নাশকতার ঘটনায় শনাক্ত হচ্ছে অর্থ জোগানদাতারা
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৪, ১৯:৫৩
নাশকতার ঘটনায় শনাক্ত হচ্ছে অর্থ জোগানদাতারা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি মাসের শুরু থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। গত ১৬ জুলাই কোটাবিরোধীদের চলমান আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। ওইদিনই সারা দেশে দিনভর চলে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। কোটাবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা করা হয়। স্থাপনা ভাঙচুরের পাশাপাশি দেওয়া হয় আগুন। পরে ২০ জুলাই দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি।


পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে নাশকতার ঘটনায় অর্থ জোগানদাতারা শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। শনাক্ত করা হচ্ছে সহিংসতার ঘটনা বাস্তবায়নকারী এবং সমন্বয়কারীরাও। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন, পাঁচটি দেশ থেকে বিভিন্ন ব্যানারে নিয়মিত অর্থ আসত। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব থেকে আসা এসব অর্থের জোগানদাতাদের নামও তারা পেয়েছেন।


কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় রাজধানী ঢাকা। সূত্র মতে, হামলাকারীদের টার্গেটে ছিল পুলিশ ও সাংবাদিক। হামলাকারীরা কোটাবিরোধী আন্দোলনে ঢুকে যায়। এরপর সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে টার্গেট করে হামলা চালাতে থাকে। এসব হামলা ও সহিংসতা ঘটানোর জন্যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। আর এই অর্থগুলো আসে বিভিন্ন দেশ ও ব্যক্তির কাছ থেকে।


দুর্বৃত্তের দেয়া আগুনে ভস্মিভূত হয়েছে পুরো সেতু ভবন। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে অন্তত ৫৫টি গাড়ি। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। তবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এখনো জানা যায়নি। এই ঘটনার তদন্তে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সেতু মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ফলে অধিদপ্তরটির গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে গেছে। রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়েছে মোটরসাইকেল, গাড়িসহ প্রডাকশন সেট। পুড়ে যায় ২০-২৫টি গাড়ি। ডেটা সেন্টারে আগ্নিসংযোগের ফলে ইন্টারনেট সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন সারা দেশ।


মেট্রো স্টেশনে হামলায় বন্ধ হয়ে গেছে মেট্রোরেল চলাচল। দুর্বৃত্তদের হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় মেট্রোরেলের দুই স্টেশন। টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম), মনিটরসহ বিভিন্ন নির্দেশক বক্স ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে অকেজো হয়ে পড়েছে টিভিএম মেশিন। এ ছাড়া যাত্রীসেবা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত কম্পিউটার চুরি করে নিয়ে যায় হামলাকরীরা। হামলার ফলে এই স্টেশন দুটি যাত্রীসেবার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির হিসাব এখনো জানা যায়নি। তবে এই দুটি স্টেশন পুনরায় চালু করতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। সেতু ভবন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অগ্নিসংযোগে পুড়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। এ ছাড়া ডেটা সেন্টারে অগ্নিসংযোগের ফলে ইন্টারনেট সেবা ও রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে হামলায় সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।


মিরপুরের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা বিভাগীয় পরিচালকের গাড়ি, কার্যালয় ও বাস পুড়ে যায়। এ ছাড়াও চলমান আন্দোলনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মহাখালী টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর বনশ্রী কার্যালয়, ধানমন্ডির ওষুধ প্রশাসন ভবনে অগ্নিসংযোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে এসব প্রবাসী বাংলাদেশি দীর্ঘদিন ধরেই নাশকতাকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। সবশেষ কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ধ্বংসাত্মক রূপ দেয়ার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থের জোগান দিয়েছে তারা। সূত্র বলছে, নাশকতাকারীদের কাছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে অর্থ আসছিল। র‌্যাবের কাছে গ্রেফতার গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব মো. তারেক রহমানের কাছেও কয়েক দফায় এসেছিল ১৬ লাখ টাকা। তার দায়িত্ব ছিল রামপুরা এবং বাড্ডা এলাকার বিষয়টি সমন্বয় করা। বিটিভি, রামপুরা ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন, বিজিবির এপিসি ভাঙচুরসহ অনেক ধ্বংসাত্মক কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে তার মাধ্যমে।


গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ফ্রান্সে থাকা একজন ইউটিউবারের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। গ্রামের বাড়ি একই এলাকার হওয়ায় তারেকের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি ছিল ওই ব্যক্তির। আবার লন্ডনে থাকা বিএনপির এক শীর্ষ নেতাও তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে ভিডিও কলে কথা বলতেন। ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক নুরুল হক নূরের সঙ্গে তারেকের বিরোধের পর থেকে তাকে বেছে নেন বিএনপিপন্থি নেতারা। গত বুধবারও তার সঙ্গে বনানীর একটি অফিসে নাশকতা সংক্রান্তে বৈঠকও করেছিলেন বরকত উল্লাহ বুলু, জুনায়েদ সাকি, ভাসানী, ফারুক, বরকত, মনির, ইরান, ফারুক নামের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তৈরি করা হয়েছিল এ সংক্রান্ত নীলনকশা।


সূত্র আরো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ফয়সল, খন্দকার ও এফএমইউ নামের তিনজন ব্যক্তি নগদ (এমএফএস) সার্ভিসে নিয়মিত অর্থ পাঠাতেন তারেকের কাছে। পরবর্তীতে তিনি তা তার সহযোগীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড নিজের মোবাইল ফোনে রেকর্ড করে রাখতে বলতেন। আহত ব্যক্তিদের কম খরচে চিকিৎসার জন্য রাজধানীর একটি নামকরা হাসপাতালে বলে রাখা হয়েছিল। আর এর সমন্বয় করতেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী খন্দকার নামের একজন চিকিৎসক।


ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র বলছে, বিএনপিপন্থি অন্তত ৩০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে নাশকতাকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য। গ্রেফতারকৃতরা ইতোমধ্যে ওই ব্যবসায়ীদের নাম ফাঁস করে দিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে উত্তোলিত টাকার প্রায় অর্ধেকই উত্তোলনকারীরা নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। অর্ধেক টাকা পৌঁছত নাশকতাকারীদের কাছে। আবার অনেক সময় পুরোটাই তারা নিজেরা মেরে দিয়েছেন। বর্তমানে রিমান্ডে থাকা অর্থদাতা, সমন্বয়ক এবং বাস্তবায়নকারীদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।


এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পেয়েছি। সাইফুল ইসলাম নীরব, টুকু, মজনুসহ আরও কিছু সাবেক ছাত্রনেতা বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ নিতেন। অর্থদাতাদের অনেক বিএনপির শীর্ষ নেতা এবং ব্যবসায়ী। লন্ডনে থাকা তারেক রহমান ওই ব্যক্তিদের নাম বলে দিতেন।


জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, নাশকতার বাস্তবায়ন সংক্রান্তে আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। কীভাবে অর্থ নাশকতাকারীদের কাছে পৌঁছেছে সেই রুট সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো এখন যাচাই-বাছাই চলছে। তবে যারা নাশকতার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের আইনের আওতায় আনার জন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com