রাজধানীর সড়ক দখল করে গাড়ি পার্কিং
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫৭
রাজধানীর সড়ক দখল করে গাড়ি পার্কিং
এস এম রিয়াদ রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

চালক গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে আছেন। অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছেন। সড়কে সাইকেল থেকে শুরু করে রিকশা, প্রাইভেটকার, বাস, ট্রাক এমনকি ফুটপাতে মানুষের ভিড় ঠেলে সামনে যাওয়া যাচ্ছে না। ভিড় ঠেলে সামনে এগুতেই দেখা গেল সড়কের দুপাশে গাড়ি পার্কিং করে রাখা। একপাশে রাখা বিভিন্ন কোম্পানির বাস, অন্যপাশে প্রাইভেটকার, ভ্যান ও পিকাপ। রাস্তার দুপাশে গাড়ি রাখায় সংকীর্ণ হয়ে আসা মাঝের সড়কটুকু দিয়েই চলছে যানবাহন। সেখানে আবার সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়ি থেকে মালামাল নামানো হচ্ছে। কুরিয়ার সার্ভিসের কয়েকটা গাড়ি ভেতরে ঢুকতে ও বেড় হতে দেখা গেল। আর এতেই পুরো সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। বলছি রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সামনের সড়কের কথা। সাধারণ মানুষ বলছেন, এসব এখানকার নিত্যদিনের চিত্র। অবশ্য শুধু মতিঝিল এলাকা নয়, রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার সড়কেই এমন চিত্র দেখা যায়।


রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোর পার্কিং বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করায় সড়ক হয়ে উঠেছে গাড়ি রাখার অন্যতম স্থান। যে যেখানে পারছে, সেখানেই (সড়কে) পার্কিং করছে। অনেকেই মেট্রোরেলের নিচের সড়কের ডিভাইডারের দুপাশেই লাইন করে মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন গাড়ি রেখেছেন। যেন সড়কগুলোকে পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত করে দেওয়া।


মতিঝিলের আরামবাগ-কমলাপুর সড়ক, দৈনিক বাংলা মোড়ের চারপাশের সড়ক, প্রেসক্লাব-মতিঝিল সড়কসহ আশপাশের সব সড়কে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং ও ভাসমান দোকানের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে রাস্তা অনেকটাই সরু হয়ে গেছে। আবার সড়কে রিকশা-ভ্যান, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, পিকআপ, বাস, ট্রাক সড়কের দুই পাশে এক লাইনে রাখা হয়েছে। কিছু জায়গায় দুই-তিন লাইন করে রাখতেও দেখা গেছে।



পুলিশ বলছে, সড়ক দখল করে গাড়ি রাখা নিয়ে তাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। তারপরও সড়কে গাড়ি পার্কিং থামানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন বলছে, অবৈধভাবে সড়ক দখল করে যারা গাড়ি পার্কিং করছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম চলমান।



সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মতিঝিলের প্রাণকেন্দ্র শাপলা চত্বরের চারপাশ বিভিন্ন যানবাহনের পার্কিংসহ টং দোকানপাটে ঠাসা। শাপলা চত্বর পুলিশ বক্সের পাশেই সড়কে পুলিশের একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে আরও অনেক মোটরসাইকেল রাখা। কমলাপুর রোডের দুপাশেই সারি করে রাখা হয়েছে অনেক বাস ও প্রাইভেটকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফটকের সামনের সড়কে ব্যাংকের কিছু স্টাফ বাস রাখা হয়েছে। ফটকের দুপাশে গড়ে উঠেছে শীতের পোশাকসহ বিভিন্ন ভাসমান দোকান। পাশেই অনেক মোটরসাইকেল পার্ক করে রাখা এবং চালকরা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন যাত্রী ধরার?



রাজধানীর সচিবালয়, গুলিস্তান, মগবাজার, শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, সাইন্সল্যাব, নিউমার্কেট এলাকায় অবৈধভাবে সড়ক দখল করে গাড়ি পাকিং করে রাখতে দেখা যায়।  আবার কোথাও কোথাও কার মেকানিক ওয়ার্কশপগুলো সড়কের ওপর গাড়ি মেরামত করছে। জায়গা কম থাকায় তারা ফুটপাত ও সড়ক অবৈধভাবে দখল করে ব্যাবসা করছে।  


