শিরোনাম
জীবনের অকথিত গল্প
প্রকাশ : ২৮ জুন ২০১৭, ১৬:০১
জীবনের অকথিত গল্প
লুৎফর রহমান রিটন
প্রিন্ট অ-অ+

আমি পরিবারের এক বিতাড়িত সন্তান। এটা আমার কাছের মানুষেরা প্রায় সবাই জানেন। ওয়ারিতে আমার বাবার বাড়ি থাকা সত্বেও আমি বাংলাদেশে গেলে সেই বাড়িতে থাকি না। থাকি বন্ধুর বাসায়। কেনো বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হলো সে কাহিনি কখনো বলা হয়নি।


আমার কোনো লেখায় আমার মা কিংবা বাবার কথা সরাসরি আসেনি। কারণ, আমি বানিয়ে বানিয়ে মা-বাবার তথাকথিত ''আদর্শপীড়িত গল্প বা কল্প-কাহিনি'' শোনাতে চাইনি। আবার আমার বাবা-মায়ের নিষ্ঠুরতার গল্পগুলোও লিখতে চাইনি। হয়তো মধ্যবিত্ত মানসিকতার আরোপিত ভালোমানুষীর একটা রূপ এটা। মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির ঘেরাটোপে বন্দি আমিও।


অথচ আমি আমার জীবন-কাহিনি অকপটে বলতে চেয়েছি পাঠকদের। আমার সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্মৃতিগদ্য লিখেছি আমি। যত্রতত্র কয়েকছত্র, টুকরো স্মৃতির মার্বেলগুলো, নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে, স্মৃতির জোনাকিরা এবং ভ্রমর যেথা হয় বিবাগী নামে যে পাঁচটা বই আমার স্মৃতিগদ্যের,ওখানে সযত্নে আমার নিষ্ঠুর অমানবিক বাবা, মা এবং ভাইবোনদের হিংস্রতার অধ্যায়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কাজটা ঠিক করেছি না ভুল করেছি সেটা নিয়ে আমি নিজেও খানিকটা দ্বিধায় ছিলাম। দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলায় ঠুনকো মান-সম্মানের বিভ্রমে উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ভেবেছি, কেউ দেখছে না। অথচ একজন লেখক বা শিল্পীর জীবন বইয়ের খোলা পাতার মতো, দৃশ্যমান। আর আমি তো একজন লেখকই হতে চেয়েছি সারাটা জীবন। লেখক হবার জন্যে বিত্তকে আমি পায়ের ভৃত্য করেছি। আমার সামনে খোলা ছিলো শর্টকাটে শতসহস্র কোটি টাকার মালিক হবার পথ। কিন্তু আমি সারা জীবন মনে করেছি বাড়ি-গাড়ি-টাকাকড়ির দৃশ্যমান সম্পদ বা বিত্তবৈভবের চেয়ে একজন লেখক বা শিল্পী অনেক বেশি ঐশ্বর্য্যশালী হয়। সেই অর্থে নিজেকে আমি কখনোই নিঃশ্ব বা দরিদ্র ভাবিনি কোনোদিন।


আমাকে সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ হিশেবেই জানেন সকলে। আনন্দ আমার ছায়াসঙ্গী। কিন্তু আমার একান্ত বলতে না-পারা দুঃখগুলো কষ্টগুলো আমাকে কী পরিমাণ অশ্রুসিক্ত করে, সেটা কেউ জানে না। আমার অবস্থাটা অনেকটা সে রকম - বাহিরে যার হাসির ছটা ভেতরে তার চোখের জল...।


সযতনে লুকিয়ে রাখা একজীবনের পারিবারিক বঞ্চনা ও কষ্টগুলোর কারণে আমার হৃদয়ে কী পরিমাণ রক্তক্ষরণ ঘটেছে বা এখনও ঘটছে প্রতিনিয়ত, তার হিশেব কে রাখে!...পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ-মারামারি-কাড়াকাড়ি থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি আজীবন। আমার চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোথাও মানিয়ে নিতে না পারলে কিংবা কারো সঙ্গে বনিবনা না হলে আমি চুপচাপ সেই জায়গা থেকে বা ব্যক্তিবিশেষ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিই।



প্রতি বছর মা দিবস বাবা দিবস আসে। কতো কতো লেখা পড়ি ফেসবুকে! কোনো কোনো লেখা পড়ে খুব গোপনে অশ্রু মুছি। আহারে, এই লেখাটার মতো মা কিংবা বাবা আমি কেনো পেলাম না! আমি আমার নিজের মা-বাবাকে নিয়ে সরাসরি কোনো লেখাই লিখতে পারি না। আর তাই নৈর্ব্যক্তিক লেখা লিখি।


...আমার স্বীকার করতে অসুবিধে হয় না যে খুবই মামুলি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। আমরা সাত ভাই দুই বোন। আমি পরিবারের তৃতীয় সন্তান।...খুব অল্প পরিসরে গাদাগাদি ঠাঁসাঠাসি করে আমরা বসবাস করতাম। হৈচৈ চিৎকার চ্যাঁচামেচি ঝগড়া আর গালাগালি ছিল পরিবারের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ছোটবেলা থেকেই এসব ঝুটঝামেলা আমি এড়িয়ে চলতাম। তাই আমার সঙ্গে আমার ভাইবোন বা মা বাবার কখনোই ঝগড়া হবার সুযোগ থাকতো না।


