শিরোনাম
বিপ্লবী আশালতা সেন
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২০:২৮
বিপ্লবী আশালতা সেন
কাজী সালমা সুলতানা
প্রিন্ট অ-অ+

আজ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী, স্বাধীনতা, কবি ও সমাজসেবক আশালতা সেনের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৯৪ সালে নোয়াখালী জেলায় এই সংগ্রামী নেতার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই আশালতা ভাল বাসতেন সাহিত্যকে। ১৯০৪ সালে মাত্র দশ বছর বয়সে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে মাসিক অন্তঃপুর পত্রিকায় তার লেখা দেশের কবিতা প্রকাশিত হয়। তার লেখা উচ্ছ্বাস, উৎস, বিদ্যুৎ ও ছোটদের ছড়া সে সময়ে প্রশংসিত হয়। জীবনের শেষ সময়ে তিনি আত্মজীবনী রচনা করেন।


আশালতা পারিবারিক পরিসরে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণা এবং নিজেকে গড়ে তোলার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছিলেন। তার মাতামহী নবশশী দেবী ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের কর্মী। তারই প্রেরণায় ও তত্বাবধানে আশালতা দাশগুপ্ত অল্প বয়সে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বিক্রমপুর অঞ্চলে স্বদেশী প্রচারের জন্য নবশশী দেবী, সুশীলা সেন, কমলকামিনী গুপ্তা প্রমুখ ‘মহিলা সমিতি’, ‘স্বদেশী ভাণ্ডার’ ইত্যাদি সংগঠন গড়ে তোলেন।


বিলাতি কাপড় বর্জনের সংকল্প-পত্রের স্বাক্ষর সংগ্রহের দায়িত্ব আশালতা দাশগুপ্তকে দেয়া হয়, তখন আশালতার বয়স মাত্র ১১ বছর। মাতামহী নবশশী দেবীর প্রেরণা ও তাগিদে স্বদেশী আন্দোলনে আশালতা দাশগুপ্তের সংগ্রামী জীবনের শুরু। তারই প্রেরণায় আশালতা দেশ-বিদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বই পড়ে স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে থাকেন। তবে ১৯১৬ সালে তার স্বামীর অকালমৃত্যুতে তিনি শিশু ছেলেকে নিয়ে বেশ কঠিন সময় কাটান। সন্তান বড় হলে আবারো তিনি স্বরূপে দীপ্তিমান হয়ে ওঠেন।


১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আশালতা সেন স্বরূপে উদ্ভাসিত হন, যুক্ত হন এই আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯২২ সালে ঢাকা জেলা প্রতিনিধি হিসেবে গয়া কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯২৫ সালে ‘নিখিল ভারত কাটুনী সংঘের সদস্য হন এবং খদ্দর প্রচারে নিয়োজিত হন।


নারীদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করা এবং গান্ধীজীর বাণী প্রচার করার লক্ষ্যে তিনি গঠন করেন গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি। এই সমিতির সদস্যরা নিজেরাই উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রয় ও প্রচারকার্য পরিচালনা করতেন। ১৯২৫ সালে তিনি নিখিল ভারত কাটুনী সংঘের সদস্য হন এবং ব্যাপকভাবে খদ্দর প্রচার শুরু করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকায় মহিলা কর্মী তৈরির উদ্দেশ্যে তিনি ‘কল্যাণ কুটির আশ্রম’ স্থাপন করেন। ১৯২৯ সালে গেণ্ডারিয়ার জুরাইনে শিক্ষাবিস্তারের উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘জুরাইন শিক্ষা মন্দির’।


আশালতা সেনের অসাধারণ সাহসের পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধীর ‘লবণ আইন’ অমান্য আন্দোলনের সময়। তিনি সরমা গুপ্তা, ঊষাবালা গুহ প্রমুখ সহকর্মীদের নিয়ে নোয়াখালী থেকে কিছু নোনা পানি ঢাকায় এনে সর্বসমক্ষে লবণ তৈরি করে আইন অমান্য আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং বাংলার নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে আন্দোলন সংগঠিত করেন। সে সময় তিনি তার সহকর্মীদের সাথে গ্রেফতার হন।


মহিলাদের আত্মসচেতন ও সংগঠিত করে তোলা ছিল আশালতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। তিনি অনুধাবন করতেন, দেশের জনসংখ্যার অর্ধাংশ নারীসমাজ যদি নির্লিপ্ত থাকে, তারা যদি পুরুষদের কাজে সহায়তা না করে তাহলে কোনো আন্দোলনই সফল হতে পারে না। তাই সেসময় তিনি অনেক নারী সংগঠন তৈরি করেন। জাগ্রত সেবিকাদল (১৯৩০, ঢাকা), রাষ্ট্রীয় মহিলা সংঘ (১৯৩১, বিক্রমপুর), নারীকর্মী শিক্ষা কেন্দ্র (১৯৩১, ঢাকা) এবং কংগ্রেস মহিলা সংঘ (১৯৩৯) সেসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


বিক্রমপুরের বিভিন্ন স্থানে মহিলা সংঘের কয়েকটি শাখাও স্থাপিত হয়। আশালতা রাজনৈতিক জীবনে দুইবার কারাভোগ করেন। ১৯৩২ সালে গান্ধীজীর গ্রেফতারের পর ঢাকায় আইন অমান্য আন্দোলন জোরদার হলে ‘গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি’কে বে-আইনি ঘোষণা করা হয় এবং ‘কল্যাণ কুটির’-এর কর্মীদের আবাসগৃহ পুলিশ তালাবদ্ধ করে রাখে। এর বিরুদ্ধে মহিলা কর্মীদের নিয়ে আন্দোলন ও প্রচারকার্য পরিচালনার সময় আশালতা গ্রেফতার হন। এসময় দুটি মামলায় তার সাজা হয়।


১৯৩৩ সালে মুক্তি লাভ করে তিনি ঢাকা জেলার কংগ্রেসের সহ-সভাপতি মনোনীত হন। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনে আশালতা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এসময় ঢাকায় পুলিশের গুলিতে এক যুবক নিহত হলে সেই প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তার সাড়ে সাত মাস সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেতে হয়।


আশালতা সেন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদ এবং ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাশাপাশি তার সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আশালতা সেন এ দেশের জনগণকে নানাভাবে সাহায্য করেন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কয়েকটি গানও রচনা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আমন্ত্রণে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন এবং ‘গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৮৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এই বিপ্লবী নারী ইহলোক ত্যাগ করেন।


বাংলার নারীমুক্তি আন্দোলন, ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করার আন্দোলনে তার অবদান চীর স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, লবণ আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলন এবং সর্বোপরি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই সংগ্রামী নারীর অবদান ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। বারবার কারানির্যাতন, শাসকের রক্তচক্ষু কোনোকিছুই তাকে দমাতে পারেনি। স্বজাতি, স্ব-সমাজ ও স্বদেশের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। অগ্নিকন্যা আশালতা সেন ইতিহাসে সত্যিই অমর।


লেখক: কাজী সালমা সুলতানা


বিবার্তা/বাণী/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com