সবারই মন খারাপ হয়। কারোকারণে, কারোঅকারণে। কমবেশিও হতে পারে তার পরিমাণ। অফিসে বস কিংবা সহকর্মীর কোনো কথায় কিংবা ক্লাসে-ক্যাম্পাসে বন্ধুর আচরণে। মন খারাপ হতে পারে পরীক্ষার ফলের জন্যও। তবে অনেকে আছেন যাদের অল্পতেই মন খারাপ হয়ে যায়।
যখন মন খারাপ থাকে তখন নানা দিকে কথা নানা রকম চিন্তা মনে বাসা বাঁধে। সে সময় জীবনের যতো হতাশা পাওয়া না পাওয়া শত কষ্ট হয়ে আবেগ তারিত করে। মন তখন হিসেব কসতে শুরু করে যে পাওয়া না পাওয়ার গল্পগুলো নিয়ে কী কোনো দিন কথা হবে? মন খারাপ থাকলে তখন আর স্বাভাবিক বিষয়টি মাথায় কাজ করতে চায় না, সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত মন ভালো না হয়।
আবার অনেকেই মন আর হতাশাকে মিলিয়ে ফেলেন। আসলে মন আর হতাশা কিন্তু এক নয়। হতাশ ব্যক্তি নিজের উপর আশা তো ছেড়ে দেয়ই, আশেপাশের পরিবেশ থেকেও মন উঠিয়ে নেয়। কোথাও কোনো আশার আলো দেখতে পায় না। এভাবে নিজের তৈরি অন্ধকার কুঠুরীতে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে দিতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়।
মানুষের ব্রেনের একটা সমস্যা কি জানেন তো? আমাদের ব্রেন বাস্তব ও কল্পনার পার্থক্য ধরতে পারে না। ব্রেনের গঠন জটিল কিন্তু পলিসি সহজ। আর তাই আমরা হাসির জিনিস দেখলে/শুনলে হাসি। কান্নার হলে নিজের অজান্তেই কাঁদি! মন খারাপ হওয়াটা আপনার দোষ না। হঠাৎ কোন দৃশ্য, ঘটনা, কথা কিংবা স্মৃতি- আপনার ব্রেনকে নাড়া দিতেই পারে।
‘যেসব মানুষের অল্পতে মন খারাপ হয়ে যায় সাধারণের তুলনায়, তাদের সামাজিক দক্ষতা কম। তারা যদি নিজেদের আরও সামাজিক করে, অন্যান্য সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকে, তাহলে আর অল্পে মন খারাপ হবে না। অনেকের আবার ব্যর্থতাকে গ্রহণ করে নেয়ার ক্ষমতাও কম।’
অনেকেই তো আছেন, যাদের নিজেদের জীবন, নিজেদের চারপাশ নিয়ে মন খারাপ থাকে। ‘আমরা অনেকে আছি যারা শুধু আমাদের চারপাশের নেতিবাচক বিষয় দিয়ে প্রভাবিত। চারপাশের ইতিবাচক বিষয়গুলোর দিকেও মনোযোগ দেয়া উচিত। যে কোনো বিষয়েই ইতিবাচক থাকা উচিত।’
অনেক বেশি মন খারাপ থাকলে তা স্বাভাবিক কাজকর্মের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে থাকে। কাজে ঠিকমতো মন বসে না, এবং দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আবার এই আবেগটি যখন কাজ করতে থাকে তখন যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয় তাও পরবর্তী জীবনের জন্য খারাপ হয়।
মন খারাপ ভালো করার উপর আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে অনেকাংশে। তাই চলুন দ্রুত মন ভালো করে ফেলার কিছু উপায় জেনে নেয়া যাক ঝটপট।
ধর্মীয় কাজে মনযোগ
ধর্মীয় কাজে মনযোগ দিতে পারেন মন ভাল হয়ে যাবে। আপনি ওযু করে সামান্য সময় কোরআন তেলাওয়াত করেন। দেখবেন- আশা করি মন ভালো হয়ে যাবে।
একটু থেমে চিন্তা করুন
চারপাশের পরিস্থিতি কোনোকালেই আপনার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। যার হাতে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ তিনিই সেরা পরিকল্পনাকারী। আর তার চেয়ে বেশি কেউ আপনাকে ভালোও বাসে না। কাজেই সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দিন। দেখবেন, কী নির্ভার লাগছে!
