শিরোনাম
বিড়ালের শহর
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:৪৯
বিড়ালের শহর
মূল : হারুকি মুরাকামি//অনুবাদ : মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ
প্রিন্ট অ-অ+

‘টোকিও স্টেশন’ ছেড়ে যাবার পর ‘টেঙ্গো’ তার সাথে নিয়ে আসা বইটা বের করলো। পেপারব্যাক প্রিন্ট। ভ্রমণ বিষয়ে লেখা অনেকগুলো ছোটগল্পের একটা অমনিবাস। গল্পগুলোর অন্তর্ভুক্ত আছে ‘বিড়ালের শহর’ শিরোনামের একটা গল্প। একজন জার্মান লেখকের লেখা, যার সাথে টেঙ্গো পরিচিত নয়। বইটির ভূমিকা অনুসারে গল্পটি লেখা হয়েছিলো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে।


এই গল্পে এক যুবক একাকী ভ্রমণ করছে; নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য ছাড়াই। সাধারণত সে ট্রেনে করে তার ভ্রমণ শুরু করে। পথিমধ্যে কোনো জায়গাকে আনন্দদায়ক মনে হলে সে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। একটা রুম ভাড়া করে। যতক্ষণ ভালো লাগে জায়গাটাতে ঘুরে বেড়ায় ও অবস্থান করে। দেখা শেষ হয়ে গেলে সে অন্য একটা ট্রেনে চড়ে বসে। ছুটিগুলো যুবক এভাবেই কাটায়।


একদিন সে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখতে পেলো সুন্দর একটা নদী। আঁকাবাঁকা। নদীটির পাশে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে একটা ছোট্ট শহর। একটা পুরানো পাথরের তৈরী সাঁকো দিয়ে নদী পার হয়ে সেই শহরে যেতে হয়। ট্রেনটা শহরের রেলস্টেশনে থামলে যুবক নেমে পড়ে তার ব্যাগ নিয়ে। সে ছাড়া আর কেউ নামে না। সে নামার পরেই ট্রেনটা চলে যায়।


রেলস্টেশনটায় কেউ নেই। সেটি অবশ্য কর্মব্যস্তও নয়।


সাঁকো পেরিয়ে যুবক শহরে প্রবেশ করে। শহরের সবগুলো দোকানপাট বন্ধ। এমনকি টাউনহলটাও জনশূন্য। শহরে একটাই হোটেল। সেখানেও কেউ বসে নেই। জায়গাটাকে দেখে মনে হয় জনবসতিহীন। শহরের লোকেরা সম্ভবত অন্যকোথাও দুপুরের খাবারের পর ভাতঘুম দিচ্ছে। কিন্তু এখন সময় তো সকাল সাড়ে দশটা মাত্র! দুপুরের খাবারের সময় আরো অনেক পরে। সম্ভবত কোনো দুর্ঘটনার কারণে এর অধিবাসীরা অন্যত্র চলে গেছে। শহর ছেড়ে। যা হোক। পরের ট্রেন আগামীকাল সকালের আগে আসবে না। সুতরাং এখানে রাত্রি যাপন করা ছাড়া যুবকের আর কোনো উপায় নেই।


আসলে শহরটা বিড়ালদের শহর। সূর্যাস্তের সময় হতেই অনেকগুলো বিড়াল সাঁকো অতিক্রম করে দলে দলে আগমন করতে থাকলো। বিভিন্ন প্রকারের এবং রঙবেরঙের। সাধারণ বিড়ালের চেয়ে এরা যথেষ্ট বড়, কিন্তু তারপরেও তারা বিড়ালই।


দৃশ্যটা দেখে যুবক হতবিহবল ও ভীত হয়ে গেলো। সে ছুটে গেলো শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত ঘন্টা টাওয়ারের (Bell Tower) দিকে। লুকানোর জন্যে সেটাতে চড়ে বসলো।


এদিকে বিড়ালরা এসেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দোকানের শাটারগুলো উন্মুক্ত করে দিলো। নিজদের ডেস্কে বসলো দিনের কাজ করার জন্যে। একটু পর সাঁকো পেরিয়ে আরো অনেক বিড়াল এলো। তারা দোকানে প্রবেশ করে জিনিসপত্র কিনলো। টাউন হলে গেলো বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজ করার জন্যে। অথবা রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খেলো। অথবা সরাইখানায় বসে বিয়ার পান করলো। এমনকি কেউ কেউ গানও গাইলো। যেহেতু বিড়ালেরা অন্ধকারে দেখতে পায়, সেহেতু তাদের কোনো আলোর প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু সেই রাতে একটা পূর্ণ চাঁদ শহরকে আলোকিত করে রেখেছিলো। ফলে যুবক বেল টাওয়ারের চূড়া থেকে সবকিছুই দেখতে পাচ্ছিলো। সকালের আলো ফোটার সময় বিড়ালেরা তাদের কাজ শেষ করলো এবং সাঁকো অতিক্রম করে ফিরে গেলো।


শহরটা পুনরায় নির্জন হয়ে গেলো। এবার যুবক নিচে নেমে এলো। হোটেলের একটা বিছানা নিলো এবং ঘুমিয়ে পড়লো। যখন তার ক্ষিধে পেলো, তখন সে হোটেলের রান্নাঘরে উচ্ছিষ্ট হিসেবে থাকা কিছু ব্রেড ও মাছ খেয়ে নিলো। আবার সন্ধ্যা হয়ে এলে সে বেল টাওয়ারের চুড়ায় গিয়ে লুকালো এবং পরবর্তী ঊষাকাল পর্যন্ত বিড়ালদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলো।


