শিরোনাম
আজ রাজনীতির তথ্যব্যাংক এমএ গনির জন্মদিন
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০১৭, ১০:০৫
আজ রাজনীতির তথ্যব্যাংক এমএ গনির জন্মদিন
আজাদ তালুকদার
প্রিন্ট অ-অ+

: কি করো তুমি?


: আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপকমিটির মেম্বার!


: এটা কী, এটার কোনো কাজ আছে?


: না, কোনো কাজই নেই।


: কাজ না থাকলে এসব পদে থেকে লাভ কী? এটার কোনো মানে হয়! তোমাদের পুকুর সেঁচতে গ্রামে পাঠাবো, পাঁচ-ছয়জন করে গ্রামে যাবে, গ্রামীণ উন্নয়নে যুক্ত হবে।


এমন আলাপচারিতায় হু হু করে উঠে চারপাশ। বয়ে যায় হাসির ফোয়ারা! এই ফোয়ারার মধ্যমণি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ইউরোপ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ গনি। গত ২৩ এপ্রিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে বসে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বিষয়-আশয়, রাজনৈতিক ইতিহাসের তথ্যব্যাংক খ্যাত প্রবীণ এই মানুষটির সঙ্গে। উপস্থিত ছিলেন তাঁর অপত্য স্নেহের মানুষ নান্দনিক রাজনীতি চর্চায় ব্রত অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানুও। আর সেই সময়টাতেই আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী দেখা করতে আসেন এমএ গনির সাথে। তখনই এই আলাপচারিতা, কথোপকথন।


এ প্রসঙ্গে এমএ গনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর গড়া দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই স্বেচ্ছাশ্রমে পুকুর সেঁচবে, রাস্তাঘাট বানাবে, খাল কাটবে, দেশ গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত বিলাসব্যসন নয়, ভোগ কিংবা মোহ নয়, যে কোনো পরিস্থিতিতে জনগণের সর্বোচ্চ সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন। বঙ্গবন্ধুর গড়া বাংলাদেশের চলমান অগ্রযাত্রা সেদিনই পূর্ণতা পাবে যেদিন সত্যিকার অর্থেই দেশের ১৭ কোটি মানুষের মুখে লালসবুজের হাসি ফুটে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর সেই বাংলাদেশ গঠনে তাঁর যোগ্য তনয়ার ভিশন-মিশনে আজকের নেতাকর্মীদের এধরনের মনোবৃত্তি নিয়েই এগিয়ে আসতে হবে- যোগ করেন এমএ গনি।


প্রিয় পাঠক, কেবল আদর্শিক, গঠনমূলক রাজনৈতিক সুবচন শোনানোই নয়, আমরা আপনাদের আজ শোনাতে চাই তার চেয়েও বেশি কিছু। গতানুগতিক কোনো রাজনৈতিক নেতা নয়, আমরা জানাতে এসেছি একজন ‘রাজনীতির ফেরিওয়ালা’র গল্প, যিনি শুদ্ধ রাজনীতির ফেরি করছেন দেশ-দেশান্তরে দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে। বলছিলাম রাজনীতির পাঠশালার মহান শিক্ষক, আওয়ামী রাজনীতির অভিভাবক এমএ গনির কথা।



এমএ গনির জন্ম চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ এলাকায় এক জমিদার পরিবারে। তার বাবা কলকাতায় সুলতানিয়া পারফিউমারি ওয়াক্সের মালিক ছিলেন। সেই সুবাদে কলকাতায় কেটেছে তার শৈশব। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ভর্তি হন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন পড়া হয়নি তার। যে ক্রিকেট মানুষের ভাগ্য বদলে দেয় সেই ক্রিকেটই হয়ে উঠে তার ভাগ্য বিড়ন্বনার কারণ। ছোটকাল থেকেই দারুণ ক্রিকেট খেলতেন। ছিলেন ফাস্টবোলার। পড়াশোনার চেয়ে ক্রিকেটে মনোযোগী হতে গিয়ে মাঝপথেই স্কুল ছাড়তে হয় তাকে।


