বেলা দুপুর অতিক্রান্ত। ব্যস্ত শহরের অপেক্ষাকৃত একটি নিরিবিলি স্থান। সেখানের এক বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট এক কিশোর। পরনে চিট-চিটে, ময়লা-মলিন একটি ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। মলিন দেহ আর উদ্ভ্রান্তের মতো মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল। হাতে একখণ্ড পাউরুটি। পাশেই বেওয়ারিশ, কাবু-কাহিল একটি কুকুর। কিশোরটি রুটিখানা থেকে একটু করে দাঁত দিয়ে কেটে নিয়ে খাচ্ছে, আর একটু করে কুকুরটিকে খেতে দিচ্ছে। কুকুরটি মহানন্দে লেজ দোলাচ্ছে আর খাচ্ছে। ‘শেয়ার করলে আনন্দ বাড়ে, আর দুঃখ কমে’ - তত্ত্বটির বাস্তব প্রতিফলনের এই দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করার মতো। এভাবে নিজে খাওয়া আর কুকুরটিকে খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে রুটিখানা শেষ হয়।
ওই ধরনের বালককে বলা হয় ‘টোকাই’ বা ‘পথ-শিশু’। পিতামাতার যে স্নেহ, মায়া-মমতা আর আদর-যত্নের অভাবে সন্তানের জীবন মরুভূমির মতো শুষ্ক হয়ে যায়, এরা সেই অমূল্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত। মানব সমাজে এরা নিতান্ত আগাছার মতো অবহেলিত। এরা পথে-প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়, ‘ডাস্টবিনের’ নোংরা ঘাটে, আর পরিত্যক্ত পলিথিন, প্লাস্টিক, ছেঁড়া কাগজ, প্রভৃতির টুকরা সংগ্রহ করে। ওগুলো বিক্রি করে যা সামান্য অর্থ পায়, তা দিয়ে খাবার কিনে ও বেঁচে থাকে। পেটে তার ক্ষুধার আগুন। হয়তো সে আগুন নেভানোর জন্য ওই একখানা রুটি যথেষ্ট নয়। তবুও সে নিজে অতৃপ্ত থেকে ক্ষুধার্ত কুকুরটিকে রুটি দিয়ে সাহায্য করেছে এবং কুকুরটির তৃপ্তি আর আনন্দে নিজেও তৃপ্ত ও আনন্দিত হয়েছে। ভাবছি, ত্যাগ ও সহমর্মিতার চেতনায় সমৃদ্ধ এমন মহৎ-হৃদয় ওই নোংরা-ঘাটা, পথ-কুড়ানো বালকটি পেল কোথা থেকে!
আজ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মানুষের সংখ্যাধিক্যে ভারাক্রান্ত ও প্রকম্পিত। কিন্তু ওই ত্যাগী বালকটির মতো ক’জন আছেন? ত্যাগের পরিমাণটাই বড় কথা নয়, ত্যাগের প্রবৃত্তিটাই বড় কথা। সামর্থের তুলনায় ত্যাগ, এই অনুপাতটাই বিবেচ্য। ধনাঢ্য মহসিনের ত্যাগের মহিমা আর এই নিঃস্ব ক্ষুধার্ত বালকটির ত্যাগের মহিমায় পার্থক্য কতটুকু ? মনোমুগ্ধকর দ্যুতি ছড়ানো স্বচ্ছ হীরক জগতে দুর্লভ। আজ কেন যেন মনে হয়, ডাস্টবিনে জীবিকা-সন্ধানি ওই বালকটির মতো ত্যাগী মানুষও আমাদের সমাজে বড়ই দুর্লভ। হয়তো বলতে পারি- ওই নিঃস্ব, দুঃখী বালকটি মানব সমাজের এক উজ্জ্বল হীরক খণ্ড।
যে সমস্ত স্বার্থান্ধ মানুষের লুটপাট আর কুকর্মের ফলে দেশমাতৃকার কপালে দুর্নীতির কলঙ্ক তীলক, তারা কি এই লেখাটি পড়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও লজ্জা পাবেন না? মনে-প্রাণে সংশোধিত হওয়ার বিন্দুমাত্র কোনো তাগিদও কি অনুভব করবেন না? অপর দিকে দেশ ও সমাজের প্রগতির রশি যাঁদের হাতে, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ও লক্ষ্য যাঁদের জীবনে, তাঁরা কি ওই টোকাই বালকটির মতো সকল বাধা-বিঘ্ন ও হতাশা জয় করে ত্যাগে ও শুভ কর্মে আরও অনুপ্রাণিত হবেন না?
লেখক : সাবেক প্রধান শিক্ষক, বগিয়া সুভাষিণী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাগুরা
বিবার্তা/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]