সব বাবা-মা বাংলা সিনেমার গল্পের মতো আদর্শবান ও মানবিক হয় না। আমার বাবা খুব নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। নির্দয়ভাবে প্রহার করতেন ছেলেমেয়েদের। মাকেও মারতেন। একমাত্র আমিই বাবার হাতে মার খাইনি। জীবনে একবারই বাবা আমার গায়ে হাত তুলেছেন, এবং সেটা আমার স্ত্রী ও কন্যার সামনে! আমার ছোট্ট এইটুকুন মেয়েটা আতংকে কাঁপছিলো তার দাদুর রুদ্ররূপ দেখে। আমাকে মেরেই তিনি বাড়িছাড়া করেছিলেন। আমি বাড়ি ছেড়ে মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে চাইনি বলে দীর্ঘদিন, দশ বছরের বেশি সময় ধরে অপমান অসম্মান নির্যাতন সহ্য করছিলাম। মাতৃপ্রেম ও পিতৃপ্রেমের অদ্ভুত একটা মোহের ঘোরে আচ্ছন্ন ছিলাম বলে শত অপমানেও আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার চিন্তা করিনি।


...একজন মা হয়ে অন্য আরেক মায়ের কন্যাকে নির্যাতন করলে সেই মা মহৎ কিংবা মহান থাকেন না। আমি তাই আমার মা-বাবাকে মহৎ হিশেবে চিত্রিত করতে পারিনি। কিন্তু তাঁদের অসম্মান করে একটি বাক্যও লিখিনি কোনোদিন। আমি চাইনি আমার বাবা-মায়ের নিষ্ঠুরতার গল্প মানুষকে শোনাতে। শুধু পুত্রবধুরা নয়, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কাজের মেয়েরাও নির্যাতিত। আমরা ভুলে যাই, কাজের মেয়েটিও আরেকজন অভাবী মায়ের কন্যা। কোনো ভালো মা আরেকজন মায়ের কন্যাকে নির্যাতন করলে তিনি তাঁর মর্যাদা আর উচ্চ আসন থেকে ছিটকে পড়েন। আর তিনি ভালো মায়ের তালিকায় থাকেন না।



কিশোর কণ্ঠশিল্পী আবিদের মৃত্যুর পর জেনেছিলাম, এক সাক্ষাৎকারে বাড়ির ছাদে একটা দোলনা দেখিয়ে আবিদের মা বলেছিলেন, দোলনাটায় বসে থাকবে আবিদ আর ওর বউ, দোলনাটায় ধাক্কা দিয়ে দিয়ে দুলুনির সৃষ্টি করবে ওর মা, এমনই কথা ছিলো ছেলের সঙ্গে মায়ের!


সাক্ষাৎকারের এই অংশটা পড়ে অনেক কেঁদেছিলাম গোপনে। আহারে, আমি এমন একটা মা পেলে শার্লির জীবনটা কতো আনন্দময় হতে পারতো! শ্বাশুড়ির আদর কী জিনিস, আমার স্ত্রী সেটা জানতেই পারলো না!


খুব অত্যাচারী ছিলেন আমার মা-বাবা দুজনেই। বিশেষ করে গরিবদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে বিমল আনন্দ উপভোগ করতেন তাঁরা। বাড়িতে কাজের মেয়েরা ছিলো প্রধানত তাঁদের নির্মমতার বলী। আমাদের ওয়ারির বাড়িতে অনেকগুলো হতদরিদ্র কাজের মেয়ের অশ্রু আর দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে। দিবারাত্রি অমানুষিক পরিশ্রমের বিনিময়ে ওরা তিন বেলা খাওয়া পেতো। কিন্তু একটা গ্লাস বা প্লেট ভেঙে ফেললে আমার মা শাস্তি হিশেবে ওদের এক বেলা খাওয়া বন্ধ করে দিতেন!


আমাদের গরিব আত্মীয়স্বজনরাও তাঁদের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, দেখেছি। আমার ছোট মামা থাকতেন বাসাবো মাদারটেক এলাকায়। আমাদের তুলনায় অনেক দরিদ্র ছিলেন তিনি। তাঁর বড় মেয়ের সঙ্গে আমার ছোটভাইয়ের প্রণয় ও বিবাহের ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে ছোট মামাকে ওয়ারির বাড়িতে ডেকে এনে আমার মা কী ভয়ংকর অপমানই না করেছিলেন! আমার সামনেই ঘটেছিলো সেই ঘটনা। অপরাধী না হয়েও দরিদ্র মামা একটা চেয়ারে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে ছিলেন । আমার মা তাঁর মুখের সামনে আঙুল নাচিয়ে বলেছিলেন, ''আমার সম্পত্তির লোভে আপনি আপনার মেয়েকে আমার ছেলের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন।'' এমন মিথ্যে অপবাদে আমার মামা হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন।
(সেই দরিদ্র মামার দিন এখন ফিরেছে। মামার বড় ছেলেটি মামার টিনশেডের বাড়িটিকে তিনতলায় রূপান্তরিত করেছে)।



