ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশও!
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:৩৬
ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশও!
সানজিদা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+

বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকির তালিকায় অনেক আগে থেকেই ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশ সামনের সারিতে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বহুতল ভবন নির্মাণে নির্দেশনা না মানা, ভবন ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি উঁচু করে বানানো- এসব খুবই সাধারণ বিষয়।


নগরায়নের সাথে যুক্ত সকল সংস্থা ও এসব তদারককারী সংস্থার ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরোও বলেন, যতটুকু তদারকি হয় সবই রুটিন ওয়ার্ক। 


বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি একশো বছর পরপর ভূগর্ভস্থ সঞ্চিত শক্তি ভুমিকম্পের মাধ্যমে বের হয়ে আসে। যার মাত্রা ও প্রভাব হয় তীব্র ও ভয়াবহ। বাংলাদেশে সর্বশেষ ১৮৯৭ সালে ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প’ হয়, যার মাত্রা ছিল ৮.১। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা, রাজশাহীতে। যেহেতু ১৮৯৭ এর পরে বিগত একশো বছরে বড় কোনো ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয়নি, সেহেতু বাংলাদেশ বর্তমানে ভয়াবহ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।



ভূমিকম্প বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক প্রেজেন্টেশনে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার ৭৬ ভাগ সড়ক সরু। এখানে বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ বা ভূমিকম্প আঘাত হানলে এক হাজার ১১২ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে।



বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বিবার্তাকে  বলেন, গত ৯০ বছরের মধ্যে আমাদের দেশে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। আমরা বলি অতীতে হয়েছে বর্তমানেও হতে পারে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশে যে ভূমিকম্প হচ্ছে সেগুলো আমাদের জন্য ঝুঁকি না, সতর্কবার্তা।


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘আজ ভোরে তুরস্কের সীমান্তে ভয়াবহ ভুমিকম্পে তুরস্ক আর সিরিয়াতে শত শত মানুষ মারা গেছেন। ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে আছেন আরও অনেকে। মৃতের সংখ্যা অনেক বাড়বে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৮। আমাদের বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন, বিল্ডিং বানানোর নিয়ম কানুন না মানা, বিল্ডিং ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি উঁচু করে বানানো, নরম মাটি কিংবা আনস্টেবল জায়গায় বিল্ডিং বানানো এইসব এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 



যদি এরকম মাত্রার একটা ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয়, তাহলে কি ঘটবে বলে মনে হয়? ঢাকা আর চট্টগ্রামের অর্ধেকের বেশি বিল্ডিং টিকে থাকবে বলে মনে হয়? বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। মৃত্যুর হার কি রকম হবে সেটা চিন্তাও করা যায় না। কারো মনে এইসব নিয়ে চিন্তা নেই। সাময়িক টাকা বাঁচাতে কিংবা বেশি লাভের জন্য যে বাড়ি বানাচ্ছি আমরা, যে উঁচু বিল্ডিং-এ থাকছি আমরা, এর পরিনতি কেউ ভাবছে না। যারা বিল্ডিং বানাচ্ছে তাদের মাথা ব্যাথা নেই, যারা নিয়ম মানা হচ্ছে কিনা দেখার দায়িত্বে  আছে, তাদেরও মাথা ব্যাথা নেই বলেই মনে হচ্ছে। অন্য কোন দেশে এত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং আছে? আশে পাশে এমন কিছু বিল্ডিং দেখি যেগুলো থেকে পলেস্তারা, দেয়ালের অংশ খসে পড়ছে, থাকার উপযোগিতা হারিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু এখনো মানুষ বাস করছে। 



আল্লাহ আমাদের সহায় না হলে এরকম বিপর্যয় আমরা কতটা কাটিয়ে উঠতে পারব জানিনা। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি চিন্তা করছেন না। 


তুরস্কের ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত সকল মানুষকে আল্লাহ এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করুন। আমাদের দেশকে রক্ষা করুন। আমাদের দুর্ভাগা মানুষগুলোর জন্য আর কেই-বা আছেন?’


ইনজেনিয়াস ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েটস বাংলাদেশ বিবার্তাকে জানায়, প্রায় ৮৪ বছর পর ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে, যার রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। এতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হাজারের ওপরে হয়েছে। আহত হয়েছে পনের হাজারের বেশি। অনেকে এখনও ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছে। বাংলাদেশের এমন ঘটনার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।


যার লক্ষণ ইদানিংকালের ছোট বা মাঝারি ভূমিকম্প। বড় কোনো ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশেরর অবস্থা হবে কল্পনার বাইরে। যেহেতু আমাদের দেশের বেশিরভাগ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ অনুসরণ করা হয় না। আর সামান্য কিছু খরচ কমানোর জন্য প্রফেশনাল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে ভবন এর নকশা করাতে গড়িমসি করা হয়। যেখানে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের ভবন নকশার সময় মূল লক্ষ্যই থাকে ভূমিকম্পে যাতে তাৎক্ষনিক ভবন ভেঙ্গে না পরে। মানুষের জানমাল যেন নিরাপদ থাকে এবং সেই সাথে যাতে অর্থনৈতিক সাশ্রয় হয়। শুধু নকশা নয়, নকশা পরবর্তী ভবন নির্মাণে থাকতে হবে গুণগত মানের পর্যবেক্ষণ। তবেই একটি ভবনের আয়ু ১০০ বছরের উপরে যেতে পারে। তাই ভবন নির্মাণ ইচ্ছুক সকলের উচিত নিজের কষ্টের টাকায় বাড়ি করার পূর্বে অভিজ্ঞ ও নিবন্ধিত প্রকৌশলীর কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া।


