া পুরো ইলিশ পাঠানো যায়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩ সালে চার হাজার মেট্রিক টন ইলিশ ভারতে রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর বিপরীতে রফতানি হয়েছিল মাত্র এক হাজার ৩৭৬ টন।
এবার দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যা পরে কমিয়ে দুই হাজার ৪২০ টন করা হয়। এই অনুমতি দেওয়া হয় ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে ৪৮টি প্রতিষ্ঠান ৫০ টন করে দুই হাজার ৪০০ টন আর অন্য প্রতিষ্ঠানটি ২০ টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন পায়।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ছিল মাছ রফতানির শেষ দিন। সে অনুযায়ী, গত ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ দিনে বেনাপোল পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ৫৩৩ টন ইলিশ রফতানি হয়েছে ভারতে। যার রফতানিমূল্য ৫৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার বলে জানান কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা। এ বছর ৭০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ গড়ে ১০ মার্কিন ডলারে রফতানি হয়েছে, যা দেশের এক হাজার ১৮০ টাকার মতো। দেশের বাজারে অবশ্য আরও অনেক বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হয়, যা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেন।
বেনাপোল স্থলবন্দরের ফিশারিজ কোয়ারেন্টাইন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, গত ২৫ সেপ্টেম্বর ৪৯ রফতানিকারককে ২ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানিতে ছাড়পত্র দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ৪৮ জনকে ৫০ মেট্রিক টন করে ও একজনকে ২০ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়া হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর রাত পর্যন্ত ৫৩৩ মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি হয়েছে ভারতে; যার মূল্য ৫৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় ৬৩ কোটি ৯৬ লাখ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, প্রথমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে পরে বিদেশে ইলিশ রফতানি হবে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্তে অনড় থাকেনি সরকার। দেড় মাসের মাথায় ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতে ইলিশ রফতানি শুরু হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন ইলিশ ভারতে রফতানি হয়। ২০২০–২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯৯ টন ইলিশ রফতানি হয়। অন্যদিকে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৩০ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯১ টন ইলিশ রফতানি করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন ইলিশ ভারতে রফতানি করা হয়। সে হিসাবে ৫ বছরে মাত্র ৫ লাখ ৩০ হাজার টন ইলিশ রফতানি হয় ভারতে।
শনিবার বেনাপোল স্থলবন্দর মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর আসাওয়াদুল ইসলাম জানান, পূজার ছুটির মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতে ইলিশ রফতানি চালু ছিল। আজ শেষ দিনে ৩৬ টনের মতো ইলিশ ভারতে রফতানি হতে পারে। আজ ইলিশ রফতানির শেষ দিন পর্যন্ত মোট ৫৩৩ টন ইলিশ গেছে ভারতে।
এদিকে শনিবার (১২ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন সাগর ও নদীতে ইলিশ ধরা, মজুত বা সংরক্ষণ এবং বিপণন সবই নিষিদ্ধ।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]