...আগেই বলেছি, পরিবার থেকে বিতাড়িত একজন মানুষ আমি। বাবা-মা অন্যায়ভাবে তাঁদের ১২ হেয়ার স্ট্রিট ওয়ারির বাড়ি থেকে আমাকে আমার স্ত্রী ও কন্যাসহ বিতাড়িত করেছিলেন । স্ত্রী-কন্যার হাত ধরে এক বিকেলে আমি যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি নিচতলার ফ্ল্যাট থেকে, বাবা আর মা তখন দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে আমার প্রস্থানদৃশ্য অবলোকন করছিলেন। শেষ বিদায় নিতে গিয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে বাবা মায়ের উদ্দেশে অশ্রুসজল আমি বলেছিলাম, ''এই যে আমাকে বের করে দিলেন, এই যে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, আমি আর কোনোদিন এই বাড়িতে ফিরে আসবো না।''


আমার দাম্ভিক বাবা বলেছিলেন, ''সম্পত্তির ভাগ নিতে অবশ্যই আসবি। আমি জানি।''


না। আমি আর ফিরে যাইনি। এমনকি তাঁর অঢেল সম্পত্তির ভাগ নিতেও না।



২০০৯ সালের ডিসেম্বরে আমার বাবা মারা গেলেন। আমি তখন কানাডায়। বাবা মারা যাবার পর বাংলাদেশে গিয়েই আমি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে আজিপুর কবরস্থানে বাবার কবরটির অবস্থান বা লোকেশন জানতে চাইলাম। (একমাত্র এই ভাইটির সঙ্গেই আমার সীমিত একটা যোগাযোগ বহাল ছিলো, আজও তেমনটাই আছে, সীমিত যোগাযোগ। অন্য কারো সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগই নেই।) তিনি বললেন, এতো কবরের ভিড়ে তুই খুঁজে পাবি কী করে!


বড় ভাই সরকারি চাকরি করেন। ঢাকার বাইরে পোস্টিং। এক ছুটির দিনে পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে আজিমপুর কবরস্থানের মূল ফটকে দেখা হলো। তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন বাবার কবরটা। তারপর তাঁকে আমি বিদায় দিয়ে আমার মতো করে বাবার কবরের সামনে বেশ লম্বা সময় ধরে অবস্থান করলাম। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। কবরের ভেতরে বাবা শুয়ে আছেন, আমি যেনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাঁকে। তাঁর শারীরিক উচ্চতার তুলনায় কবরটিকে কিছুটা ছোট বলেই মনে হলো। বাবার নামাঙ্কিত ফলকের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে ঘিরে আমার একজীবনের না-বলা অভিমানের কথাগুলো অবশেষে বলা হলো আমার। আমাকে সুন্দর এই পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতাও জানালাম তাঁকে। বললাম, আমাদের মতবিরোধ ছিলো, বহু বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমার দ্বিমত ছিলো কিন্তু জীবনে কখনোই আপনাকে অসম্মান করিনি, কোনো অন্যায় করিনি আপনার সঙ্গে। জীবদ্দশায় আপনি কিংবা এখনো বেঁচে থাকা আমার মা কোনোদিন এই বিষয়ে কাউকে কোনো অনুযোগও করেননি। তারপরেও অজান্তে যদি আপনাকে দুঃখ দিয়ে থাকি তো ক্ষমা করে দেবেন বাবা।


আমার বাবার মৃত্যু খানিকটা রসহ্যজনক ছিলো। অসুস্থ্ বাবাকে ল্যাবএইড থেকে সন্ধ্যায় বাড়িতে নিয়ে আসার সময় চিকিৎসকরা বারবার করে বলেছিলেন তাঁকে যেনো লিকুইড খাবার দেয়া হয়, কোনোমতেই সলিড খাবার দেয়া যাবে না। আর ভমিটিং টেন্ডেন্সি হওয়ামাত্র তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে, দেরি করা যাবে না। বমি হওয়া মানেই মহাবিপদ।


কিন্তু হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে সেই রাতে বাবাকে খুব যত্ন করে সলিড ফুড খাওয়ানো হয়েছিলো। বমি বমি ভাব হচ্ছে বলার পরেও তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়নি। এমনকি প্রথমবার বমি করার পরেও না। বাবা বারবার বলছিলেন তাঁকে হাসপাতালে নিতে, কিন্তু ভাইবোনেরা বলছিল, আরেকটু দেখি। এভাবে দুই ঘন্টায় বাবা তিনবার বমি করার পর যখন নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ছেন তখনই তাঁকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কিন্তু ল্যাবএইডে পৌঁছানোর আগেই বাবা ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে। প্রথমত সলিড ফুড খাইয়ে, দ্বিতীয়ত অহেতুক সময়ক্ষেপণ করে বাবার মৃত্যুকে নিশ্চিত করা হয়েছিলো। সঠিক তদন্ত হলে রহস্যজনক এই মৃত্যুটির কারণ শনাক্ত হতো। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আমার ভাইবোনেরা এই রহস্য উদ্ঘাটনে আগ্রহী হয়নি।


