শিরোনাম
যেভাবে গ্রেফতার করা হলো ডা. সাবরিনাকে
প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২০, ২১:১০
যেভাবে গ্রেফতার করা হলো ডা. সাবরিনাকে
খলিলুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। শুধু তাই নয়, সরকারি চাকরিজীবী হয়েও তিনি জেকেজির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে সাবরিনা নিজেকে জেকেজির ‘চেয়ারম্যান নয়’ বরং প্রতিষ্ঠানটির ‘কোভিড-১৯ বিষয়ক পরামর্শক’ বলে পুলিশের কাছে দাবি করেন। কিন্তু ওই দাবির কোনো ধরনের প্রমাণ না মেলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আগামীকাল আদালতের মাধ্যমে তাকে রিমান্ডে আবেদন করা হবে। রিমান্ডে এনে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এমনটা জানা গেছে।


সূত্রমতে, রবিবার (১২ জুলাই) দুপুরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তেজগাঁও বিভাগীয় উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) কার্যালয়ে ডাকা হয়। এ সময় কয়েক ঘন্টা তাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে বারবারই অস্বীকার করছিলেন যে তিনি জেকেজির চেয়ারম্যান নন। এক পর্যায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়।


পুলিশ জানায়, গত ২৩ জুন তেজগাঁও থানায় দায়েরকৃত মামলায় (মামলা নং ২৩, ধারাঃ ১৭০, ২৬৯, ৪২০, ৪০৬, ৪৬৬, ৪৭১, ৩৪ দন্ডবিধি) ছয় জন আসামিকে গ্রেফতার হয়। তারা অর্থের বিনিময়ে করোনা টেস্ট এর নামে ভুয়া করোনা রিপোর্ট সরবরাহের কাজে জড়িত ছিল। তারা প্রত্যেকেই জেকেজি গ্রুপের সাথে জড়িত যাদের মধ্যে জেকেজি গ্রুপের সিইও আরিফুল চৌধুরীও ছিল।


আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু তথ্য পাওয়া যায়। বিস্তারিত তদন্তে ও গ্রেফতারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জেকেজি গ্রুপের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। জেকেজি গ্রুপের চেয়ারম্যান থাকাকালীন তার জ্ঞাতসারেই করোনা উপসর্গ থাকা রোগীদের নিকট থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো ধরণের ল্যাব পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া রিপোর্ট প্রস্তুতপূর্বক তা রোগীদের কাছে সরবরাহ করা হত।


এছাড়া প্রথম আসামি হুমায়ুন কবীরকে গ্রেফতারের পরপরই তড়িঘড়ি করে ব্যাকডেটে ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরীসহ আরো দুই জন আসামিকে জেকেজি গ্রুপ থেকে অপসারণ করা হয়- যা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।


ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে জেকেজি গ্রুপের মুখপাত্র হিসেবেও নিজেকে ইতোপূর্বে উপস্থাপন করেছেন। একজন চাকরিরত সরকারি কর্মচারী হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্বপালন করতে পারেন কি না- তাও তদন্তে বের হয়ে আসে। ঘটনার সাথে জড়িত থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত যাচাইবাছাই এর জন্য বিজ্ঞ আদালতে রিমান্ড প্রার্থনা করা হবে এবং তদন্ত শেষে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ।


তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে উনাকে (ডা. সাবরিনা) প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনি কি জেকেজির চেয়ারম্যান?’ উনি বললেন, ‘না, আমি কখনোই চেয়ারম্যান না।’ আমি (ডিসি হারুন) বললাম, কয়েক দিন আগেই তো আপনাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিষ্কার করলো। তাছাড়া আপনি তিতুমীর কলেজের ঘটনায় দাঁড়িয়ে জেকেজির পক্ষে কথা বললেন, মুখপাত্র হিসেবে, চেয়ারম্যান হিসেবে কথা বললেন। সেটা কী ছিল?’


উত্তরে সাবরিনা বলেন, ‘সেটা আমার হাসব্যান্ড (জেকেজির সিইও আরিফুল হক চৌধুরী) আমাকে বলতে বলেছিল।’


জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে ডিসি হারুন বলেন, জেকেজির কর্মকাণ্ড ও তার কর্মকাণ্ড নিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। আমরা মনে করি, যে কোম্পানি মানুষকে ক্ষতি করছে, যারা করোনা নেগেটিভকে পজিটিভ আর পজিটিভকে নেগেটিভ বানাচ্ছে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে আমরা তাকে গ্রেফতার করি।


সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, যেহেতু তিনি (ডা. সাবরিনা) একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, তিনি কোনোভাবেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান থাকতে পারেন না, আবার চেয়ারম্যান থাকাকালীন সেই কোম্পানির মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য দিতে পারেন না। উনি যেহেতু ফেসবুকেও জেকেজির পক্ষে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তাই জেকেজির কর্মকাণ্ডের দায়দায়িত্ব তিনি এড়াতে পারেন না। এ কারণেই তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনা হচ্ছে।


ডিসি হারুন আরো বলেন, ২২ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে আটক করে পুলিশ। হিরু আমাদের জানায়, সে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের ডিজাইন তৈরি করতো। এই ভয়ানক তথ্য জানার পর আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি এর সাথে কারা জড়িত। সে স্বীকার করেছে, কোর্টেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে যে ভুয়া রিপোর্টের সাথে জেকেজি গ্রুপের লোকজন জড়িত।


ডিসি হারুন বলেন, তখন জেকেজির সিইও আরিফুলসহ চারজনকে আটক করি। গ্রেফতার সিইওকে আমরা জিজ্ঞেস করি, ‘এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কে?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী।’ এরপর একে একে ছয়জনই এক উত্তর দিলেন।


তাকে গ্রেফতার করতে কেন সময় নেয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি হারুন বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছিলাম। তদন্ত কর্মকর্তা গ্রেফতারের জন্য একটু সময় নিয়েছে, যেহেতু সাবরিনা চৌধুরী একজন ডাক্তার, একজন সরকারি কর্মকর্তা।’


উল্লেখ্য, ঢাকা, নায়ায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল সাবরিনা-আরিফ দম্পতির জেকেজি প্রতিষ্ঠান। নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ দেয়া ছিল। তাদের হটলাইন নম্বরে রোগীরা ফোন দিলে মাঠকর্মীরা বাড়ি গিয়েও নমুনা সংগ্রহ করতেন। আবার অনেককে জেকেজির বুথের ঠিকানা দেয়া হতো। এভাবে কর্মীরা প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতো।


পরে তাদের গুলশানের একটি ভবনের ১৫ তলার অফিসের একটি ল্যাপটপ থেকে ভুয়া সনদ দিত। ওই ল্যাপটপ থেকে জেকেজির কর্মীরা রাতদিন শুধু জাল রিপোর্ট তৈরির কাজ করতো। প্রতিটা সনদের জন্য নেয়া হতো পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিদেশিদের কাছ থেকে নেয়া হতো ১০০ ডলার। যদিও শর্ত ছিল বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করে সরকার নির্ধারিত ল্যাবে পাঠাতে হবে। কিন্তু তারা সব ধরনের শর্তভঙ্গ করে পরীক্ষা ছাড়াই রিপোর্ট দিত।


বিবার্তা/খলিল/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com