মতিঝিল এলাকার প্রতিটি ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ভবনের সামনের সড়কে প্রাইভেটকার পার্কিং করে রাখা। জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ২০-২৫টি প্রাইভেটকার পার্কিং করা। কাজ শেষ করে আরোহী সড়কের মাঝেই গাড়িতে উঠছেন। সেখানে প্রাইভেটকার পরিস্কার করছিলেন চালক মো. কাওছার মিয়া। তার সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, ভেতরে  গাড়ি রাখার জায়গা নেই, তাই রাস্তায় রাখতে হয়। আর বাইরে পার্কিং করতে টাকা বেশি লাগে। তাই স্যার রাস্তার পাশে সাইড করে রাখতে বলেছেন।


গোপীবাগের স্থানীয় বাসিন্দা স্কুলশিক্ষিকা নুশরাত জাহান বিথি বিবার্তাকে বলেন, আগে প্রতিদিন আমি বাসা থেকে হেঁটে স্কুলে যেতাম। কিন্তু মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে রিকশায় করে আসতে হয়। রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি রাখা থাকে। ফুটপাত হকারদের দখলে। ফলে হেঁটে আসা সম্ভব হয় না।


তিনি বলেন, মেট্রোরেলের স্টেশনের নিচে হাঁটার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তাছাড়া সেখানে সবসময়ই অন্ধকার থাকে। আর মলমূত্রের দুর্গন্ধ তো আছেই। তার নিচে বিভিন্ন গাড়ি সারিবদ্ধ করে রাখায় রাস্তা দিয়ে একটি গাড়ি এলে আর জায়গা থাকে না, অনেক ঝুঁকি। যারা চলাচল করে তারা জানে কি খারাপ অবস্থা। দ্রুত এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।


পথচারী শাহরিয়ার কবির বিবার্তাকে বলেন, গাড়িগুলো এমনভাবে পার্কিং করে রাখা যেন এসব রাস্তা পার্কিংয়ের জন্যই করা। এসব গাড়ির কারণে মানুষ ঠিকভাবে চলাচল করতে পারে না। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে।


তিনি বলেন, এসব গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবে সড়কে রেখে যানজট তৈরি করছে। যা মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। এটা প্রতিদিনের ঘটনা। অথচ এ নিয়ে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।


মতিঝিল শাপলা চত্বর পুলিশ বক্সের পাশে দায়িত্বরত একজন ট্রাফিকের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পুলিশ বিবার্তাকে বলেন, আমরা মাঝে-মধ্যে রাস্তায় রাখা গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান চালাই। জরিমানা করি, মামলা দেই, তারপরও থামানো যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ, এই বাণিজ্যিক এলাকায় যে পরিমাণ গাড়ি আছে তার তুলনায় পার্কিংয়ের জায়গা নেই বললেই চলে। তাই জরিমানা বা রেকার করার পরেও অনেকে সড়কে গাড়ি রাখছে।


এ নিয়ে মতিঝিল ট্রাফিক জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এস. এম. বজলুর রশীদ বিবার্তাকে বলেন, সড়কে কোনো গাড়ি থাকে না। যাত্রী উঠা-নামা করার সময় গাড়িগুলা দাঁড়ায়। এ ছাড়া যেহেতু এটি বাণিজ্যিক এলাকা। যখন ব্যাংক চলে তখন ব্যাংকের লোকজন কিছু গাড়ি রাখে। এখানে সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত পার্কিং এরিয়া ইজারা দেওয়া আছে, তারা এগুলোর ব্যবস্থা রেখেছে। এখানে পুলিশের কিছু করার নাই।


ডিএমপি ট্রাফিক মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোল্লা তবিবুর রহমান খান বিবার্তাকে বলেন, সড়ক দখল করে গাড়ি রাখা নিয়ে আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। পাশাপাশি আপনাদের জানিয়ে রাখা উচিত, কিছু কিছু জায়গায় আবার অনিশ্চিত পার্কিং আছে সিটি করপোরেশনের। এসব পার্কিং বাণিজ্যিক এলাকায় দেখবেন, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনে, নটরডেমের সামনে, পলওয়েল, কমলাপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় আছে। এটা সিটি করপোরেশন কিছু অনিশ্চিত পার্কিং দিয়েছেন।


এর বাইরে যারা সড়কে গাড়ি রাখে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে, যা সবসময় অব্যাহত থাকবে বলে জানান মোল্লা তবিবুর রহমান খান।


ডিএমপি অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক অ্যাডমিন এন্ড রিসার্চ) শাহ আলম বিবার্তাকে বলেন, সড়কে এসব গাড়ি রাখার জন্য প্রচুর মামলা দেয়া হয়, জরিমানা করা হয়। তারপরও কিছু কিছু মানুষ গাড়ি রাস্তায় রাখে। আমরা তো মামলা দেওয়ার ব্যাপারে বলি তাদেরকে। তারপরও রাখা কমে না।



