আমাদের নজরুল নোবেল পাননি। নোবেল পাননি ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও ‘আন্না কারেনিনা’র মত জগৎ বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিকারী লিও তলস্তয়ও। তাই বলে কি সাহিত্যের ভুবনে নোবেলপ্রাপ্তদের থেকে এদের অবদান কম? মোটেই না। বরং অনেক নোবেল প্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকের চেয়ে নজরুল ইসলাম কিংবা লিও তলস্ততয়দের ভূমিকা বহুগুণ বেশি। হোক সেটা সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে কিংবা সাহিত্যের উদ্দেশ্যের ভিন্ন কোন আঙ্গিকে। কবি-সাহিত্যিকদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় পাঠকের মূল্যায়নকেন্দ্রিক ভালোবাসার দ্বারা। এরা নোবেল পাননি সেটা তাদের দুর্ভাগ্য নয় বরং নোবেল কমিটি এদেরকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সে দুর্বলতা তাদের বিচারশক্তির পরিপক্কতার যথার্থতার প্রশ্নের ওপরেই আপতিত হবে। কোটি কোটি পাঠকের ভালোবাসায় নজরুলরা প্রত্যহ নোবেল পান, ভালোবাসার নোবেল।
প্রেম, সাম্য ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি তাকে আজও মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং সার্বজনীন জীবনে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। গতানুগতিক কবি-সাহিত্যিকদের মত তিনি কেবল প্রেমবিরহের মাধ্যমে তাকে পাঠকের হৃদয়ে ভাবাবেগের খোরাক হিসেবে উপস্থাপন করেননি বরং জীবন্ত মানুষ হিসেবে তিনি অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, জেলে গিয়েছেন, মানুষের দুঃখ-সুখের ভাগীদার হয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অনশন করেছেন সর্বোপরি একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে ভূয়সী প্রশংসার ধারক হয়েছেন। নজরুল পূর্ববর্তী যুগে কোন কবি সাহিত্যিককে তার মত জাতীয় স্বাধীনতায় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। তার মত করে অন্য কেউ আর বলেনি, ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার।’ তাইতো কবির মাত্র ৩০ বছর বয়সে কলকাতা আলবার্ট হলে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি যে জাতীয় সংবর্ধনা পেলেন তা ওই বয়সে অপর কোন কবির ভাগ্যে জোটেনি। কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উত্থান সর্বগ্রাসী হওয়ায় সে বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা পাঠককে দু’তিন দিন বিমোহিত রাখলেও নজরুল তার বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশান উড়িয়ে হৈ হৈ করে এগিয়ে এলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো। কবিতার ইতিহাসে নজরুল উড়ালেন রেঁনেসার পতাকা।
নজরুল ইসলামের সৃষ্টির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এখানে কেউ ঘোড়া সওয়ারী হয়ে এগিয়ে যেতে পারবে না, গেলেও কিছু বুঝবে না। নজরুল পাঠ করতে হবে ধীরে ধীরে। কেননা তার চিন্তা কলমের যা প্রসব করেছে তার গভীরতা অনেক, অর্থ ব্যাপক। শুধু রসাস্বাদনের জন্য নজরুলের সাহিত্য নয়, এ সাহিত্যের রয়েছে দার্শনিক ভিত্তি। দর্শন যে কুসংস্কারের সকল বেড়াজাল ছিন্ন করে বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে যথার্থতা বাছাই করে সত্য আবিষ্কারে ব্রতী হয় নজরুলের সৃষ্টির প্রত্যেক পৃষ্ঠা, লাইন সত্য, সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণে অস্ত্রের মত কাজ করেছে। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে কবি বলে স্বীকার করেছেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কবিকে প্রতিভাবান মৌলিক কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন যখন কবির বয়স মাত্র ৩০।