নানা পথ মাড়িয়ে অবশেষে উচ্চ মাধ্যমিকের যাত্রী হয়ে উঠলেন নটরডেম-এর তরীতে। কিন্তু সেই নটরডেম কলেজেও বেশিদিন থাকা হয়নি তার। ওই যে ক্রিকেট-বিড়ম্বনা। এখানেও চূড়ান্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘ক্রিকেট’। একবার প্রচণ্ড বেগে বল ছুটে যায় আঙিনা থেকে কলেজের জানালায়। ব্যস, তাতেই চুর্ণবিচুর্ণ সব। পরদিন ক্রিকেটপাগল গনির হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো কলেজ ত্যাগের চূড়ান্ত নোটিশ! স্কুল-কলেজ থেকে বিতাড়িত সেই মেধাবী ছাত্রটিই পরবর্তীতে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি মাড়িয়েছেন। উন্নত শিক্ষাগ্রহণ শেষে সমাজ পরিবর্তনের নেশায় বুঁদ হয়ে ফিরে আসেন নিজ শহরে।


এর পরের গল্পটা কেবল এগিয়ে যাবার। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রচারে চট্টগ্রাম আসেন বঙ্গবন্ধু। আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী প্রমুখ। এসময় দুই তরুণের বলিষ্ঠতা নজর কাড়ে বঙ্গবন্ধুর। আতাউর রহমান খান কায়সার (আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম মেম্বার) ছাড়া অন্য তরুণটি হলেন আজকের এমএ গনি। বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে এই তরুণ হয়ে উঠেন ক্রমশ দুর্নিবার, দুর্বিনীত। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে গড়েন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটি। সেই কমিটির প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমএ গনি। জানে আলম দোভাষ সভাপতি ও জহুর আহমদ চৌধুরী (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী) সাধারণ সম্পাদক। সেই কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে ঠাঁই পেয়েছিলেন আতাউর রহমান খান কায়সারও।


দলের গুরুত্বপূর্ণ এই পদ তাকে আরও বেশি শাণিত করে দলকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে। ’৬৫ সালে আইয়ুব সরকার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচনের আয়োজন করেন। তাতে আওয়ামী লীগ অংশ না নিলেও বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন গনি। সেসময় চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র আন্দরকিল্লা থেকে মুসলিম লীগের শক্তিশালী প্রার্থীকে পরাজিত করে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। অপরদিকে চন্দনপুরা থেকে নির্বাচন করে হেরে যান আতাউর রহমান খান কায়সার। পর পরই এমএ গনি শত বছরের প্রাচীন কো-অপারেটিভ ব্যাংকের পরিচালক নির্বাচিত হন বিপুল ভোট পেয়ে।


১৯৬৭ সালে বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তুঙ্গস্পর্শী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রথম সারির মানুষ এমএ গনি। আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সামনে আইয়ুববিরোধী মিছিলে নেতৃত্বরত গনিকে টার্গেট করে আইয়ুব সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী। পিটিয়ে, পিষিয়ে মুমূর্ষু করে তোলা হয় তাকে। এসময় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাবার কর্মস্থলের সুবাদে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, বর্তমান সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী। বলাবাহুল্য, এই সাজেদা চৌধুরীই মুমূর্ষু গনিকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন। দুপায়ে, মাথায়, পিঠে অসংখ্য দগদগে ক্ষত এখনো সেই দুঃসহ পুলিশী নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।


১৯৬৬ সালের দিকে চট্টগ্রাম সফরে আসেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। সার্কিট হাউসে জরুরি বৈঠক। সেই অনুষ্ঠানে অন্যদের মতো আমন্ত্রিত হয়ে আসেন ওয়ার্ড কমিশনার এমএ গনি। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বক্তৃতা শুরু করেন এভাবে ‘ইউ পিপল টু মাচ পলিটিক্যালি মোটিভিটেড অ্যান্ড বিহেভ লাইক অ্যা ডগস ফর দ্যা পিস অব বোন’। তুমুল করতালি সার্কিট হাউজের পুরো হলরুমে। আইয়ুব খান ভেবেছিলেন এর মর্মার্থ কেউ বুঝতে পারবেন না। ততক্ষণে অন্যরকম এক উন্মাদনা তৈরি হয় এমএ গনির ভেতরে। ক্ষোভে, অপমানে রীতিমতো অগ্নিশর্মা তিনি। আর দেরি নয়, সাড়ে আট টাকা দামের জুতা ছুঁড়ে মারলেন আইয়ুব খানের দিকে। জুতা খেয়ে অধস্তনদের হতবিহ্বল আইয়ুব খানের তাৎক্ষণিক নির্দেশ ‘শুট হিম’। এ অবস্থায় এমন লাফ দিলেন গনি, একেবারে গিয়ে পড়লেন নিজ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে।