ট্রেন এখানে দু'বার থামে - একবার দুপুরের আগে, অন্যবার গোধূলির পূর্বে। যদিও কোনো যাত্রীকেই ট্রেনে ওঠানামা করতে দেখা গেলো না, তারপরেও ঠিক এক মিনিটের জন্যে ট্রেন থামলো ও পুনরায় চলে গেলো। সে এই ট্রেন দুটোর যেকোনো একটাতে করে চলে যেতে পারতো, কিন্তু যুবক তা করলো না। বয়স কম হবার কারণে তার ভেতরে প্রবল ঔৎসুক্য কাজ করছিলো এবং সে একটা অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো। এই অবাক-করা দৃশ্যগুলো সে আরো দেখতে চাচ্ছিলো। সম্ভব হলে সে এটাও আবিষ্কার করতে চাচ্ছিলো যে কখন, কিভাবে এই শহরটা বিড়ালের শহরে পরিণত হয়েছে!


তৃতীয় রাতে বেল টাওয়ারের নিচে একটা হট্টগোল শোনা গেলো, “তোমরা কি মানুষের গন্ধ পাচ্ছো?” একটা বিড়াল বললো।


“তুমি বলার পরে পাচ্ছি। আমি গত কয়েক দিন ধরেই একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছিলাম,” অন্য একটা বিড়াল সাড়া দিলো নাক চুলকাতে চুলকাতে।


“আমিও” আরেকটা বিড়াল বললো।


“ব্যাপারটা আসলেই অদ্ভুত। এখানে তো মানুষ থাকার কথা নয়, “ আরেকজন যোগ করলো।


“অবশ্যই না, মানুষদের পক্ষে কোনোভাবেই বিড়ালদের শহরে প্রবেশ করা সম্ভব না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে মানুষের শরীরের গন্ধই পাচ্ছি আমরা।“
অতঃপর বিড়ালেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে শহরময় অনুসন্ধান শুরু করলো। বেল টাওয়ারকে গন্ধের উৎস হিসেবে সনাক্ত করতে তাদের খুব-একটা সময় লাগলো না। যুবক বিড়ালদের পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। নরম পা দিয়ে তারা সিঁড়িপথ ধরে এগিয়ে আসছিলো। যুবক ভাবলো, “ওরা আমাকে ধরে ফেলেছে! মনে হচ্ছে আমার শরীরের গন্ধ বিড়ালদেরকে রাগান্বিত করেছে।“ বিড়ালগুলোর বড় ও ধারালো নখ আছে। যুবক ভেবে পেলো না তার জন্যে কি ভয়ঙ্কর নিয়তি অপেক্ষা করছে, কিন্তু সে নিশ্চিত যে তাকে তারা জীবন্ত মানুষ হিসেবে শহর ত্যাগ করতে দেবে না।


তিনটা বিড়াল বেল টাওয়ারের চূড়া পর্যন্ত উঠলো এবং বাতাসের গন্ধ শুঁকল। “আশ্চর্য”, একটা বিড়াল বললো, তার ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে,”আমি মানুষের গন্ধ পাচ্ছি, কিন্তু এখানে তো কেউই নেই।“


‘'ভীষণ অবাক করা কাণ্ড,” দ্বিতীয় বিড়ালটা বললো। “কিন্তু এখানে আসলেই কেউ নাই। চলো, আমরা অন্যকোথাও খুঁজি।“


বিড়ালেরা বিভ্রান্তভাবে তাদের মাথা নাড়লো এবং তারপর নিচের তলার দিকে নেমে গেলো। যুবক তাদের পায়ের শব্দকে অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে যেতে শুনলো। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, কিন্তু কিছুই বুঝলো না। বিড়ালদের তাকে খুঁজে না পাওয়ার কোনো কারণই নেই। কিন্তু কোনো একটা বিশেষ কারণে তারা তাকে দেখতে পায়নি। যাই হোক, সে সিদ্ধান্ত নেয় সকাল হলেই সে স্টেশনে যাবে এবং ট্রেনে করে এই শহর থেকে বেরিয়ে যাবে। ভাগ্য নিশ্চয়ই চিরকাল তার অনুকূলে থাকবে না।


পরদিন সকালে অবশ্য ট্রেনটা স্টেশনে থামলো না। সে দেখলো ট্রেনটা স্লো না হয়েই স্টেশন অতিক্রম করে চলে গেলো। বিকেলের ট্রেনটাও একই কাজ করলো। সে দেখতে পেলো ট্রেনের কন্ট্রোলে ইঞ্জিনিয়ার বসে আছে, কিন্তু ট্রেনটা থামার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। যুবকের কাছে তখন মনে হলো, সে যে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছে - তাও কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এমনকি স্টেশনটাকেও কেউই দেখতে পাচ্ছে না।


বিকেলের ট্রেনটা চলে যাবার পর একটা গভীর নির্জনতা নেমে এলো। সূর্য অস্তমিত হওয়া শুরু করলো। এখনই বিড়ালদের আগমনের সময়। এটা হলো সেই জায়গা, যা তার হারিয়ে যাবার জন্যে নির্ধারিত হয়ে ছিলো। এটা অন্য এক পৃথিবী, যা শুধু তার জন্যেই তৈরী করা হয়েছে। চিরন্তন সময়ের ভেতরে আর কখনোই এই স্টেশনে ট্রেন থামবে না, যে পৃথিবী থেকে সে এসেছে সেই পৃথিবীতে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে।


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com