মৌলিক কবিদের ভবিষ্যতবাণী সত্যের রূপে আবির্ভূত হয় বটে কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের বেলায় এ সত্য আরও উজ্জ্বল হয়ে ভবিষ্যত সম্পর্কিত বক্তব্য স্পষ্ট হয়েছে। ‘খালেদ’ কবিতায় তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা! মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরি বিভীষিকা!’ কিংবা ‘খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখ ওঠ/ শ্বেত শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মঠো!’ বর্তমান সমাজ ও বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে কি দারুণ মিল! আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া কবি সাহিত্যিকদের চিন্তা যখন অভিজাত কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সুখদুঃখকে কেন্দ্র করে আবির্ভূত হয়েছে তখন মানুষ ও মানবতার কবি, মাটি ও মায়ের কবি কাজী নজরুল বলেছেন সমাজের নিম্নস্থ নির্যাতিত মানুষের কথা। তিনি শোসকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শাসিতের পক্ষে অবিরাম লড়াই করেছেন। শ্রমিক-শ্রেণীর পক্ষে চোর-ডাকাত কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘রাজার প্রাসাদ উঠিয়ে প্রজার জমাট রক্ত ইঁটে, ডাকু ধনিকের কারখানা চলে নাশ করি কোটি ভিটে। দিব্যি পেতেছ খল কলও’লা মানুষ পেষানো কল, আখ পেষা হয়ে বাহির হতেছে ভুখারী মানব-দল!’ কুলী মজুর কবিতায় কবি বলেছেন, ‘আসিতেছে শুভ দিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ,.....তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে আমরা রহিব নীচে, অথচ তোমায় দেবতা বলিব, সে-ভরসা আজ মিছে।’
একটি সমাজকে সঠিকপথে পরিচালিত করার জন্য তরুণদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নজরুল ইসলাম সর্বদা নিজেকে তারুণ্যের কবি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ১৯৩২ সালে ৫ ও ৬ নবেম্বর সিরাজগঞ্জের নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতি’-রূপে কবির দেয়া অভিভাষণে তিনি য়ৌবনের গান গেয়েছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘আমি যৌবনের পূজারী কবি বলিয়াই যদি আমায় আপনারা আপনাদের মালার মধ্যমণি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার অভিযোগ করিবার কিছুই নাই। আপনাদের এই মহাদান আমি সানন্দে শির নত করিয়া গ্রহন করিলাম। আপনাদের দলপতি হইয়া নয়। আপানাদের দলভুক্ত হইয়া, সহযাত্রী হইয়া।’
জাতির বলিষ্ঠ কণ্ঠ তথা তারুণ্যকে উদ্বুদ্ধ করতে কবি তরুণদেরকে উদ্দেশ্যকরে বলেছেন, ‘আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত বন্ধন নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!’ কিংবা ‘ওরে ও তরুণ! ঈশান-বাজা তোর প্রলয় বিষাণ! ধ্বংস-নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচী’র ভেদি।’ কিংবা ‘ভোল্ রে চির পুরাতনের সনাতনের ভোল। তরুণ তাপস! নতুন জগৎ সৃষ্টি করে তোল ।’ কবির তারুণ্যকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে যে নতুন সমাজ ও সংস্কার সৃষ্টির চেষ্টা তার সাথে তুলনা করা চলে গ্রীক মহামতিত্রয় দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলের সাথে। সত্যকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় প্লেটো-নজরুল সমপথের সহযাত্রী।