স্টিয়ারিং ধরে সোজা টার্ন নিলেন জালালাবাদ পাহাড়ের দিকে। এক মহিলার ঘরে তিনদিন আত্মগোপনে থাকার পর মায়ের অসুস্থতার খবর শোনে বাড়িতে ছুটে আসেন, আর তখনই ওঁৎ পেতে থাকা পুলিশ বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। উপরের নির্দেশ ছিলো গনিকে পিটিয়ে আধমরা করার। কিন্তু কোতোয়ালী থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুস সাত্তারের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক এমএ গনির। সেই সম্পর্কের সুঁতোয় গাঁথলেন, বাঁচলেন। ওসি সাহেবের স্ত্রী নিজেই গনির পিঠে এমনভাবে তেল আর কালি মেশালেন তাতে মনে হবে নির্যাতনের অনেক ধকল বইয়ে গেছে মায়াবি এই পিঠে। পরদিন থানা হাজতে মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এই অবস্থা দেখে ভড়কে যান, বলেন এমনভাবে মারার কী প্রয়োজন ছিল ছেলেটারে!


বলা বাহুল্য, এই সময় চট্টগ্রাম সুইপার এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন এমএ গনি। তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে সুইপার কলোনির হাজার হাজার মানুষ ঘিরে ফেলে কোতোয়ালী থানা। বালতি বালতি মল ছিটিয়ে অবরূদ্ধ করে রাখে থানা কম্পাউন্ড ও এর আশপাশ।


নির্যাতন, কারাবাস একের পর এক হুলিয়ার মুখে একসময় দেশত্যাগে বাধ্য হন গনি। ১৯৬৯ সালের কোনো এক বিকেলে লন্ডনের উদ্দেশ্যে মিলিয়ে যান আকাশে। আর এই ধরায় রেখে যান কত স্মৃতি, কত দেশপ্রেম, দ্রোহ আর সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়। সেখানে গিয়েও বসে থাকেননি তিনি। যার ধমনীতে দেশমুক্তি, বাংলা-বাঙালির দুঃখগাথা বদলের অন্যরকম নেশা- তিনি বসে থাকেনইবা কী করে! আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর লন্ডন গিয়ে এমএ গনিকেই সবার আগে খুঁজে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এসময় বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া। তুখোড় এই সংগঠকের বিচক্ষণ, বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি সেই প্রথম দেখাতেই নজর কাড়ে শেখ হাসিনার।


ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার পাশাপাশি যুক্ত হন লন্ডনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। চিটাগাং ওয়েলফোর এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কিংবা লন্ডনস্থ বেঙ্গলি ইন্টারন্যাশনালের উপদেষ্টা হয়েই শুধু নয়, বাংলাদেশের মানুষের মুখ উজ্জ্বল করেছেন ইন্টারভার্সিটি ক্রিকেট ক্লাবের প্রথম বাংলাদেশি ক্যাপ্টেন, লন্ডন পুলিশ কনসালটেন্সি কমিটির দুদুবার সদস্য এবং ইনার লন্ডন এডুকেশন অথরিটির পরপর দুবার গভর্নর নিযুক্ত হয়ে। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ‘বিদেশি’ হয়ে যাননি তিনি। বঙ্গবন্ধুর বাঁশির সুর যার মনে, যার প্রাণে- তিনিই বা বিদেশি হন কী করে! পুরোদস্তুর এই ‘বাঙালি’ লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটি এবং ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্তি আন্দোলনের কাব্যগাথা ফেরি করেন জনে জনে। বঙ্গবন্ধুর অনিন্দ্য চিন্তন আর আদর্শের সঙ্গে জনআকাঙ্ক্ষার অপূর্ব সেতুবন্ধন তৈরির কাজটি নিখুঁতভাবে করেছিলেন দূর প্রবাসে বসেই। সেই পথে, সেই মতে চলতে চলতে এই দেশে বেধে গেলো যুদ্ধের দামামা।


