বাড়তি দামে বই, মেলায় কাটতি কেমন হবে?
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৩:৩১
বাড়তি দামে বই, মেলায় কাটতি কেমন হবে?
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

আজ অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ এর শুভ উদ্বোধন। গত দুইবছর করোনা মহামারীর কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত থেকে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না করতে পারলেও আজ তিনি উপস্থিত থেকে মেলা উদ্বোধন করবেন। মাসব্যাপী এই আয়োজনের প্রতীক্ষায় থাকে  লেখক, প্রকাশক, পাঠকগণ। কিন্তু কাগজসহ বই তৈরির সব উপকরণের দাম বাড়ায় বইমেলায় নতুন বই প্রকাশ ও  বিক্রি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন প্রকাশকরা। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন হওয়ায় মানুষের বই কেনার বাজেটও কমবে এবং মূল বৃদ্ধির কারণে বই কেনার আগ্রহ হারাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।


কলেজ শিক্ষক মো. আবু হুরায়রা বিবার্তাকে বলেন, অমর একুশে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করছি। নতুন নতুন বই বের হবে। গত বছর মেলা হলেও মূলত দুই বছর পর নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এবার পুরোদমে বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে।


বইয়ের বাড়তি দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন দেশে কোন জিনিসটার দাম বাড়েনি বলেন? নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে সবকিছুর দাম বেড়েছে। তাই বইয়ের দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। তবে তা সবার সাধ্যের মধ্যে থাকতে হবে। এতে আমার মনে হয় তেমন প্রভাব পড়বে না। বইপ্রেমীরা বই কিনতে বইমেলায় আসবেন।


অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মো. মাজহারুল ইসলাম ফারুক বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বিবার্তাকে বলেন, মানুষ এমনিতে সৃজনশীল বই কম কিনে। কারণ সৃজনশীল বইয়ের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ কম। তাই বইয়ের দাম বাড়লে পাঠকদের আরও আগ্রহ কমে যেতে পারে।


তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও সবকিছুর দাম বেড়েছে। আমি যদি সেই ভাবে চিন্তা করি- কাগজসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে তাই বইয়ের দাম বাড়বে। কিন্তু তা শুধু আমাদের মতো পাঠকদের কাঁধে এসে পড়ে। এ ছাড়াও খরচ বেড়ে যাওয়ায় কাগজ, ছাপা, বাঁধাইসহ বই প্রডাকশনের মান কমে যাবে। অর্থাৎ টাকা বাঁচাতে বইগুলো হয়তো নিম্নমানের হবে।


কাগজসহ বই তৈরির সকল উপকরণের দাম বেড়েছে। ফলে এবার প্রকাশকরা বই ছাপছেন তুলনামূলক কম। এতে বেশিরভাগ কাগজ ব্যবসায়ীসহ ছাপাখানা ও বাইন্ডিং কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটা বসে দিন পার করছেন।



মেসার্স বি এম পেপার হাউজের ব্যবসায়ী মো. রাশেদ হাসান বিবার্তাকে বলেন, করোনার কারণে গত তিন বছর ধরে প্রকাশকরা তেমন বই ছাপেনি। কাগজসহ প্রকাশনা সামগ্রীর সবকিছুর দাম বাড়তি হওয়ায় তাদের বই ছাপানোর তেমন আগ্রহ নেই। তারপরও গত বছর আমরা এক ‘চলন্তিকা প্রকাশনী’র কাছেই ৮০ লাখ টাকার মতো কাগজ বিক্রি করেছি। অথচ এবার বেচা-বিক্রি নেই বললেই চলে। 


তিনি বলেন, বাংলা কাগজের দাম কম-বেশি দ্বিগুণ বেড়েছে। গতবছর যে কাগজ ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার তা  ৪৫০০ টাকা। বই ছাপার কাগজের চাহিদা বেশি থাকায় দামও অনেক বেশি। বর্তমান বাংলা কাগজের দাম ছাড়িয়ে গেছে বিদেশি কাগজকে।  


রাজধানীর বাংলা বাজার, ফকিরাপুল, নীলক্ষেত, বাবুবাজরের বেশিরভাগ প্রেসের কারিগরদের অলস বসে থাকতে দেখা যায়। রাইয়ান প্রিন্টার্সের মো. হাসান মিয়া বিবার্তাকে বলেন, আর দুয়েক দিন পর বইমেলা। তারপরও তেমন কোনো কাম নাই। কাগজের দাম বাড়ছে, সাথে সবকিছুর দামই বাড়ছে। কাম নাই বললেই চলে। কাম না হইলে তো মালিক আমাগো রাখব না। এখনও আশায় আছি কাম পাবার।  মেলা তো অনেকদিন হবে।