২০১৬ সালে আমার এক ছোটভাই মারা গেছে। হার্টের পেসেন্ট ছিলো সে। এক বিকেলে হার্টের ব্যথা উঠলো। সবাই জানে, হার্টের ব্যথার সময় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পেইন কিলারজাতীয় কোনো ইঞ্জেকশন দেয়া অনুচিৎ। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ব্যথায় কাতর আমার ছোটভাইটিকে দ্রুত হাসপাতালে না পাঠিয়ে ব্যথানাশকের নামে তার শরীরে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়েছিলো। ইঞ্জেকশন পুশ করার পর যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভাইটি মরে গিয়েছিলো! এই মৃত্যুটিও খানিকটা রহস্যজনক। হার্টের পেসেন্টকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইঞ্জেকশন দেয়ার সিদ্ধান্তটি কে নিয়েছিলো? তাছাড়া ভুল ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হয়নি তো তার শরীরে? এই মৃত্যুটিরও সঠিক তদন্ত হওয়া উচিৎ ছিলো।


আমার ভাইবোনদের চরম দায়িত্বহীনতা এবং অমানবিকতার উদাহরণ হয়ে আছে ঘটনা দুটি।



২০০১ সালে এক রাতে আমার মা ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। আমি তখন ঢাকায়, যথারীতি বিতাড়িত বা পরিবারবিচ্ছিন্ন। বড় ভাইয়ের ফোন পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গিয়েছিলাম শমরিতা নার্সিং হোমে। ওখানে গিয়ে জেনেছিলাম, সেই সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে আমার এক ছোট ভাই অত্যন্ত কুৎসিত দুর্ব্যবহার করছিলো এবং ক্রমাগত অশালীন কটুবাক্য প্রয়োগ করছিলো। সন্তানের ওরকম নির্দয় আচরণ সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় ঢলে পড়েছিলেন মা। হাসপাতালে নেবার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। অবশ হয়ে যেতে পারে শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছিলো। তাঁর সেই চেতন-অবচেতন মুহূর্তে আমাকে দেখে কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিলেন মা। চিকিৎসকরা ব্যাপারটা খেয়াল করে বলেছিলেন, মায়ের দ্রুত রিকভারি চাইলে আমি যেনো প্রতিদিন নিয়মিত হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাই। চিকিৎসকদের পরামর্শে সেই সময়টায় আমি প্রতিদিন যেতাম মায়ের কাছে। দ্রুতই তিনি সেরে উঠছিলেন। কিন্তু অর্ধেক শরীর তাঁর প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলো। তাঁর সঙ্গী হয়েছিলো হুইলচেয়ার।


মা শমরিতায় থাকাকালীন, দর্শনার্থী আসেনা এমন সময়টা্‌ নিয়ম করে প্রতিদিন পূর্ব নির্ধারিত 'দীর্ঘ একটা সময়' আমি মায়ের সঙ্গে তাঁর কেবিনে কাটিয়েছি। ওই সময়টায় হাসপাতালে মায়ের কক্ষে কখনো বড় ভাই কখনো বড় বোন কিংবা বাবার সঙ্গে আমার দেখা হতো নিয়মিত। এক পর্যায়ে আমাকে তাঁরা মায়ের সঙ্গে একা কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। অনেকগুলো বছর ধরে জমে থাকা আমাদের দুজনার সমস্ত কথা আমরা তখন বলাবলি করেছি। আমার কথায় মা কখনো হেসে গুঁড়োগুঁড়ো হয়েছেন আবার কখনো বিষণ্ণ হয়েছেন। আমাকে হারিয়ে তাঁর কষ্টের সীমা ছিলো না। আমাকে বাড়িছাড়া করার বিষয়ে তাঁদের অর্থাৎ বাবা-মায়ের নির্মম যৌথ সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিলো না, একদিন সেটাও তিনি বললেন। বললেন, ''সব ভুলে যা। আবার তুই ফিরে আয় ওয়ারিতে। আর তোর কোনো অমর্যাদা হবে না। তোর বউয়ের প্রতি আর কোনো অন্যায় করা হবে না।''


কিন্তু মায়ের প্রস্তাবে রাজি হইনি আমি। বলেছি, দূরেই থাকি। সেই ভালো। প্রাচুর্যময় অপমান অসম্মান আর অবজ্ঞার জীবনের চাইতে প্রাচুর্যহীন ভালোবাসার জীবন অনেক সুন্দর আম্মা। (মাকে আমি আম্মা বলি আর বাবাকে আব্বা)। অশ্রুসজল মা আমার মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, ''পাগল ছেলে। এতো রাগ কেনো তোর?''
আমি বলেছি, ''বাবার কাছ থেকে পেয়েছি।''