২৫ মার্চ রাতে নির্বিচারে গণহত্যা কিংবা বাঙালি নিধনের ভয়াবহ ঘটনাপঞ্জির পর লন্ডনের বার্মিংহামে গঠিত বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এমএ গনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে বিদেশি জনমত গঠনের কাজটি সফলভাবে করতে গিয়ে সেখানে বসবাসরত পাকিস্তানিদের টার্গেটে পরিণত হন। এসময় পাকিস্তানিদের জিঘাংসা আর হিংসার আগুন থেকে রেহাই পায়নি গনির ব্যবহৃত গাড়িটি। বিজয় অত্যাসন্ন। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণের প্রারম্ভে লন্ডনে প্রথম বাংলাদেশের বিজয়পতাকা উড়িয়েছিলেন এই এমএ গনি। যুদ্ধ শেষ। বিজয়-উৎসব চারদিকে। কিন্তু সেই উৎসবে এখনই গা ভাসান না গনি। তার মতে, বিজয় অর্জিত হয়েছে, কিন্তু বিজয়ের সেই মহানায়কের মুক্তি মিলেনি। সেই মহান নেতা ছাড়া বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন অপূর্ণ, অপার্থিব। তিনি জানতেন, পাকিস্তানিরা বিশ্বনন্দিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তাঁর মুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র!


অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার খবরটি তিনিই প্রথম পান একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারের কাছে। পাকিস্তান কারাগার থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানের এয়ারক্রাফটে চড়ে ৮ জানুয়ারি লন্ডনের একটি প্রাইভেট বিমানবন্দরে অবতরণ করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বিখ্যাত ক্লাজিয়ার্স হোটেলে। দেখেই এমএ গনিকে বুকে টেনে নেন বঙ্গবন্ধু। সেই প্রেক্ষাপট বর্ণনায় এমএ গনির মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা কাহিনী, চমকিত হওয়ার মতো তথ্য। গনি বলেন, কয়েকদিন ধরে গোসল না করা বঙ্গবন্ধুকে নিজেই শ্যাম্পু দিয়ে গোসলের ব্যবস্থা করেন। গোসল সেরে উঠতেই বঙ্গবন্ধুর জন্য বাংলাদেশি খাবার রান্না করে নিয়ে আসেন লন্ডনে বসবাসরত জেনারেল মোনাফের ছোট বোন মুন্নী। সেই খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন বঙ্গবন্ধু। এরমধ্যে হোটেল লবিতে বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড়। কিছুক্ষণ পর তাদের মুখোমুখি হন বঙ্গবন্ধু। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে আমি।


বঙ্গবন্ধুকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট, বঙ্গবন্ধু নাকি শেখ মুজিব- কী নামে অ্যাড্রেস করি আমরা। ‘জাস্ট কল মি মুজিব, জাস্ট গুড ইনাফ ফর মি’- জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু। ৯ জানুয়ারি লন্ডনের পত্রিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারসহ ‘পাকিস্তান কারাগার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কের মুক্তি’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয় গুরুত্বের সঙ্গে। জনাব এমএ গনি জানান, ১০ জানুয়ারি প্রত্যুষে স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন বঙ্গবন্ধু। ব্রিটেনের রানীর ছয়টি বিশেষ এয়ারক্রাফটের ২ নং ‘কমেট’ এয়ারক্রাফটি প্রস্তুত করা হয় বঙ্গবন্ধু ও তার সঙ্গীদের বহনের জন্য।