তবে ইউনিভার্সেল বাইন্ডিংয়ে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। এখানে সবাই বইমেলার বই তৈরির কাজে ব্যস্ত। কেউ ভাঁজ করছে, কেউ সেলাচ্ছে। কেউ আঠা লাগাচ্ছে, আবার কেউ বাঁধাই করছে, কেউ কাভার লাগাচ্ছে, যেন দম ফেলার সময় নেই।


ইউনিভার্সেল বাইন্ডিংয়ের স্বত্ত্বাধিকারি মো. আসলাম বিবার্তাকে বলেন, আগের থেকে বাইন্ডিংয়ের খরচ বেড়ে গেছে। বই তুলনামূলক কম  হচ্ছে। মেলা শুরু না হলে তো বুঝা যাবে না। কমপক্ষে ১০ দিন গেলে বুঝা যাবে বই কত কম  হলো।


তিনি বলেন, কাগজসহ বই তৈরির সব উপকরণের দাম বাড়ায় ফকিরাপুল, বাবুবাজার, বাংলা বাজারসহ কোথাও বই ছাপা নিয়ে কোনো ধরনের চাপ নাই আসলে। মেলাকে কেন্দ্র করে আগে প্রতিবছরই কারখানাগুলোতে সবাই  কাজে ব্যস্ত থাকত। অথচ এ বছর নানা সংকটে অনেকে বসে বসে সময় পার করছেন। কাগজসহ বিভিন্ন মালামালের সংকট আছে, অনেক সমস্যা আছে। আমরা তো একটু ব্যতিক্রম কাজ করি, ভালোভালো কাজ করি। যার কারণে আমাদের এখানে একটু কাজ দেখা যাইতেছে। তাও আবার একাজ এক সপ্তাহ পরে কমে যায় কি না, এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন মো. আসলাম। 



বই বাঁধার কাজ করছেন মো.আজমল হোসেন। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আগে একটি বই বাঁধাই করতে ২৫ টাকা খরচ হতো। এখন তা বেড়ে ৩০-৩৫ টাকা হয়েছে। তবে তা বিভিন্ন সাইজের আছে, মোটা, পাতলা ইত্যাদি। সাইজ অনুযায়ী বাঁধার টাকা। গড়ে প্রতি বই বাঁধাইয়ে আগের থেকে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। 


ইত্যাদি প্রকাশনীর প্রকাশক আদিত্য অন্তর বিবার্তাকে বলেন, কাগজের পাশাপাশি ছাপা, বাইন্ডিং সবকিছুর দাম বাড়তি। তাইএ বছর বইমেলায় বইকম ছাপা হবে। শুধু আমরা না বেশিরভাগ প্রকাশকরা বইমেলায় তুলনামূলক কম বই প্রকাশ করছেন।  


তিনি বলেন, বইয়ের দাম আগের থেকে বাড়বে। দেশে সবকিছুর দাম আগের থেকে বেড়েছে। বই তৈরির সকল উপকরণের দাম বেড়েছে। তারপরও পাঠকের কথা চিন্তা করেই বইয়ের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। যাতে পাঠকরা বই কিনতে অনাগ্রহী না হয়।  


কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমরা দীর্ঘ তিন বছর থেকে ঠিকভাবে বইমেলা করতে পারছি না। মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলা করলেও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কবলে পুরো বিশ্ব। যার ফলে আমাদের দেশেও কাগজসহ সকল পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই বইয়ের দাম কিছুটা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। 


তবে বইয়ের দাম বাড়ার কারণে বই কিনতে পাঠকের আগ্রহে ভাটা পড়বে বলে মনে করেন সেলিনা হোসেন। তিনি বলেন, তবুও আমি আশা করছি সবাই মিলে সৃজনশীল বই কিনবে, পড়বে ও অন্যকে পড়তে উৎসাহী করবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ভালো বই উপহার দিলে তাদের মেধা বিকাশে কাজে আসবে।


এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বিবার্তাকে বলেন, কাগজসহ সকল উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। এতে বইয়ের দামও বাড়বে। আর বইয়ের দাম বাড়লে তার শতভাগ প্রভাবপাঠকদের ওপর পড়বে। আবার বই ছাপাতে কেউ লোকসান দিয়ে তো আর বাড়ি থেকে পয়সা এনে বই ছাপিয়ে মার্কেটিং করবে না।  