বড় করে শ্বাস নিন
যখন অনেক বেশি মন খারাপ হবে তখন তা আমাদের মস্তিষ্কে চাপ ফেলবে এবং মানসিক অশান্তি ও চাপ বাড়তে থাকবে। এই জিনিসটি দূর না করতে পারলে মন ভালো হবে না। তাই বড় করে শ্বাস নিন ও ধীরে ধীরে ছাড়ুন। এতে মস্তিষ্ক রিলাক্স হবে ও মানসিক চাপ কমতে থাকবে। সেই সাথে কমবে মন খারাপের মাত্রাও।
পানি পান করুন
অনেক সময় ডিহাইড্রেশনের জন্য আমাদের মানসিক চাপ বেড়ে যায় এবং মন খারাপটি আরও বেশি করে আমাদের সামনে চলে আসে। তাই মন খারাপ দূর করতে পানি পান করে নিন এক নিঃশ্বাসে ১ গ্লাস। পানি পানের ফলে অনেকটা হালকা হয়ে যাবে মন।
চিৎকার করে নিন
সাইকোলজিস্টদের মতে আমরা যখন চিৎকার করি তখন আমাদের মস্তিষ্কে যে হরমোনের সৃষ্টি হয় তা মন খারাপের বিষয়টি দূর করে দেয়। তাই অনেক বেশি মন খারাপ লাগলে চিৎকার করুন একলা বসে, আপন মনেই। অথবা লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদবেন না। চিৎকার করেই কেঁদে নিন খানিকক্ষণ।
সিনেমা দেখতে যান
সিনেমা দেখতে যেতে পারেন। সিনেমা হলে যাওয়া সম্ভব না হলে ল্যাপটপেই সবচেয়ে প্রিয় বা কোনো মজার হাজির সিনেমা দেখতে পারেন।
রান্না করুন
আপনি যখন বিষণ্ন থাকবেন তখন, নিজের পছন্দের মজার কোনো খাবার খেয়ে নিন। বিশেষ করে চকলেট ধরণের কিছু খাবার। এতে করে ভালোলাগা আপনাআপনি উৎপন্ন হবে। কারণ পছন্দের কিছু করলে এবং খেলে মস্তিষ্কে ‘সেরেটেনিন’ নামক ভালোলাগার হরমোন উৎপন্ন হয়।
হঠাৎ একটি ছোট্ট উপহার
উপহার পেলে কার না মন ভালো হয়? কোনো উপলক্ষ থাকলে তো একে অন্যকে উপহার দেওয়াই হয়। নিজের মনের শান্তির জন্য কিছু করা উচিত। এতে করে নিজ থেকেই মন খারাপ দূর হয়ে যাবে। এর জন্য যে আপনাকে অনেক খরচ করতে হবে তা কিন্তু নয়। একটি ফুল বা ছোট্ট একটি কার্ডই মন খারাপ দূর করে দিতে পারে।
পুরোনো স্মৃতি মনে করুন
ছোটবেলায় ডায়েরি লিখতেন নিশ্চয়ই! এই অভ্যাসটি প্রেমিককে খুশি করার জন্যও কাজে লাগাতে পারেন। সম্পর্কের শুরু থেকে কোথায় কোথায় বেড়াতে গিয়েছেন, মজার কোনো স্মৃতি আরও একবার মনে করুন। একসঙ্গে কাটানো কিছু মুহূর্তের ছবিও ব্যবহার করতে পারেন। কয়েক পাতার একটি চিঠি লিখে পুরোনো যেকোনো ভালো স্মৃতি মনে করুন।
প্রশংসা
প্রশংসা ও ভালোবাসা হচ্ছে এমন দুটি জিনিস, যা যেকোনো মানুষের মন নরম করে দেয়। নিজেকে ছোট মনে করা বন্ধ করুন। নিজের সঙ্গেই নিজে শেয়ার করুন। মন খারাপ থাকলে নিজের সঙ্গেই নিজেই প্রশংসা করুন, দেখবেন একসময় ঠিকই মন খারাপ দূর হয়ে গেছে।
ব্যায়াম করুন