এ নিয়ে ডিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) পুলিশের ডিসি মনিবুর রহমানের সাথে কথা হয় বিবার্তার। তিনি বলেন, রাজধানীতে সিটি করপোরেশন পার্কিংয়ের দায়িত্বে আছে। সিটি করপোরেশনকে বার বার বলা হয়েছে, সড়কে যাতে গাড়ি না রাখা হয়। সিটি করপোরেশন দায়িত্বটা নিলে আমাদের জন্য কাজটা সহজ হয়। তারা অনেক জায়গায় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। স্মার্ট পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, এগুলার চাহিদা অনেক বেশি। তারাও চেষ্টা করছে, আমরাও বলছি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাটা আরও সমন্বিত রাখা দরকার। পার্কিংয়ের সমন্বয় যদি ভালো হয় এবং এটা যদি কার্যকরী করা হয়, তখন এটা ফলপ্রসু হবে।


তিনি বলেন, সড়কে গাড়ি রাখলে তা দেখার দায়িত্ব ট্রাফিক ম্যানেজম্যান্টের। কিন্তু বেশিরভাগ ভবনের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নেই, তাই সড়কে রাখছে। পার্কিং নির্ধারণ করার দায়িত্ব আমাদের। সিটি করপেরেশন যদি যে পরিমাণ গাড়ি আছে তা রাখার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারে, তাহলে  আমরা এসব গাড়ি পার্কিংয়ে পাঠিয়ে দিতে পারব।


মনিবুর রহমান বলেন, যারা অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করছে আমরা তাদের জরিমানা করছি, মামলা দিচ্ছি। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় সিটি করপোরেশনের পার্কিংয়ের জায়গা আছে। এসব পার্কিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধারা আছে, এগুলো তো উনারা নির্ধারণ করেন। উনারা যদি আমাদের সাথে বসে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে এসব কাজ করে তাহলে জিনিসটা আরও ফলপ্রসূ  হবে।


রাজধানীতে পার্কিংয়ের নির্ধারিত জায়গা নেই বলেই সড়কে পার্কিং করছে বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তা মনিবুর রহমান। তিনি বলেন, এজন্য সিটি করপোরেশনকে পার্কিংয়ের জন্য যথপোযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। বেইজম্যান্ট পার্কিং, দ্বিতল পার্কিং, বহুতল পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। স্মার্ট পার্কিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এগুলো যখন আলোচনা হয়, আমাদের নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ আছে, তখন দুপক্ষ বসে যদি এসব সঠিকভাবে সমন্বয় করা যায়- তবেই এ থেকে মুক্তি মিলবে।


দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাসের বিবার্তাকে বলেন, সড়কে গাড়ি পার্কিং নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মাঝে মাঝেই অভিযান পরিচালনা করে। যারা রাস্তা দখল করে গাড়ি রাখে তাদেরকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়, মামলা পর্যন্ত দেয়া হয়। তারপরও অনেকে এসব অমান্য করে রাস্তায় গাড়ি রাখছেন।


তিনি বলেন, যারা অবৈধভাবে সড়ক দখল করে গাড়ি পাকিং বা দোকানপাট করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


এ নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বিবার্তাকে বলেন, সড়ক দখল করে যেখানে গাড়ি পার্কিং করা হয়, সেসব জায়গায় আমাদের মোবাইল কোর্ট কাজ করে। কিন্তু অনেক সময় মোবাইল কোর্ট চলে আসার পর আবার তারা সড়কে গাড়ি রাখে। রাস্তা ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য উত্তর সিটি করপোরেশন খুব সিরিয়াস। এ নিয়ে আমরা নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। সারা ঢাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় জোরদারকরণ ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ কার্যক্রম চলবে।


প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরো বলেন, অবৈধভাবে সড়ক দখল করে রাখায় কোথাও কোথাও নিয়মিত মামলা দেওয়াসহ বেশকিছু কার্যক্রম আমাদের চলমান আছে। আমরা আশা করছি যে, এ বিষয়গুলো কমে আসবে।


সেলিম রেজা বলেন, সড়কে গাড়ি কোনো অবস্থাতেই রাখার সুযোগ নাই। এখন সব জায়গায় সবসময় তো এগুলো ধরা যায় না। তারপরও সিটি করপোরেশনসহ অনেকগুলো সংস্থা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি পুলিশ বিভাগ কাজ করছে, বিআরটিএসহ অনেকে কাজ করছে। আমরা বিশ্বাস করি আস্তে আস্তে তা কমে আসবে।


অবৈধভাবে সড়ক দখল করে যারা গাড়ি পার্কিং করছে তাদের বিরুদ্ধে উত্তর সিটি করপোরেশন যথপোযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানান মো. সেলিম রেজা।


বিবার্তা/রিয়াদ/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com