শমরিতায় এক দুপুরে আমাদের দীর্ঘ কথোপকথন ছিলো এরকম -
--তুই তোর বাবাকে ভালোবাসিস না? ( মা খেয়াল করেছেন, বাবার সঙ্গে আমি কথা কম বলি।)
--বাসি। কিন্তু আপনার মতো না। আপনাকে যতোটা ভালোবাসি বাবাকে ততোটা না। অনেক কম।
--কেনো? কম কেনো? এটা তো সমান সমান হওয়া উচিৎ।
--না। সমান সমান হবে কেমন করে? আমি তো জন্মেছি আপনার পেটে, বাবার পেটে তো না! আপনার এই পেটে দশটি মাস আমি একটু একটু করে বড় হয়েছি। কতো কষ্ট দিয়েছি আপনাকে! আপনার ফুলে যাওয়া পেট, পেটের ভেতরে আমি নড়াচড়া করি, আপনি ব্যথা পান কিন্তু সহ্য করেন। আমার শরীরের ভারে আপনাকে হাঁটতে হয় নত ভঙ্গিতে। আমি বড় হই আমার ওজন বাড়ে আর আপনার কষ্ট বাড়ে। এই যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে আব্বাকে যেতে হয়নি। আপনার স্বভাবিক জীবন আমার জন্যে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। খেতে পারেন না, ঘুমাতে পারেন না, শুতে পারেন না, বসতে পারেন না, উঠতে পারেন না - আহারে! তারপরে আছে সেই ভয়ংকর কষ্টের কাল, আমার জন্মকাল। প্রসব ব্যথা হচ্ছে পৃথিবীর সবচে ভয়ংকর ব্যথা। এর কোনোটাই আমার আব্বা ভোগ করেননি। তাহলে বাবা আর মা সমান হয় কী করে?


মা অবাক হয়ে আমার কথা শোনেন। আমি বলতেই থাকি, ফকির আলমগীরের গাওয়া 'মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম পাপোস বানাইলে ঋণের শোধ হবে না' গানটা আপনার খুব প্রিয় আম্মা। আমারও। সেই গানে একটা লাইন আছে না, পিতা আনন্দে মাতিয়া সাগরে ফেলিয়া সেই যে চইলা গেলো ফিরা আইলো না/মায়ে ধরিয়া জঠরে কতো কষ্ট করে দশমাস দশদিন পরে পেলো বেদনা'...


-কী সুন্দর যুক্তি দিয়া কথা বলো তুমি! আমি আমার ছেলের সঙ্গে যুক্তিতে পারি না!


বলতে বলতে মা হাত বাড়িয়ে আমার মাথাটা টেনে নেন তার মুখের দিকে। তাঁর নাকের ভেতরে সরু একটা নল লাগানো। হাতে স্যালাইনের সূঁচ। সেই বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতেই মা আমার মাথাটা তাঁর মুখের কাছে টেনে নিয়ে আমার কপালে চুমু দেবার চেষ্টা করেন। আমি আমার কপালটা মায়ের ঠোঁটের কাছে এগিয়ে দিই। মায়ের পবিত্র চুম্বনে আমার কপালে রচিত হয় আদর আর ভালোবাসার এক অমোচনীয় স্মারক।


--কোনোদিন তুমি বাড়িতে আসবা না জানি, কিন্তু আমি মরে গেলেও কি আসবা না বাজান?
--না আম্মা। আপনি মরে গেলেও আমি ওই বাড়িতে যাবো না। আমি আপনার কবরে যাবো আপনাকে দেখতে। ওখানেই দেখা হবে আপনার সঙ্গে।
--তোর বাবা সম্পত্তি ভাগ করে দিলে তোর ভাগটা অন্তত নিস।
--না। আমি নেবো না। সম্পত্তিতে আমার লোভ নেই।
--তাহলে তোর অংশটা কী করবো?
--আমার অংশটা আপনি নিয়ে নেবেন আম্মা। আমারটুকু আমি আপনাকে দিয়ে দিলাম।
আমার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকেন আম্মা। তারপর বলেন, ওরে আল্লা, আমার ছেলেটা কী সুন্দর করে কথা বলে!


মায়ের স্যালাইন পুশ করা হাতের ওপর আলতো করে আমার হাতটা রেখে আমি বলি, আম্মা এমনিতেই আমি আপনার কাছ থেকে দূরে আছি। ভবিষ্যতে হয়তো আরো দূরে চলে যাবো। এতো দূরে যে আপনার সঙ্গে আমার আর দেখাই হবে না! তখন আপনি কী করবেন? আমাকে বদদোয়া দেবেন? অভিশাপ দেবেন?


