করোনা মহামারিতে বেসরকারিখাতে নিয়োজিত পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং দোকান শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, আয় ও সামাজিক নিরাপত্তার ওপর বেশ প্রভাব পড়েছে। মহামারীকালে সরকারঘোষিত লকডাউনে ঢাকা শহরের পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং দোকান শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮১ শতাংশ। ওই সময়ে চাকরি হারিয়েছেন ৮৭ শতাংশ শ্রমিক এবং কর্মক্ষেত্র থেকে খাদ্য, অর্থ সহযোগিতা পেয়েছেন ৪৮ শতাংশ শ্রমিক। চাকরি হারানো শ্রমিকদের ৭ শতাংশ এখনো বেকার এবং গড়ে তাদের আয় কমেছে ৮ শতাংশ। আর সরকার থেকে এসব শ্রমিকের ১২ শতাংশ নানা সহযোগিতা পেয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ‘ঢাকা শহরের পরিবহন, দোকান-পাট এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের উপর সাম্প্রতিক লকডাউনের প্রভাব নিরূপন’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায়। বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে বিলস’র সেমিনার হলে এই গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক (গবেষণা) মোঃ মনিরুল ইসলাম।
বিলস’র গবেষণায় দেখা যায়, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং দোকান এই তিন খাতে ৯৬ শতাংশই পুরুষ শ্রমিক কাজ করছেন। আর নারী শ্রমিকের অধিকাংশই দোকানে কাজ করেন। শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ আবার বিবাহিত। আর শিশুশ্রমিক ৫ শতাংশ। এসব শ্রমিকদের ১৩ শতাংশের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
গবেষণায় বলা হয়, কোভিড-১৯ এর ফলে ৯৯.৫ শতাংশ শ্রমিকই লকডাউনের ফলে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৮৭ শতাংশ শ্রমিকের কর্মসংস্থান কমে গেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবহন খাতের শ্রমিকদের ৯৫ শতাংশ, দোকান পাট শ্রমিকদের ৮৩ শতাংশ এবং হোটেল-রেস্তোরা খাতের শ্রমিকদের ৮২ শতাংশ কর্মসংস্থান হারান। কর্মদিবস কমেছে ৮৪.৬ শতাংশ। আর কর্মঘণ্টা কমেছে ৯২ শতাংশ শ্রমিকের। এছাড়া লকডাউন পরবর্তী সময়ে ৯৩ শতাংশ শ্রমিক তার কাজ ফিরে পেয়েছে। এখনো ৭ শতাংশের বেশি শ্রমিক কাজ পায়নি। তবে লকডাউন সময়ে এসব খাতে খণ্ডকলীন শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বেড়েছিলো ২১৫ শতাংশ।
অন্যদিকে লকডাউনে তিনটি খাতে কার্যদিবস কমেছিল ৭৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৯২ শতাংশ কার্য দিবস কমেছে পরিবহন খাতে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে অবশ্য কাজের চাপ বেড়েছে, কার্যদিবস এবং কর্মঘন্টা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে।
সংস্থাটির গবেষক মনিরুল জানান, কোভিডের কারণে ৮৩ শতাংশ সেবাদানকারী ও ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসময় হয় তারা তাদের সেবা বা ব্যবসা বন্ধ করেছেন নয়তো ব্যবসার পরিসর কমিয়েছেন। ৯৫ শতাংশ বাস ও লেগুনা এবং ৮০ শতাংশ দোকান বন্ধ ছিল সেসময়। এই তিন ধরনের শ্রমিকদের ৫১.৫ শতাংশই ছিলেন চাকরি হারানোর চিন্তায়।
তিনি আরো জানান, লকডাউনে তিনটি খাতের শ্রমিকদের আয় গড়ে ৮১ শতাংশ কমেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবহন খাতের শ্রমিকদের ৯৬ শতাংশ এবং হোটেল-রেস্তোরা খাতের শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। যেখানে লকডাউনের আগে মাসিক গড় আয় ছিলো ১৩৫৭৮ টাকা সেটা লকডাউন সময়ে নেমে এসেছিলো ২৫২৪ টাকায় এবং লকডাউন পরবর্তী সময়ে আয় দাঁড়িয়েছে ১২৫২৯ টাকা। অর্থাৎ লকডাউন পরবর্তী সময়েও ৮ শতাংশ আয়ের ঘাটতি থাকছে।
লকডাউনে শ্রমিকদের পরিবারে আয় এবং ব্যয়ের ঘাটতি ছিলো প্রায় ৭৭ শতাংশ, সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশ পরিবহন খাতের এবং সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ রয়েছে খুচরা দোকান বিক্রেতা খাতের শ্রমিক পরিবারের। ২০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার সম্পত্তি বিক্রয়, খাবার কমিয়ে দেয়া এবং সন্তানদের কাজে পাঠানোর মাধ্যমে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেছেন। এছাড়া ৮০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার ধার করে এবং সঞ্চয় কমিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করছেন। লকাডাউন পরবর্তী সময়ে সঞ্চয় কমেছে ৬৪ শতাংশ এবং সঞ্চয়কারীর সংখ্যা কমেছে ৫০ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য এসব শ্রমিকের ৩৬ শতাংশ করোনার টিকা গ্রহণ করেছেন। তবে লকডাউন পরবর্তী সময়ে মাস্ক ব্যবহার কমেছে ৬৪.৩ শতাংশ।
