শিরোনাম
ঢাকায় ফেরা মানুষের গল্প
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২১, ১০:৪২
ঢাকায় ফেরা মানুষের গল্প
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

করোনাভাইরাসের ঊর্দ্ধমুখী সংক্রমণ এবং মৃত্যু ঠেকাতে কঠোর বিধিনিষেধ চলার মধ্যে রবিবার (১ আগস্ট) খুলছে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানা। ব্যবসায়ীদের অনুরোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শুক্রবার (৩০ জুলাই) এই সিদ্ধান্ত আসার পরপরই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষেরা।


দুর্ভোগ আর বাড়তি ভাড়া মেনে নিয়েই তারা যে যেভাবে পারছেন কর্মস্থলে পৌঁছাতে ছুটছেন রাজধানীতে।


শেরপুরের নালিতাবাড়ি থেকে বের হয়ে ভেঙে ভেঙে অটোরিকশায় ময়মনসিংহ আসতে পারভীনের খরচ হয় ৭০০ টাকা। ময়মনসিংহের বাইপাসে এসে কেনো গাড়ি না পেয়ে অটোরিকশায় ওঠেন তিনি। গন্তব্য ভালুকা।


পারভীন জানান, এটায় ভালুকা যাবো। ভাড়া দিতে হবে ২০০ টাকা। পরে সেখান থেকে অন্য কোনো উপায়ে গাজীপুর যাবো।


বাস না চলায় পথের দুর্ভোগের পাশাপাশি বাড়তি খরচটাও পোড়াচ্ছে তাকে। ভালুকার পরে কীসে যাবেন, সেটা অনিশ্চিত, কত খরচ হবে, সেটাও জানেন না; তবু যেতে হবে। কারণ মহামারীর এই দুঃসময়ে চাকরি নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি মাঝবয়সী পারভীন।


তার মতো হাজার হাজার কর্মী ও শ্রমিক কাজে যোগ দিতে দীর্ঘ অনিশ্চিত যাত্রা জেনেও পথে নেমেছেন। করোনাভাইরাসের ঝুঁকির চেয়েও চাকরি ঠিক রাখাই তাদের কাছে বড় বিষয় বলে জানাচ্ছেন তারা।


ভেঙে ভেঙে শত শত মাইল পাড়ি দেয়ার পথে কখনো হেঁটে, কিছুপথ রিকশা-অটোরিকশায়, সুযোগ পেলে পিকআপ ভ্যানের পেছনে দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করেই কর্মক্ষেত্রে ফিরতে দেখা গেছে রফতানিমুখী শিল্পকারখানার এসব কর্মীকে।


নাটোর থেকে খুব ভোরে সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি কখনো পায়ে হেঁটে কখনো মোটরচালিত রিকশায় আবার কিছুপথ সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে গাবতলী পৌঁছেন।


রাজধানীর পোস্তগোলায় ইউনাইটেড অ্যাপারেলস নামের একটি কারখানায় মাত্র কয়েকমাস আগেই চাকরি নিয়েছেন রাকিব (ছদ্মনাম)। পাশে শোভন গ্রুপের আরেকটি কারখানায় চাকরি করেন তার স্ত্রী।


রাকিব জানান, ফ্যাক্টরি থেকে আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ১ অগাস্ট থেকে কারখানা খোলা, আপনারা চলে আসতে পারেন। নতুন চাকরি, নতুন সংসার। তাই বিলম্ব না করে চলে আসলাম।


কারখানা খুললেও লকডাউন শেষ হওয়ার আগে না এলেও কারো চাকরি যাবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।


তবে রাকিব জানান, আমরা ভেবেছিলাম ৫ অগাস্টের আগে কারখানা খুলবে না। কিন্তু হঠাৎ করে খুলে দিলো, আবার গাড়িও ছাড়লো না। সে কারণেই ভোগান্তিটা হলো। আমি না থাকলে আমার জায়গা আরেকজন দখল নেবে। তখন চাকরিটা থাকবে কী করে?