আমার প্রশ্নে কী রকম আঁতকে উঠলেন মা, এইটা কী বললা তুমি বাজান? তোমার উপরে আমরা অন্যায় করে ফেলছি। তুমি তো কোনো অপরাধ করো নাই! তোমাকে কেনো অভিশাপ দিবো? তুমি যেইখানেই যাও, যতো দূরেই যাও, জানবা আমার দোয়া তোমার সঙ্গে থাকবে। মায়ের আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে থাকবে...খোদার কাছে তোমারে সাফায়াত কইরা দিছি বাজান...বলতে বলতে আমার মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো কাঁপা কাঁপা হাতে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন আম্মা। আমি বলেছিলাম, আমাকে ওরা আপনার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করেছে। সম্পত্তিও ওরা কেড়ে নিতে পারবে, কিন্তু মায়ের দোয়া আর আশীর্বাদ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না।


মায়ের সঙ্গে আমার সেই কথোপকথনের স্মৃতি আজও আমাকে সাহস যোগায়। শক্তি যোগায়। পরবর্তীতে দেশে বিদেশে কতো রকমের সংকটে পড়েছি কিন্তু মায়ের অদৃশ্য আশীর্বাদ সব সময় আমাকে উদ্ধার পেতে সাহায্য করেছে। চোখ বন্ধ করে হাসপাতালের সেই দুপুরের স্মৃতিময় ছবিটা যখনই স্মরণ করি মায়ের গায়ের গন্ধের সঙ্গে হাসপাতালের ফিনাইলের একটা গন্ধ কী রকম মাখামাখি হয়ে আমার নাকের কাছে ঘুরতে থাকে। আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই—আম্মা!



... একটি চিঠির কারণে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে ফের খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিলো আমার, কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। টেলিফোনে মায়ের সঙ্গে আমার নিয়মিতই কথা হতো। সর্বশেষ মায়ের সঙ্গে কথা বললাম এক শবে বরাতের রাতে। ওই সময়টায় এতো মনে পড়ছিলো মায়ের হাতে বানানো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বাদের বুটের হালুয়ার কথা! সেদিনই বড়ভাইকে ফোনে বলেছিলাম, মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলিয়ে দিও। বড়ভাই মায়ের বাড়িতে গিয়ে টেলিফোনটা মায়ের হাতে দিয়ে বলেছিলো, এই যে কানাডা থেকে রিটন আপনার সঙ্গে কথা বলবে।


কানাডায় টেলিফোনের এই প্রান্তে আমি আর বাংলাদেশে ওইপ্রান্তে মা। অনেকক্ষণ কথা বললাম আম্মার সঙ্গে, একা একা। তাঁর বানানো সুস্বাদু হালুয়ার কথাও বললাম। কিন্তু আম্মা কোনো কথার জবাব দিলেন না। কারণ, আম্মা এখন আর কথা বলেন না। ছেলেমেয়েদের কাউকে তিনি চিনতেও পারেন না। আমাকেও হয়তো চিনতে পারেননি। ১৭ বছর ধরে হুইলচেয়ারে অবস্থানকারী এই মানুষটি কী দুঃসহ একটা জীবন যে বয়ে বেড়াচ্ছেন! অথচ যে সন্তানের কারণে মায়ের এই করুণ হাল তার কোনো বিচার হলো না। এমনকি সে সামান্য অনুতপ্তও নয়! বরং বাবার জমি আর সঞ্চিত অর্থ হজম করতে সদাতৎপর সে।



আমি প্রতিবছর বইমেলার সময় ঢাকায় যাই। চ্যানেল আইতে 'বইমেলা সরাসরি' উপস্থাপনা করি। ২০০৯ এর বইমেলার সময়কার ঘটনা। এক বিকেলে অনুষ্ঠান সম্প্রচার শেষে হঠাৎ বাবা এসে হাজির। কুশল ইত্যাদির পর বাবা আমাকে বাড়িতে যাবার কথা বললেন। আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলাম না। রাজি হবার কোনো কারণও ছিলো না। হঠাৎ বাবা বললেন, তোর আম্মা তোকে দেখতে এসেছে। শুনে আমি তো হতবাক, বলেন কী আব্বা! আম্মা না হুইল চেয়ার ছাড়া চলতে পারে না! কোথায় আম্মা?


আব্বা আমাকে দেখিয়ে দিলেন কোথায় অপেক্ষা করছেন আম্মা। নজরুল মঞ্চের ডান দিকে মূল মঞ্চের প্রবেশপথ লাগোয়া প্যাসেজে আম্মা বসেছিলেন হুইলচেয়ারে। আমি এক দৌড়ে সেখানে গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসলাম। মা আমার মাথায় চুলে গালে মুখে সমানে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলেন—''আমার রিটন, আমার বাবা, আমার বাজান।'' মা তাঁর দুই হাত দিয়ে আমার মুখটা অনেকক্ষণ ধরে রাখলেন। আমিও মায়ের গালে কপালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি। আমরা দুজনেই সমানে কথা বলে যাচ্ছি। বইমেলার চলমান লোকজন উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দেখছিলেন। কেউ কেউ ঘাড় বাঁকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলছেন, কে হয় আপনার? আমি বলি, ''আমার মা।'' দুজন মহিলা পুলিশ দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিলেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, ''আপনার মা উনি?'' আমি মাথা দোলাই, ''হ্যাঁ আমার মা। অনেকদিন দেখা হয় না। আমি পরিবার থেকে বিতাড়িত। বিদেশে থাকি।''


এক সময় মা বললেন, আমার বোধ হয় এইভাবে এইখানে আসাটা ঠিক হয় নাই। সবাই তোমারে চেনে। আল্লাহ, আমার ছেলেটা কতো বিখ্যাত! সবাই আমাদের দেখছে। কাজটা ঠিক হয় নাই বাজান। আমি যাই।