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কখনোই শাসক শ্রেণী ও অভিজাতদের কাছে প্রিয় হতে পারেন নি, হওয়ার কথাও নয়। কেননা শাসকশ্রেণী যুগে যুগে প্রজাদেরকে শোষণের মাধ্যমেই তাদের শাসনকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছে। সকল নীতিনৈতিকতাকে ভুলন্ঠিত করে শাসকেরা প্রজাদের ওপর অন্যায়-অবিচার করেছে যুগান্তর জুড়ে। শুধু একজন কবি হিসেবে নয় বরং বন্দুক কাঁধে রণাঙ্গনে শত্রুপক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করে যাওয়া কাজী নজরুল ইসলামের জন্য অন্যায়ের সাথে আপস করার মানসিকতা দেখানো কোনভাবেই সম্ভবপর ছিল না। কাজেই তিনি যুগে যুগে অন্যায়কারী শোসকের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। একাজে তিনি নিন্দিত হয়েছেন, জেলে গেছেন তবুও তিনি সত্যের পথ ও মুক্তির দাবী থেকে পিছপা হননি।
কাজেই কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও এখানের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পালাক্রমে যারাই ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহণ করেছে, তাদের কারো সহায়ক শক্তির ভূমিকা পাননি। নিছক আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজাল ছাড়া শাসকদের কেউ-ই কবিকে যথার্থ মূল্যায়ন করেনি। অন্যদিকে কবি কথিত পয়সাওয়ালা অভিজাতদের দ্বারা নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য সারা জীবনকাল বলে গেছেন, সংগ্রাম করেছেন। কাজেই যারা শ্রমিক পিষে সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাদের দ্বারা কবি যথার্থ মূল্যায়িত হবে- এ আশা মোটেই যৌক্তিক নয়। ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে জেলে গিয়েছেন, নিগৃহীত হয়েছেন। অথচ তার সমসমায়িক কিংবা খানিক অগ্রজ অনেক কবি ব্রিটিশদের প্রশংসা করে ব্রিটিশদের থেকে কিংবা ব্রিটিশদের মদদপুষ্টদের থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। সত্যের সাথে আপসের প্রশ্নে নজরুল ইসলামের সাথে কেবল ফরাসি দার্শনিক ও কথা সাহিত্যিক জঁ-পল্ সার্ত্র্ এর তুলনা করাই প্রাসাঙ্গিক। অমানবিকতার সাথে আপস করবেন না বলে যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কোন লোভে পড়ে এ দু’জনের কেউ সত্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি।
যতদিন বাঙলা ভাষা থাকবে, সত্যের আবেদন থাকবে, মিথ্যার ওপর সত্যের জয়ী হওয়ার প্রচেষ্টা থাকবে ততদিন কবি-দার্শনিক কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টির অনন্য ভূমিকা থাকবে। সার্বিক জীবনে একজন যথার্থ শুদ্ধাচারী হওয়ার জন্য নজরুল পাঠের বিকল্প আছে বলে মনে করি না। জাতীয়ভাবে নজরুলকে যে স্বার্থেই উপেক্ষা করা হোক না কেন- ব্যক্তি নজরুলের সাথে পাঠকের ব্যক্তিকেন্দ্রিক হৃদ্যতা ছিন্ন করবে এটা সকল অপশক্তির সাধ্যের বাইরে। পাঠকের হৃদয়ে নজরুলের সত্যমাখা আবেদন ছিল, আছে এবং রইবে।
আমাদের জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা গঠনে নজরুল সর্বদা আলোর মশালধারীর ভূমিকা রেখেছেন। যুগে যুগে সত্যের ওপর চাপ এসেছে কিন্তু সত্য কখনো নত হয়নি, সত্যের আলো কেউ নির্বাপিত করতে পারেনি। কোন কারণে আমরা যদি নজরুল থেকে বিচ্যুত হই তবে সত্যের উপলব্ধি থেকে যোজনের পথ পিছিয়ে পড়তে হবে নিঃসন্দেহে। অনেক কবি-সাহিত্যিক অধ্যয়নের মাধ্যমে প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ-অনুরাগ, যৌনতা-নগ্নতার শিক্ষা পাওয়া যাবে বটে কিন্তু আত্মোপলব্ধি ও সত্যের অনুসন্ধানের জন্য নজরুলকে ধারণ করার বিকল্প আছে বলে মনে করি না। কেউ যদি নজরুলকে বাদ দিয়ে সাহিত্যের অন্যান্য সকলের শাখায়-প্রশাখায় বিচরণ করে তবুও তার সাহিত্য ও নিজেকে জানার প্রশ্নে অর্ধেকটাই বাকি থেকে যাবে। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জাতীয় জীবনের সাহিত্যের অর্ধেকটাই নজরুলকেন্দ্রিক।
লেখক: কলামিস্ট. [email protected]
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]