শুধু সুস্বাস্থ্যের জন্য নয়, মন ভালো রাখতেও ব্যায়াম বেশ উপযোগী। মাত্র পাঁচ মিনিট টানা ব্যায়াম করলে এন্ড্রোফিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়। যা ১২ ঘণ্টা মন ভালো রাখতে সহায়তা করে। এর জন্য জিমে যাওয়া তেমন জরুরি হয়। ঘরেও করা যায় এমন ব্যায়াম করলেও তা মানসিক অবস্থার উন্নতিতে সহায়তা করবে। তাছাড়া অবসাদ দূর করতে যোগ ব্যায়ামও বেশ কার্যকর। তবে আগে ভালোভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে তবেই যোগ ব্যায়াম করা উচিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকুন
বর্তমানে মানুষের জীবন অনেকটাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক হয়ে উঠেছে। সারাদিন কী করা হয়েছে বা কী চলছে সবই যেন সবাইকে জানানো চাই। এক্ষেত্রে অনেক সময় অন্যের জীবনযাপন দেখেও হতাশাগ্রস্ত হয়ে যান অনেকে। তাই মন ভালো রাখতে কিছু সময় এ ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নিজেকে দূরে রাখুন।
নিজেকে সময় দিন
ব্যস্ততার মাঝে অনেক সময়ই নিজের জন্য আলাদা সময় বের করা হয়ে ওঠে না। তাই নিজের জন্য আলাদা করে কিছুটা সময় বের করে নিন। পার্লারে গিয়ে অয়েল ম্যাসাজ বা ফেইশল করিয়ে নিন। পার্লারে যাওয়ার সময় না হলে ঘরেই নিজের যত্ন নিন। নখে নতুন নেইলপলিশ লাগিয়ে নিন, ঘরোয়া ফেইসমাস্ক লাগিয়ে পছেন্দের গান শুনুন।
আর ছেলেরা চাইলে আরামে শুয়ে বই পড়তে পারেন। যেটাই করুন না কেনো খেয়াল রাখুন সেটা যেন নিজেকে যত্ন করার বিষয় থাকে।
বাইরে কথাও ঘুরতে চলে যান
মন ভালো করার আরেকটি ভালো উপায় হচ্ছে এক জায়গায় বসে না থেকে ঘুরে আসা। বাসায় বসে থাকা কিংবা অন্য কোনো স্থানে বসে থাকলে মন ভালো হবে না মোটেই। বেড়িয়ে পড়ুন। ঘোরাঘুরি এবং হাঁটাহাঁটির মধ্যমে ও প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার মাধ্যমেও মন খুব দ্রুত ভালো হয়ে যায়।
এছাড়াও বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন, সবাই একসঙ্গে খেলা দেখতে পারেন, গান করতে পারেন। সব মিলিয়ে সময়টাকে উপভোগ করতে পারেন।
একচেটিয়া মেয়েদের প্রশংসা করতে করতে আমরা অনেকেই হয়তো ছেলেদের ভালো দিকগুলো দেখার চেষ্টা করি না।
বিপদে-আপদে কিংবা মন খারাপ থাকুক আর যাই থাকুক, আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার জন্য মা আছে। শক্তহাতে ধরার জন্য আপনার বাবা আছে। ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখার জন্য আপনার স্ত্রী আছে। ভালো বন্ধুবান্ধব আছে। থাকার মতো একটা ঘর আছে। সব মিলিয়ে দেখুন পৃথিবী আর তার সব কিছুই আপনার জন্য। আর নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্বটাও আপনার। তাহলে এত কিছু থাকার পরও মন খারাপ করে থাকার কোনো মানে হয় না আর আছে!
এখন ভেবে দেখুন আপনার সময় আর সুন্দর সবকিছুকে ফেলে আপনি মুখ গোমরা করে বসে থাকবেন নাকি মুখের কোণে একটু হাসি রাখবেন!
বিবার্তা/শারমিন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]