ড. কামাল হোসেনসহ দেশ-বিদেশের ৮০ জন সঙ্গী নিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে রওনা দেয় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিশেষ এয়ারক্রাফটি। এই বহরে যোগ দিয়ে এমএ গনিরও দেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কিছু অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিতে লন্ডনে থেকে যান তিনি। এছাড়া গনির হাতে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সংগৃহীত কিছু অর্থ ছিল, এই অর্থ যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া কিংবা সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিনি দেশে গিয়ে জানাবেন সেই অর্থ কী করতে হবে। পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রদূত কামাল আহমেদের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের নামে প্রিন্ট করা প্রথম চালানের পাসপোর্টগুলো নিয়ে আসার কাজটি এমএ গনির হাতেই ন্যস্ত করেন বঙ্গবন্ধু।


স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ব্রিটেনের স্বীকৃতি আদায়েও কাজ করেন এমএ গনি। এই দাবিতে টেমস নদীর পাড়ে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন এবং আমরণ অনশন শুরু করেন সহকর্মীদের নিয়ে। একপর্যায়ে স্বীকৃতির বিষয়টি ব্রিটেনের পার্লামেন্টে ভোটাভুটিতে তোলা হয় এবং তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয় বাংলাদেশের স্বীকৃতি।


বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভালোবাসার আরও কাব্য আছে এই মানুষটার। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা বিমানবন্দরে নামলে এমএ গনির সম্মানে উষ্ণ অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীকে বিমানবন্দরে পাঠানো হয় প্রিয় এই মানুষটিকে রিসিভ করতে। এরপর বঙ্গভবনে দেখা হতেই পিএস রফিক উল্লাহকে ডেকে নেন বঙ্গবন্ধু, নির্দেশ দেন এমএ গনিকে বাংলাদেশ বিমানের পরিচালক করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে। গনিকে বললেন, বিমানটা সাজাও তুমি। বিনয়ের সাথে এই প্রস্তুাব নাকচ করে গনি বললেন, লাভজনক পদে নয়, অলাভজনক জায়গায় থেকে লন্ডনে বসেই নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের সারথী হতে চাই। তবুও বাংলা এয়ার মেরিন কোম্পানি লিঃ (ব্যামকো)-এর পরিচালক করা হয় তাকে। এই সংস্থার হয়ে হল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রথম বিমান এফ-২৭ কিনতে গিয়ে ঐতিহাসিক মুহূর্তের গর্বিত অংশীদার হয়েছিলেন এমএ গনি।


লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী হিসেবে বাঙালি কমিউনিটির কাছে আজও পরিচিত নাম এমএ গনি। তিনিই লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর খুনীচক্রের গোপন বৈঠক ফাঁস করে দেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বাংলাদেশে এক-এগারো কিংবা সেনা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পররাষ্ট্র ডেস্কে চিঠি চালাচালি করে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের সরকার-ব্যবস্থা কোনোভাবেই শুভ নয়। এর আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের খুন, গুম, সন্ত্রাসবাদ এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতনের চিত্র বিদেশিদের কাছে তুলে ধরেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। গড়ে তোলেন বিএনপি-জামায়াতবিরোধী তীব্র সেন্টিমেন্ট।


চমৎকার চেহারা সৌষ্ঠবের এই মানুষটির আরও কিছু পরিচয়; তিনি স্মার্ট, সজ্জন সুক্ষ্ম রুচিবোধের মানুষ, সৌখিনতার শ্রেষ্ঠতম পুরুষ। রাজনীতিসহ যে কোনো বিষয়ে জ্ঞানের পিদিম জ্বালানো এই মানুষটির কথায়, চলনে-বলনে মোহাবিষ্ট হন যে কেউ। অসাধারণ এক সম্মোহনী শক্তি তাঁর। সেই শক্তিতেই বোধহয় লন্ডনের বৃহত্তম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, যেটি ৭ হাজার মানুষের কর্মক্ষেত্র সেই ‘সেলফ্রিজেস’-এর পার্সেজ ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। এসময় দেশ-বিদেশের অনেকের জন্য এই প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ করে দেন জনাব গনি। পৃথিবীর বৃহত্তম তেল কোম্পানি আমেরিকান-এরাবিয়ান তেল কোম্পানির পার্সেজ ম্যানেজার হয়ে মধ্যপ্রাচ্যেও বেশ কিছুদিন কাজ করেন তিনি।


গনি বললেন, শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করার জন্য ৯০ সালে সেই চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৯১ সালে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে দল গোছানোর কাজে জড়িয়ে পড়েন।


আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন ইউরোপের ঘরে ঘরে। আর সেই দায়িত্বটি তার হাতে তুলে দেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ইউরোপ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সমগ্র ইউরোপজুড়ে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ভিত গড়ে তোলেন। গঠন করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শক্তিশালী কমিটি। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, জাপান, চায়না, কোরিয়া এবং রাশিয়াতেও দলের সাংগঠনিক ভিত্তির জন্য কাজ করেছেন শেখ হাসিনার পক্ষ হয়ে। যেখানেই দলের এবং দলীয় প্রধানের সুনাম সমুজ্জ্বল থাকার বিষয় এসেছে সেখানে তিনি ছুটে গেছেন বিশ্বস্ত দূত হয়ে। সর্বশেষ প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার দিনই সবার আগে হামলার স্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ফুল ও বাংলাদেশি পতাকা দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এগিয়ে যান গনি। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেন দেশে-বিদেশে আওয়ামী পরিবারের প্রতিভু, অভিভাবক তথা সবার প্রিয় গনি ভাই।


ব্যক্তিজীবনে এমএ গনির স্ত্রী ও ৬ সন্তান। অকালপ্রয়াত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মেয়ে নাজমা গনি। বাকি ৫ সন্তান-ইংরেজি প্রভাষক তাহমিনা গনি, আমেরিকার প্রতিরক্ষা কনসালটেন্ট ড. সোহেল মাহমুদ গনি, সলিসিটর জেরিনা গনি, সফটওয়ার ব্যবসায়ী ওসমান গনি, গণিতের শিক্ষক সাবিনা গনি তথাকথিত ‘ধনাঢ্য’, ‘বর্ণাঢ্য’ হওয়ার চেয়ে বাবার মতো ‘মানুষ’ হওয়ার দৌড়ে ব্যাপৃত আছেন। এমএ গনির দুই ভাই চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জে পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন। একমাত্র বোন থাকেন চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায়। এমএ গনির কীর্তি স্মরণে বহু আগে চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় তৈরি করা হয় এমএ গনি সড়ক। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ মানুষ জানে না যার নামে এই সড়ক, তিনি কে, কোথায় থাকেন, কী তার কর্মপরিচয়!


ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ‘জামর’ চট্টগ্রামের সন্তান। ১৭৬৯ সালে প্রচলিত দাসপ্রথায় ইংরেজ বণিকের হাতে চট্টগ্রাম উপকূলে ধরা পড়ে সেই জমির থেকে জামরের ঠিকানা হয় মাদাকাসকার দ্বীপ হয়ে সম্রাট পঞ্চম লুইয়ের স্ত্রী দুররানির কাছে। কালের প্রয়োজনে সেই ‘দাসবালক’ই হয়ে উঠেছিলেন ফরাসি বিপ্লব ও ফরাসি মুক্তির মহানায়ক। জামরের মতো চট্টগ্রামবাসীর আরেকটি অহঙ্কারের জায়গা এমএ গনি। কেননা তিনি আমাদেরই সন্তান, চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র।


জামরের বিপ্লব ফরাসিদের জন্য, একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত! আর গনির বিপ্লব বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য, যে বিপ্লব তিনি শুরু করেছিলেন চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জ থেকে। আর সেটির ঢেউ আছড়ে পড়েছে লন্ডনের টেমস নদীর পাড়ে, যে ঢেউ কখনো শান্ত, সাবলিল আবার কখনো গর্জে উঠে মানবকল্যাণের তৃষিত মন নিয়ে। তাই নেতা, সংগঠক কিংবা সাধারণ কোনো বিশেষণ মহান এই মানুষটির সাথে যায় না। তিনি চাইলে মন্ত্রী, এমপি, রাষ্ট্রদূত হতে পারতেন। কিন্তু সেগুলো হননি, হতে চাননি। চেয়েছিলেন বিশালতায় হারিয়ে যেতে। আর সেটি তিনি পেরেছেন দারুণভাবে।


(সাক্ষাৎকারটি গত বছর নেয়া হয়েছিল ২৩ এপ্রিল,২০১৬)


বিবার্তা/জিয়া


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com