ফেসবুকের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের দৌলতে মোবাইল যেমন দূরকে কাছে এনেছে, তেমনি তার নেতিবাচক দিক সামনে আসছে আত্মবিনাশী কিছু ঘটনায়। সভ্যতার আশীর্বাদকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, কিন্তু সেটাই যেন পরমাণু বোমার মতো সভ্যতাকে আঘাত করতে চাইছে।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা মাম্পি দাস একাদশ শ্রেণিতে পড়তো। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে দিনভর বুঁদ থাকার জন্য অভিভাবকরা তাকে বকাবকি করেছিলেন, তাই সে আত্মহত্যা করে।
মাম্পির ঘটনা ব্যক্তিগত স্তরে একটি মানুষের বিপন্নতাকে তুলে ধরছে। কিন্তু এই সমস্যা যখন সমষ্টিকে স্পর্শ করে, তখন সঙ্কটের ব্যাপকতা ও গভীরতা অনেকটাই বেড়ে যায়। তখন তা আর বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, গোটা সমাজকেই বিপন্ন করে তোলে।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়ায় একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল। এলাকার এক তরুণ তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে একটি সম্প্রদায়ের ভাবাবেগে আঘাত দিতে পারে - এমন ছবি পোস্ট করেছিল। সেই পোস্ট ঘিরে উত্তাল হয়ে ওঠে বাদুড়িয়া। দশকের পর দশক যে এলাকায়, একেবারে পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের বাস, সেখানে রাতারাতি পাল্টে যায় পরিস্থিতি।
ওই ফেসবুক পোস্টের সাহায্যে বাদুড়িয়ায় ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন তৈরি হয়ে গেল নিমেষে। পড়শিরা একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এতকালের পাশপাশি শান্তিতে বেঁচে থাকা, হাতে হাত মিলিয়ে এলাকার উন্নয়ন, বিপদে পাশে এসে দাঁড়ানোর ঐতিহ্য চোখের পলকে উড়িয়ে নিয়ে গেল খড়কুটোর মতো।
বাড়ির এক কোণে বসে, অলস মুহূর্তে একটা ছবি ও দুটো লাইনের ‘কমেন্ট' লিখে দিলেই এত বড় গণ্ডগোলের জন্ম দেয়া যায়৷ - এটা দেখে উল্লসিত হলো মৌলবাদীরা। কী দরকার কানে-কানে গোপন প্রচার কিংবা কাগজের ফাঁকে লিফলেট বিলি করার! একটা ফেসবুকের এমন শক্তি যে, তা আমাদের ভেতরে থাকা সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, এত সহজে।
এই ঘটনাই প্রমাণ করে দিচ্ছে, সভ্যতার আশীর্বাদ এই মুহূর্তে কীভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের নামে আমাদের আজন্মলালিত মানবতার বন্ধন বা নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করার চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে।
মাম্পির মতো এ সময় ভারত-বাংলাদেশের একটা আস্ত প্রজন্ম, যারা এখন কৈশোরে, তাদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার নেশা বাড়ছে কেন? মনোবিদ ডা. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘এই ভার্চুয়াল জগতটাকে ছেলে-মেয়েরা বড় ভালোবেসে ফেলছে। তাই তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তারা জানে না, এই জগতের সবটাই সত্যি নয়। এর মধ্যে অনেক চোরাবালি আছে। ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে। তাদের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে কৈশোর।''
তা হলে সোশ্যাল মিডিয়ার কুপ্রভাব থেকে ছেলেমেয়েদের মুক্ত করার পথ কী? মনোবিদ ডা. কামাল হোসেনের মতে, এ জন্য দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবকদেরই। তিনি বলেন, ‘‘ওদের হাত থেকে স্মার্টফোন কেড়ে নিলে হিতে বিপরীত হবে। সেই কাজটি করবেন না, তাতে ওরা আরও বিপথে চলে যাবে। তা ছাড়া সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হবে। তাই কঠিন কাজ হলেও অভিভাবকদেরই দেখতে হবে, ছেলেমেয়েরা গোপন জগতে কার সঙ্গে বাক্যালাপ করছে। এই নজরদারিটার প্রয়োজন আছে। তা হলে সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে।''
কোন অংশের পড়ুয়াদের ফেসবুকের পাগলামি বেশি গ্রাস করছে? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নতুন একটি দিকে আলোকপাত করলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের যোগদা সৎসঙ্গ শ্রীযুক্তেশ্বর বিদ্যাপীঠের শিক্ষক প্রভাস রায়। তিনি বলেন, ‘‘বরাবরই পাঁচ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর মেধা বেশি, তারা পড়াশোনাতেই ডুবে থাকে। আরও ধরুন ১০-১৫ শতাংশের ইচ্ছে থাকে ঘষেমেজে নিজেকে গড়ে তোলার। এর বাইরের যে বিপুল অংশ পড়াশোনায় অমনোযোগী, তাদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বেশি। আমাদের ছোটবেলায় এই অংশের ছেলেমেয়েরা মাঠেঘাটে দিনভর খেলে বেড়াতো। এখন খেলাধুলোর জায়গা নিয়েছে ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া।''
শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের মোবাইল-আসক্তি ভবিষ্যতে কী প্রভাব ফেলবে, তার জবাব সময় দেবে। কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়া এখনই প্রশাসনের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে।
ফেসবুক কিংবা মোবাইল গেম যে বিপদ উপস্থিত করেছে, সে জন্য বিজ্ঞানকে পরিহার করা যায় না। প্রযুক্তির সাহায্য না নিলে পড়ুয়ারা ভবিষ্যতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বে, এই আশঙ্কা রয়েই যায়। তাই ফিরতে হবে ডা. কামাল হোসেনের দেখানো পথে। ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে হাতে স্মার্টফোন রাখতেই পারে, কিন্তু তারা কীভাবে সেটি ব্যবহার করছে, তার উপর নজরদারি রাখলে সমস্যা থেকে মুক্তি অনেকটাই সম্ভব। সূত্র : ডয়চে ভেলে
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]