তারপর দীর্ঘ একটা বিদায় চুম্বন করলেন মা, আমার কপালে। তারপর বললেন, খোদার হাতে তোমাকে সাফায়াত করলাম বাজান...।


মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেদনার্ত হয়ে পড়েছিলাম আমি। কেউ কেউ অটোগ্রাফ চাইছিলো। কিন্তু সেই প্রথম অটোগ্রাফ দিতে আমার বিপুল অনীহা হচ্ছিলো। আমি করজোড়ে ওদের বলেছি, প্লিজ আমার আজ মন ভালো নেই। আমাকে ক্ষমা করবেন। লোকজন অবাক হয়েছিলো, হাসিখুশি মানুষটার হলো কী!



আমার স্ত্রী শার্লি তার বাবা-মাকে ত্যাগ করে আমার সঙ্গে চলে এসেছিলো। এই কারণে ওকে অসহায় ও আশ্রয়হীন ধরে নিয়ে ওর প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক হতে একটুও দেরি হয়নি আমার মা-বাবার। আমার ছোট ভাইবোনগুলোকে শার্লি ওর নিজের ছোট ভাইবোনের প্রাপ্য সমস্ত আদর আর ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়েছিলো অকাতরে। যে কারণে আমার কোনো ভাইবোনের কাছেই সে 'ভাবী' ছিলো না, ছিলো 'শার্লি আপা'।


বাড়ির সমস্ত রান্নাবান্না, ঘরদোর ঝাড়ু দেয়া থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়ার কাজগুলোও শার্লিকে দিয়েই করাতেন আমার মা। শশুর-শাশুড়ির মন জয়ের চেষ্টায় দিনে দিনে শার্লি পরিণত হয়েছিলো কাজের বুয়াতে। মুখ বুঁজে শার্লি দিবারাত্রি ২৪ ঘন্টার স্ট্যান্ডবাই 'কাজের মেয়ে' হিশেবে সার্ভিস দিয়ে গেছে। খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগে মা ওকে জাগিয়ে দিতেন। শার্লি ১২ সদস্যের বিশাল পরিবারের সবার জন্যে একগাদা রুটি-পরোটা বানাতো ঘুম ঘুম চোখে। আমাদের দোতলার কলে পানির প্রেসার কম ছিলো বলে একটা চাপকল লাগিয়ে ছিলেন বাবা। বিশাল একটা ড্রামে সারাদিন পানি ভরে রাখতে হতো। আর এই চাপকল চাপার কষ্টকর কাজটাও একহাতে করতে হতো শার্লিকেই। পরিবারের ১২ সদস্যের গাট্টি গাট্টি কাপড় প্রতিদিন ধুতে হতো তাকেই। মাছ তরকারি কাটাকুটি ও রান্নার কাজটিও তাকেই করতে হবে। মায়ের নির্দেশ। তারপর পুরো বাড়ি ঝাড়া মোছা।


সারাদিনে শার্লির কোনো বিশ্রামের সুযোগ ছিলো না। সবার খাওয়া হয়ে গেলে তবেই সে সুযোগ পেতো খাওয়ার। সারাদিন যে মাছ মাংস সে রান্না করেছে সেই মাছ মাংস মা তাকে খেতে দিতেন না। ফ্রিজ থেকে পুরনো তরকারীর বাটি বের করে ওর সামনে দেয়া হতো। কোনো কোনো বেলা অভুক্তও রাখা হতো। রাত গভীর হতো। ক্লান্তিতে অবসণ্ণ ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থাতেও শোয়ার অধিকার ছিলো না। রাত একটা-দেড়টার আগে তাকে শুতে দেয়া হতো না। কাজে সামান্য এদিক-সেদিক হলেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেন মা। মায়ের সঙ্গে গালাগালে যুক্ত হতেন বাবাও। কী কুৎসীত সব গালিই না দিতেন বাবা আমার। এতোটাই কুৎসীত যে আমি সেটা উল্লেখও করতে পারছি না। পুত্রবধুকে কেউ এতো জঘণ্য গালিও দিতে পারে! লজ্জায় ঘৃণায় অপমানে আমি মাটির সঙ্গে মিশে যেতাম। কিন্তু আমাকে সহ্য করতে হতো। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারতাম না শার্লিকে নিয়ে। মাতৃপ্রেমের অযৌক্তিক মোহ আমাকে অন্ধ করে রেখেছিলো। দিনে দিনে শার্লির প্রতি অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলো আমার ছোট ভাইবোনেরাও। কহতব্য নয় এরকম অত্যাচার।


