বঙ্গবন্ধুর দর্শনের পরিপূর্ণ প্রতিফলন '৭২ এর সংবিধান: ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ২১:৪১
বঙ্গবন্ধুর দর্শনের পরিপূর্ণ প্রতিফলন '৭২ এর সংবিধান: ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ৩২ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর সংবিধানের মূল চেতনা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করছে। নির্মূল কমিটি প্রতি বছর ৪ নভেম্বর ‘সংবিধান দিবস’ পালন করে। এ বছর বিশেষ কারণে নির্মূল কমিটি ৪ নভেম্বরের পরিবর্তে ৫ নভেম্বর ‘সংবিধান দিবস’-এর অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।


৫ নভেম্বর, রবিবার বিকাল ৩টায় ৫২তম সংবিধান দিবস উপলক্ষ্যে নির্মূল কমিটির উদ্যোগে সুপ্রিম কোর্ট বার মিলনায়তনে ‘১৯৭২-এর সংবিধান: বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের দর্পণ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।


নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি।


আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. মোখলেসুর রহমান বাদল, পোল্যান্ড-এর নেভার এগেইনের সভাপতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রাফাল প্যানকোভস্কি এবং নেভার এগেইনের সদস্য মানবাধিকার নেতা নাটালিয়া সিনায়েভা প্যানকোভস্কা। সভা সঞ্চালনা করেন এডভোকেট আজহার উদ্দিন ভূঁইয়া।


সভার প্রধান অতিথি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ’৭২-এর সংবিধনের পটভূমি বর্ণনা করে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় গণপরিষদ কর্তৃক ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। যা সংসদীয় গণতন্ত্র এবং সাংবিধানের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় অঙ্গীকারের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। জাতির পিতা সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বিধায় তাঁর নির্দেশনায় গণপরিষদ এক বছরেরও কম সময়ে একটি অসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, অন্যান্য দেশগুলি সংবিধান প্রণয়ন করতে বহু বছর সময় নিয়েছে।


মাননীয় স্পিকার আরও বলেন, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের সম্পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর একটি ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে তিনি এই সংবিধান রচনা করেছিলেন। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি যেখানে বঙ্গবন্ধুর দর্শন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সেখানে নারী-পুরুষ, শিক্ষা-দীক্ষা, অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে। সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ এবং তাদের মতামত ছাড়া কোন কিছুই করা সম্ভব নয় এটা বুঝেই বঙ্গবন্ধু সংবিধান রচনা করেছেন।


নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মদান এবং প্রায় ৫ লক্ষ মা-বোনের চরম ত্যাগের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী তাঁর সহযোগীরা জাতিকে যে সংবিধান উপহার দিয়েছেন সেটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। এই সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ; যা ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূর্ত রূপ। এই চার নীতি অন্য অনেক আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধানে থাকলেও ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তে লেখা ১৯৭২-এর ৪ নভেম্বর গৃহীত বাংলাদেশের মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে নিশ্চিত করার জন্য ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারণ মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে যাবতীয় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। শুধুু ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে নয়, বর্তমানে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বে ইসলামের নামে যে ভয়াবহ সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছে তার আদর্শিক প্রণোদনা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর ‘মওদুদীবাদ’, তথা ‘ধর্মের নামে রাজনীতি’। জামায়াত ৭১-এ যেভাবে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী যাবতীয় অপরাধকে ইসলামের নামে বৈধতা দিয়েছিল- তারা এবং তাদের দেশি-বিদেশি সহযোগীরা এখন নির্বাচন বানচালের জন্যও তাই করছে। যে কারণে জামায়াত গংয়ের সন্ত্রাসী রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের কোনও বিকল্প নেই।


মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ৭২-এর সংবিধানের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো স্পষ্ট মুদ্রণ দ্বারা ধর্ম নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা। পৃথিবীর অনেক দেশেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে থাকে বাস্তবতায়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে যে ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে, তা সত্যিই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বলা হয়েছে সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার বিলোপ করা হবে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে রাষ্ট্র কোন ধর্মকে বিশেষ প্রশ্রয় দান করবে না, কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারি ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর উৎপীড়ণ করা যাবে না।


তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া-মোস্তাক চক্র বন্দুকের জোরে, সংবিধান বহির্ভুতভাবে ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭২ সালের সেই পবিত্র এবং অনন্য সাধারণ সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ মুছে ফেলে। জিয়া গংদের সামরিক স্বৈরশাসন এবং পরবর্তী জিয়া অনুসারীরা জিয়া কর্তৃক সংবিধানে যে সব অবাঞ্ছনীয় পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, ৫ম এবং ৭ম সংশোধনী মামলা রায় দ্বারা সেগুলো বাতিল করা হয়। সাংবিধানিক অর্থে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখিত দুই মামলার রায়ে জিয়া এবং এরশাদের সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানে যে সব অনাকাঙ্খিক্ত পরিবর্তন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাময় বৈশিষ্ট্যসমূহ মুছে ফেলে একে ধর্মান্ধ রূপ দেয়া হয়েছিল- সেগুলো থেকে সংবিধানকে মুক্ত করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে যে এই পন্থায় ক্ষমতা দখল রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামান্তর এবং ভবিষ্যতে কোন অতি অভিলাষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ এ ধরনের অপপ্রয়াস চালালে তাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে। তবে এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম তত্ত্ব এখনো বলবৎ রয়েছে যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক।


পোল্যান্ড-এর নেভার এগেইনের সভাপতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রাফাল প্যানকোভস্কি বলেন, ‘নেভার এগেইন’-এর প্রচারণার কারণে পোল্যান্ডের নতুন সংবিধানে বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করা হয়- যার ফলে ১৯৯৭ সালে প্রণীত সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বিশেষভাবে বর্ণবাদী কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যেমন ভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭২-এর সংবিধান প্রণয়নের সময় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সন্নিবেশিত করেছিলেন। যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে- যা এই সংবিধানকে পৃথিবীর উৎকৃষ্ট সংবিধানগুলোর মধ্যে পরিগণিত করেছে।


যারা বাংলাদেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন মন্তব্য করে তার বক্তব্য শেষ করেন।


নেভার এগেইনের সদস্য মানবাধিকার নেতা নাটালিয়া সিনায়েভা প্যানকোভস্কা বলেন, বাংলাদেশের সকল সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিধান বঙ্গবন্ধু করেছিলেন ৭২-এর সংবিধানের মাধ্যমে। যেখানে বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই সমান অধিকার ভোগ করতে পারবেন। বাংলাদেশের সংবিধানে যেভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংবিধানে এত স্পষ্টভাবে তা দেয়া হয়নি। এখানেই বাংলাদেশের সংবিধান একক ও অনন্য। আমরা চাই বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা অব্যাহত থাকুক।


গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, জিয়াউর রহমান ও এরশাদ বন্দুকের নলের মুখে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর। সংবিধানকে কাটাছেড়া করে দেশকে মৌলবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন তারা। অথচ এই সংবিধান ছিল হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের রক্তে অর্জিত সংবিধান। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চাইলে আমাদেরকে ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে।


সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, বঙ্গবন্ধু আজীবন রাজনীতি করেছেন বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। বাংলাদেশে সাংবিধানিক ধারা বজায় রাখতে হলে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।


বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মো. মোখলেসুর রহমান বাদল বলেন, ৭২-এর সংবিধান গণমানুষের সংবিধান। এই সংবিধান বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে রচনা করেছেন। একটি মহল আজ এই সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। এই সংবিধান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের সংবিধান। যেকোনো এ সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে হবে।


সভায় বক্তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে যে বিস্ময়কর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন মহাযজ্ঞ চলমান রয়েছে একে নির্বিঘ্ন করতে হলে বঙ্গবন্ধুর ৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জামায়াতে ইসলামীসহ ৭১-এর গণহত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীদের ধর্মের নামে সন্ত্রাসের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।


বিবার্তা/রোমেল/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com