'শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি
শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে
বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।'
প্রকৃতিতে বরাবরের মতো এবছরও একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে এসেছে শরৎ। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না আর রোদ্র-মেঘের খেলা মিলেই ঋতুটির সমাহার। ঘুমন্ত প্রকৃতি যেনো এ সময়েই জাগে ওঠার তাড়া খুঁজে পায়। তার চেতনার শেকড়ে ভর করে নতুন উচ্ছ্বাস। সে সাজে নতুনরূপে। নতুন অবয়বে। নতুন কিশালয়ে। নতুন ফুলে। আর সাদাকালো মেঘরাশিদের দিনভর দলছুট ছোটাছুটি নীল নভেঃ নয়ন ভোলানো সৃষ্টির কথাই যেনো সদা বলে যায়। মানুষ হয়ে ওঠে আবেগপ্রবণ। বাদ যায় না প্রানীকুলেও। বিচিত্র সব পাখ-পাখালিরা শরতের উদল বাতাসে ভেসে ডানা মেলে ছুটে চলে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সারাদিন ব্যস্ততার শেষ থাকে না পাখিদের।
আষাঢ়-শ্রাবণের ঘন বর্ষার রেশ কাটটে না কাটটেই ভাদ্র আসে ভিন্ন এক নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে। এ যেনো শ্রাবণের জলে ধুয়ে রাখা যত ভিজে কাপড় এবার ভাদ্রের রোদে শুকিয়ে নেবার পালা। আর আশ্বিনে তো সমস্ত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে কাশবনে। সোনাঝরা রোদে হেসে ওঠে শিউলি ফুল। শিউলি-কাশফুলের সাথে তাল মিলিয়ে এ সময় গাছে গাছে ফোটে ছাতিম, দোলনচাঁপা, জারুল, মধু মঞ্জুরি, কামিনী, নয়নতারাসহ আরো কত ফুল।
ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন রূপবৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়। শরতেও নতুন করে সাজে প্রকৃতি। গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে কাশফুলের দোলা আর শহরের নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। শহরে শরৎকে ঘিরে আনন্দ-উৎসব চললেও গ্রামীণ পরিবেশে শরৎকে নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করা যায়। টলটলে নীল নদীর ধার ঘেঁষে সাদা কাশফুল ফুটে থাকে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলে ওঠে তারা। নদীর ওপার ছুঁয়ে থাকা আকাশে ভেসে বেড়ায় শুভ্র মেঘের ভেলা। আর আঁধার নামলে স্বচ্ছ আকাশ আঁচলে ফুটে ওঠে লক্ষ কোটি তারা।
এই শরতের প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা / নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা…। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ শরতের চরিত্রের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। প্রেম-দ্রোহের কবি নজরুলকেও আলোড়িত করেছিলো এই শরতের প্রকৃতি। বিশেষ করে শরতের শিউলি তাকে মুগ্ধ করেছিলো। সেই মুগ্ধতা থেকে তিনি লিখেছিলেন- এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে…। শরতের মিষ্টি সকালও উৎকীর্ণ হয়েছে কবির বাণীতে- শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা/শেফালি ফুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা…।
গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষাকালের অবিরাম বর্ষণের পর এই ঋতু জনজীবনে আসে ভিন্ন চেহারায় স্বস্তি নিয়ে। প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ ও মনোরম। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে মাঠে এখন কচি ধানের হেলেদুলে কাটানো কৈশোর। কৃষকের মনে নবীন আশা, সাজ সাজ রব। দোয়েল-কোয়েলের কুজনে মুখরিত পল্লীগ্রাম-মাঠ-ঘাট জনপদ।
তবে শরতের দুই মাসের আবার দুই রকম মেজাজ। কখনো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, কখনো অসহনীয় গরম নিয়ে আসে ভাদ্র। কোথাও কোথাও এই মাস ‘তালপাকা ভাদ্র’ নামে পরিচিত। আবার এই ভাদ্রতেও ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ। প্রবীণেরা বলেন ‘পচা ভাদ্দের’। তবে আশ্বিনে রাত তাড়াতাড়ি আসে। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। শোনা যায় হেমন্তের পদধ্বনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই ভাদ্র থেকে আশ্বিনের বন্দনাই বেশি করেছেন। পদ্মায় নৌকা ভ্রমণকালে শরতের নীল আকাশ দেখে কবির মন আপনা-আপনি গেয়ে উঠেছে, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’
বিবার্তা/অনামিকা/বিআর
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]