এক রাতে অত্যাচারের মাত্রা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে আমার স্ত্রী শার্লী আত্মহননের চেষ্টা করেছিলো । বিষপান করে অজ্ঞান অবস্থায় মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছিলো সে। দিশেহারা আমি পাগলের মতো চেষ্টা করেছি তাকে বাঁচাতে। একলাই আমি স্কুটার ডেকে এনেছি। একলাই তাকে স্কুটারে তুলেছি। গাড়ি স্টার্ট নেবার আগের মুহূর্তে আমার বড়ভাই স্কুটারে ড্রাইভারের পাশে এসে বসেছিলেন । মিটফোর্ড হাসপাতালে শার্লির পাকস্থলী ওয়াশ করার সময় ভয়াবহ যন্ত্রণায় জবাই করা জন্তুর মতো গোঁ গোঁ করছিলো শার্লি। আমি সহ্য করতে না পেরে দু'কান চেপে দৌড়ে মিটফোর্ডের করিডোরের শেষপ্রান্তের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অসহায় ভঙ্গিতে চিৎকার করে কাঁদছিলাম।


তখন ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে মৃত্যুপথযাত্রী শার্লির পাশে ছিলেন আমার বড়ভাই। সে কারণে বড় ভাইয়ের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ওর ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। ভয়ংকর সেই রাতে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের কাছে আমার স্ত্রীকে মা-বাবার নির্যাতনের বিষয়টি আমি গোপন করেছিলাম । নইলে পুলিশ কেস হতো। মা-বাবার হাতে হাতকড়া পড়তো। সেই সময় অসহায় দৃষ্টিতে আমার বড়ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর ধারণা ছিলো, আমি হয়তো পুলিশকে আসল ঘটনা বলে দেবো। কিন্তু আমি বলিনি। আমি শার্লির জীবন এবং মা-বাবার সম্মান - দুটোই বাঁচাতে চেয়েছিলাম সেই রাতে।


জীবন সম্পর্কে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো শার্লি। কিন্তু শেষমেশ আমি ওকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম, জীবন একটাই। জীবন বারে বারে আসে না। কারো অমানবিকতার কারণে সেই জীবনটা শেষ হয়ে যায় না। এটা বোঝাতে পেরেছিলাম বলেই সে বেঁচে আছে আজও।


মনস্টারের সঙ্গে লড়াই করতে হলে নিজেকেও মনস্টার হতে হয়, কিন্তু আমি সেটা হতে পারিনি। আর পারিনি বলেই আমি আমার পরিবারের কারো ওপরই প্রতিশোধপরায়ণ হইনি। আমাকে ক্রমাগত অপমান অসম্মান করলেও, এমনকি আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুললেও আমি ওদের কারো ওপর পাল্টা আঘাত হানার কোনো পরিকল্পনা করিনি। অথচ কাজটা আমি খুব অনায়াসেই করতে পারতাম। ওটা করা উচিৎ ছিলো। ওদের অপরাধের শাস্তি ওদের প্রাপ্য ছিলো।


আমি বিশ্বাস করি, প্রকৃতিই একদিন প্রতিশোধ নেবে। নেবে কি?



জীবনে মা বাবা আর ভাইবোনের সান্নিধ্যবঞ্চিত বলে একটা হাহাকার তো ছিলোই আমার বুকের গহীনে, কিন্তু সেটা পূরণ হয়ে গেছে অন্যভাবে। প্রকৃতি কাউকে নিঃসঙ্গ রাখে না। পৃথিবীর কোনো অংশ বায়ুশূন্য থাকে না। বাবা মা পাইনি, কিন্তু নয়টি ভাইবোনের বদলে লক্ষ কোটি ভাইবোন পেয়েছি। ওঁদের কেউ কেউ অনায়াসে দখল করেছেন অগ্রজের আসন, যিনি আপন অগ্রজেরও অধিক। অনুজপ্রতিম কোনো কোনো বন্ধু অনায়াসে অধিকার করে নিয়েছে প্রিয় ছোট ভাইয়ের স্থানটি, যে কী না আপন ছোট ভাইয়েরও অধিক। আর আমার বন্ধুভাগ্য তো রীতিমতো ঈর্ষণীয়। আমাদের কোনো কোনো বন্ধুত্বের গল্প প্রায় কিংবদন্তিতূল্য।... এছাড়া পেয়েছি অগুন্তি পাঠকের ভালোবাসা। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পবিত্র শিশুরা তাঁদের স্বর্গীয় কণ্ঠে আমার ছড়া পাঠ করে। বইমেলায় অভিভাবকেরা তাঁদের ছেলেমেদের নিয়ে আসেন আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। ওই বাচ্চাগুলোকে যখন আদর করি তখন আমার মনেই হয় না যে আমি পরিবারের ভালোবাসাবঞ্চিত একজন মানুষ। নয়টি ভাইবোন ও তাদের ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্যের বদলে আমি তো পেয়েছি অজস্র অগনণ ভগ্নী ও ভ্রাতা! আমাকে মামা কিংবা আঙ্কেল বলে সম্বোধন করা শিশুর সংখ্যা কি নিরূপণ করা সম্ভব? রবি ঠাকুর আমার জন্যেই উৎকীর্ণ করে গেছেন সেই অনবদ্য পঙ্‌ক্তি---তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু'বিঘার পরিবর্তে...। (সংক্ষেপিত)


অটোয়া ২৫ জুন, ২০১৭


বিবার্তা/হুমায়ুন/কাফী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com