বেশি দরে কাগজ কিনে, বেশি দামেই বই বিক্রি করতে হবে বলে জানান শহীদ সেরনিয়াবাত। তিনি বলেন, শুধু তো কাগজের দাম বাড়েনি, প্লেটের দাম বাড়ছে, কালির দাম বাড়ছে, আঠার দাম বাড়ছে, বাইন্ডিংয়ের দাম বাড়ছে, বলা যায় সবকিছুর দাম বাড়ছে। এটা যে শুধু বাংলাদেশে তা না, এটা বৈশ্বিক সমস্যা। তার পরও এটার চাপ পুরোটা পাঠক বা সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। 


এ বিষয়ে গণগ্রন্থাগারের পরিচালক মোছা. মরিয়ম বেগম বিবার্তাকে বলেন, বৈশ্বিক সংকটে বিশ্বের সব দেশেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। যার কারণে আমাদের দেশেও কাগজসহ বই তৈরির সব উপকরণের দাম বেড়েছে। বেড়েছে বইয়ের দামও। যার প্রভাব সরাসরি পড়বে সাধারণ পাঠকের ওপর। বইয়ের দাম বাড়ায় পাঠকরা বই কিনতে অনাগ্রহী হয়ে পড়বে। এতে পাঠকরা লাইব্রেরিতে আসবে বই পড়তে। কারণ লাইব্রেরি বিনামূল্যে বই পড়ার জায়গা।


বইয়ের দাম বাড়লে গণগ্রন্থাগার বই কেনার পরিমাণ কমাবে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বই যে দামই হোক আমরা সে দামেই বই কিনব। বইয়ের গায়ে যে দাম দেওয়া থাকে আমরা তা থেকে ৩০ শতাংশ কমিশন দিয়ে বই কিনি। আমরা প্রকাশকদের কখনই দাম কমাতে বলি না। বইয়ের দাম কম হলে কিনব আর বেশি হলে কিনব না- আমরা এমন করি না। 


নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামবৃদ্ধি এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবার বই বিক্রি কম হতে পারে বলে মনে করছেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর।


মিনার মনসুর বিবার্তাকে বলেন, কাগজের দাম বাড়ার কারণে ধরেন বইয়ের দাম বাড়বে। আবার ধরেন মানুষের জীবনযাত্রার ওপরও তো প্রেশার যাচ্ছে, সবকিছুর দাম বেশি। সারা পৃথিবীজুড়ে একটা মন্দা চলছে। এখন বইয়ের ওপর কতটা প্রভাব পড়ে বলা মুশকিল। আমাদের নরমালি কি কি হয়, আমার যদি টাকা কম থাকে, আমরা খাবারের দিকে মনোযোগ দিই। আরেকটু থাকলে হয়তো স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেই, কাপড়-চোপরের দিকে মনোযোগ দেই। এসব চাহিদা শেষে টাকা বাড়তি থাকলে তখন বই বা বিনোদন করি আর কি। এসব বিবেচনায় বই বিক্রি একটু কমতে পারে বলে মনে হয়। বইয়ের দাম বাড়ার কারণে এবং মানুষ যে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আছে, এই কারণে বই বিক্রি খানিকটা কম হতে পারে। 


গ্রন্থকেন্দ্রও কি বই কম কিনবে? এমন প্রশ্নে মিনার মনসুর বলেন, আমাদের বই কেনার বাজেট তো সরকারের কাছ থেকে অনেক আগেই পাস হয়ে যায় । এসব পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই আমাদের বই কেনার বাজেট হয়ে গেছে। দুবছর আগে থেকে বাজেট ঠিক করা থাকে, কোনো মন্ত্রণালয়ের বাজেট কত হবে। বই কত টাকার কিনবে। আমাদের যে টাকা নির্ধারিত ছিল তা দিয়েই বই কেনা হবে। আমরা যে বইগুলো কিনব সেগুলো ইতোমধ্যে প্রকাশিত। ২০১৯, ২০২০, ২০২১, ২০২২ সালে যে বই প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো কিনব। সে বইগুলোর ক্ষেত্রে দাম কিন্তু আগেরটাই আছে। দাম বাড়বে ২০২৩ সালের যে বইগুলো বের হবে সেগুলো। 


জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর আরও বলেন, আমাদের নীতিমালায় আছে আমরা প্রতিবার তিন বছর আগের বইগুলো কিনি। প্রতি বছর জুলাই মাস পর্যন্ত কাউন্ট করি আমরা। তাই আমাদের ক্রয়কৃত বইয়ের সংখ্যা আগের মতোই থাকবে। 


বিবার্তা/রিয়াদ /রোমেল

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com