বাংলাদেশের নগরায়ন ও নগর পরিকল্পনায় মাটির প্রকৃতি, ভূমিতলের উচ্চতা, ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রভৃতিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। রাজধানী ঢাকার নগরায়ন প্রক্রিয়ায় জলাশয়-জলাভূমিকে ভরাট করে আবাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য নগর দুর্যোগের শঙ্কা বাড়ছে বহুলাংশে। 


বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিয়ে ভূমির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই নগরায়ন নিশ্চিত করবার পাশাপাশি দুর্যোগে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ আয়োজিত ‘ঢাকা শহরের ভূ-প্রকৃতি এবং অভ্যন্তরীণ ভূতাত্ত্বিক বিন্যাস এর নগর পরিকল্পনাগত প্রভাব’ শীর্ষক পরিকল্পনা সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এসব মতামত দেন। আজ ৭ ফেব্রুয়ারি  বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে  এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়।


সেমিনারে অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, রাজউকের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট (ইউআরপি) এর মাধ্যমে ঢাকা শহরের মাটির প্রকৃতি ও ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন করবার রূপরেখা দেয়া হয়েছে। সামনের দিনের পরিকল্পনায় এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়েই নগরের সম্প্রসারণ ও টেকসই নগরায়ন নিশ্চিত করতে হবে। 


বিভাগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এ কে এম আবুল কালাম বলেন, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন নগর দূর্যোগের প্রস্তুতির জন্য সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করবার পাশাপাশি সারা বাংলাদেশের ইমারত নির্মাণ যেন যাবতীয় নির্মাণ মানদণ্ড মেনে করা হয়। এজন্য জাতীয় বিল্ডিং কোড এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। 


পরিকল্পনা সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আনিসা নূরী কাকন, ড. মেহেদী হাসান, অধ্যাপক কাশফিয়া নাহরিন, ড. ফরহাদুর রেজা, এস এম নওশাদ হোসেন প্রমুখ।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহফুজুল হক বিবার্তাকে বলেন, ঢাকার নগরায়ন প্রক্রিয়ায় পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের যেসব এলাকায় নগরায়ন হয়েছে, সেসব এলাকার মাটির বৈশিষ্ট্য ও ভূতাত্ত্বিক গঠন নগরায়নের উপযোগী নয়। ফলে ভূমিকম্প হলে বছিলার মত এলাকায়  দূর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা বেশি থেকে যায়।


তিনি আরো বলেন, ঢাকার ভূমিতলের উচ্চতা ৫-১৮ মিটার এর মধ্যে এবং এই অঞ্চলের অনেক স্থানে ভবন নির্মাণ ও নগরায়নের জন্য উপযোগী লাল মাটি বিদ্যমান আছে। আবার অনেক এলাকায় প্রাকৃতিক ভাবেই নিচুভূমি, জলাশয় ও ভূঅভ্যন্তরে পানি ধারণ অঞ্চল বা একুইফার আছে। যথাযথভাবে ভূমি উপযোগিতা বিশ্লেষণ না করে বর্তমানে নগরায়ন হওয়াতে সামনের দিনে নগর দূর্যোগের শংকা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যথাযথ বিবেচনায় না নেয়াতে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের যে প্রকল্প ও উদ্যোগ চলমান আছে, সেগুলোর মাধ্যমে কার্যকর উপযোগিতার পাবার সম্ভাবনাও কম। 


ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি), নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বিবার্তাকে বলেন, ভবন নির্মাণে যেমন বিল্ডিং কোড ও পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট আইন মানা হচ্ছে না, তেমনি প্রভাবশালীদের চাপে নগরায়ন হচ্ছে স্বেচ্ছাচারীভাবে। ফলে সাময়িকভাবে কেউ কেউ লাভবান হতে পারলেও প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে সম্মিলিতভাবে কেউ রেহাই পাবে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে হাওর এলাকার বন্যায় সিলেটের কেন্দ্রীয় নগর এলাকাও বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল। 


রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (উন্নয়ন-১) মো. মোবারক হোসেন বিবার্তাকে বলেন, রাজউকের অভ্যন্তরে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদন, অনুমোদিত নকশার আলোকে নির্মাণাধীন ও নির্মিত ভবন এবং তার ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য বিদ্যামান আইন ভঙের কারণে মাসব্যাপী উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম শুরু করেছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এসব কার্যক্রম পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। 


বিবার্তা/সানজিদা/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com