গবেষণায় আরো দেখা যায়, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং দোকান শ্রমিকদের ৭৯ শতাংশই কোনো শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত নন। এদের ৪৩.৩৪ শতাংশই মনে করেন স্বাভাবিক সময়ে শ্রমিক ইউনিয়নের কোনো দরকার নেই।
করোনা মহামারিতে বেসরকারিখাতে নিয়োজিত পরিবহন শ্রমিক, হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিক এবং দোকান শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরে সংস্থাটি-
১. বেসরকারিখাতে কর্মরত শ্রমিকদের একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেস প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় বাজেট সংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি, একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনার আওতায় বেসরকারিখাতের শ্রমিকদের ক্রমান্বয়ে পেশা উল্লেখসহ পরিচয়পত্র প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
২. দুর্যোগকালে বেসরকারিখাতে কর্মরত শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য শ্রম অধিদপ্তরের দায়িত্বে একটি বিশেষায়িত ‘মানবিক সহায়তা কর্মসূচি’ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্যের মধ্যে, ‘মানবিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি’ এবং ‘মানবিক অর্থ সহায়তা কর্মসূচি’ এ বিশেষায়িত ‘মানবিক সহায়তা কর্মসূচি’র অন্তর্ভূক্ত থাকবে। এ লক্ষ্যে প্রথমে একটি বিশেষায়িত ‘ফান্ড’ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। শ্রমিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এ বিশেষায়িত ‘মানবিক সহায়তা কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের বিধান প্রণয়ন করতে হবে। কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্যোগসমূহে শ্রমিক প্রতিনিধিদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. দুর্যোগকালে বেসরকারিখাতে কর্মরত শ্রমিকদের সহায়তার জন্য একটি সঠিক ও কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শ্রম অধিদপ্তরকে মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্ব দিতে হবে। শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় প্রতিষ্ঠা ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার বিষয়সমূহকে সুষ্পষ্ট করতে হবে।
৪. অগ্রাধিকারভিত্তিতে বেসরকারিখাতের শ্রমিকদের করোনা টিকা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া, বেসরকারিখাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের করোনা চিকিৎসার সুযোগ ও সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে, শ্রমঘন এলাকাসমূহে বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৫. দুর্যোগকালে চাকরি হারানো বেসরকারিখাতের শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বেকার ভাতা সুবিধা প্রদানের বিশেষ বিধান প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৬. বেসরকারিখাতের শ্রমিকদের স্বল্পমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহের জন্য অনতিবিলম্বে রেশনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
৭. বেসরকারিখাতের শ্রমিকদের সামাজিকভাবে সুরক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৮. দুর্যোগকালে বেসরকারিখাতের শ্রমিকরা যাতে ‘শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পেতে পারেন, তার আইনগত বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া, দুর্যোগকালে শ্রমিকের অনুকূলে ব্যাংক ঋণের শর্তসমূহ শিথিল করার জন্য আইনানুগভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৯. বেসরকারিখাতে কর্মরত শ্রমিকদের দূর্যোগকালে চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সকল পক্ষের সমন্বয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে, শ্রমিকদেরকে নিয়োগপত্র প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
১০. বেসরকারিখাতে ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম শক্তিশালী করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সদস্য চাঁদা নিয়মিত আদায় ও তার সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
বিলস’র গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের সময় আরো উপস্থিত ছিলেন জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও বিলস’র ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল হক আমিন, বিলস’র পরিচালক কোহিনূর মাহমুদ, নাজমা ইয়াসমীন প্রমুখ।
বিবার্তা/জাহিদ বিপ্লব/আশিক
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]