নাটোর থেকে তিন হাজার টাকা খরচ করে গাবতলী এসেছেন তারা। এখন ৫০০ টাকায় একটি রিকশা ভাড়া করে কদমতলী পোস্তগোলার পথ ধরেছেন।


এদিকে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকায় আসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া এবং শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে চলাচলকারী প্রতিটি ফেরিতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। গাদাগাদি করে মানুষ পদ্মা পার হচ্ছেন ফেরিতে করে। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। যে যেভাবে পারছেন ফেরিতে করে পদ্মা পার হচ্ছেন।


ফেরি পার হওয়ার পরে আবারো গাড়ির সংকটে পড়ছে মানুষ। বিকল্প উপায়ে বিভিন্ন যানে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে ভেঙে ভেঙে কর্মস্থলে ফিরছেন মানুষ। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পাটুরিয়া ঘাট থেকে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল ও সিএনজিতে জনপ্রতি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা গুণতে হচ্ছে যাত্রীদের। যেখানে গণপরিবহন থাকলে মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় ঢাকায় ফেরা যায়। অনেকে যানবাহন না পেয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।


রাজবাড়ী থেকে ঢাকার উদ্দেশে ফেরির জন্য অপেক্ষা করা নাজমা আক্তার জানান, আজ থেকে কারখানা খোলা। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে কাজে যোগ দিতে হবে। তাই পথে পথে দুর্ভোগ নিয়ে তিনি ঢাকায় ফিরেছেন। তার মতো হাজারো পোশাক শ্রমিক সকাল থেকে ভিড় করেছেন পাটুরিয়া ঘাটে। তাদের অনেকে যানবাহন না পেয়ে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।


বিআইডব্লিউটিসি আরিচা ঘাটের ডিজিএম জিল্লুর রহমান জানান, কারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণায় শনিবার সকাল থেকে ঢাকায় ফেরা মানুষের ঢল পড়েছে। এই নৌ-রুটে সাতটি ফেরি দিয়ে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে।


পাটুরিয়ার মতো শিমুলিয়া ঘাটেও মানুষের ভিড় দেখা গেছে। করোনা মহামারির কারণে চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে লঞ্চ, স্পিডবোট ও ট্রলার চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীদের চাপ বেড়েছে ফেরিতে। বাংলাবাজার ঘাট থেকে যেসব ফেরি ঘাটে আসছে তাতে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করেই পারাপার হচ্ছেন ঢাকামুখী যাত্রীরা।


অন্যদিকে, ঢাকার অন্যতম প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকাতেও এমন চিত্র দেখা গেছে।


ঢাকায় ফেরা মানুষরা জানিয়েছেন, তাদের ফোন করে জানানো হয়েছে, ১ আগস্ট থেকে গার্মেন্টস খুলছে। তাই চাকরি বাঁচাতে পথে সীমাহীন ভোগান্তি পাড়ি দিয়ে চলে এসেছেন তারা। ভাড়াও গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বেশি। বাস চালু না করে হঠাৎ করেই শিল্প-কারখানা খুলে দেয়ার এ সিদ্ধান্তে তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।


সকাল থেকে সাইনবোর্ড এলাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় ফেরা মানুষের ভিড় লেগেই আছে। হাতে-মাথায়-কাঁধে ব্যাগ। তাদের মধ্যে অসংখ্য নারী ও শিশু। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাস বন্ধ থাকায় লোকজন মূলত ভেঙে ভেঙে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, পিকআপভ্যান, অটোরিকশা, হেঁটে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন।


গার্মেন্টসকর্মী ফারজানা, রফিকুল ইসলাম ও মাসুদসহ আরো অনেকেই জানান, ভোরে রওনা দিয়ে কয়েক দফায় ভেঙে ভেঙে নানা পরিবহন ও হেঁটে এলেঙ্গা পর্যন্ত, সেখান থেকে আবার অন্য পরিবহনে ঢাকায় আসতে হয়েছে। গাড়ি না পেলে এখন হেঁটে কর্মস্থলে ফিরতে হবে। চাকরি বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে হচ্ছে। পশু পরিবহনের চেয়েও গাদাগাদি করে কর্মস্থলে ফিরতে হচ্ছে তাদের।


এদিকে এই ভোগান্তির মধ্যেও আবার প্রাকৃতিক বৈরি পরিবেশের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে পরিবার-পরিজন নিয়ে যাওয়া মানুষজনের।


বিবার্তা/বিদ্যুৎ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com