শিরোনাম
‘ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো আইসিটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে’
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০১৭, ১৮:৪৬
‘ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো আইসিটি বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে’
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

২০১৩ সালে এসইও এবং অনলাইন মার্কেটিং ক্যাটাগরিতে বেসিস বেস্ট ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন মো. আলী আজগর। ২০১৩ সালে ফ্রিল্যান্সারডটকমের সার্ভেমতে পৃথিবীর সেরা ১০০ ফ্রিল্যান্সারদের তালিকায়ও জায়গা করে নেন তিনি।


বর্তমানে তিনি শীর্ষস্থানীয় অনলাইন মার্কেটপ্লেস ফ্রিল্যান্সারডটকম সাইটের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ক্যাটাগরির ফেসবুক, ইন্টারনেট মার্কেটিং ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাব-ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছেন। তিনি এ পর্যন্ত ২৯১৮ টি প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছেন। ফ্রিল্যান্সারডটকম সাইটের ৫টি ক্যাটাগরি - কোয়ালিটি অব ওয়ার্ক, কমিউনিকেশন দক্ষতা, কাজের আহ্বান, পেশাগত দক্ষতার ওপর তার সফলতা শত ভাগ।


বুধবার দুপুরে বিবার্তা২৪ডটনেটের কার্যালয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয় মো. আলী আজগরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।


বিবার্তা : ফ্রিল্যান্সিংকে অনেকে ভালো সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন। এর কারণ কী?


মো. আলী আজগর : বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও ফ্রিল্যান্সিং একটি সময়োপযোগী পেশা। উন্নয়নশীল দেশে বেকার সমস্যা অনেক বেশি, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কম। বিপরীতে ফ্রিল্যান্সিং পেশা স্বাধীনভাবে কাজ করে অন্য পাঁচটা জব থেকে বেশি টাকা আয় করার সুযোগ রয়েছে। নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করে পরিকল্পনা অনুসারে ফ্রিল্যান্সিং করতে পারলে এক সময় দেশ থেকে বেকার সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে।



বিবার্তা : এই খাতে প্রতিবন্ধকতাগুলো কি কি?


মো. আলী আজগর : দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। এছাড়া এখনো সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ না থাকলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া যায় না। ইন্টারনেট, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের মূল্য অনেক বেশি।


এছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ে পেপ্যাল গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যা। এসব কিছু সহজলভ্য করতে হবে। আর ফ্রিল্যান্সারের শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে শিক্ষার কারিকুলাম আইসিটি বিভাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।


বিবার্তা : ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কি?


মো. আলী আজগর : দেশে যখন কোনো ট্রেন্ড শুরু হয় তখন এর প্রভাব পড়ে সারাদেশে। দেশে এখন অনেক ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এই ক্যারিয়ারটা এখন সবার চোখে পড়ার মতো হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্রোশিয়ারে এমন স্লোগান লেখা থাকে, ‘৭২ ঘন্টায় ফ্রিল্যান্সার’, ‘১৫ দিনের মধ্যে ফ্রিল্যান্সার’, ‘তিন মাসে ফ্রিল্যান্সার’। এগুলো যারা পরিচালনা করছে তাদের অনেকেরই ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণাই নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কোনোরকম একটা কোর্স করেই একটা নামকাওয়াস্তে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে বসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রকৃত শিক্ষা তো হচ্ছেই না, বরং প্রশিক্ষণের নামে তরুণ-তরুণীদের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামের সহজ-সরল তরুণ-তরুণীরা আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখে ঋণ করে, এমনকি জমি বন্ধক রেখেও এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান প্রশিক্ষণ নিতে। এই সুযোগটা নিচ্ছে ওই প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলো।



বিবার্তা : এই প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার উপায় কি?


মো. আলী আজগর : প্রথমত, যারা কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, ভালো বোঝেন, ফ্রিল্যান্সিং কাজে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য এমন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।


দ্বিতীয়, নিয়মিত ফ্রিল্যান্সিং করছেন এমন দক্ষ কয়েকজন ফ্রিল্যান্সারকে নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটা কমিটি গঠন করে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসলেই কি ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে, না টাকার বাণিজ্য করা হচ্ছে, তা তদারক করতে হবে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে একটা ক্রাইটেরিয়া তৈরি করে দিতে হবে। কিছু নিয়ম বেঁধে দিলে বছরশেষে সেই নিয়মমাফিক ফল না পেলে তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। এমন কিছু উদ্যোগ নিলে প্রশিক্ষণের মান ভালো হবে, তরুণরাও প্রতারিত হবে না।


বিবার্তা : বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কেন এমন হয়?


মো. আলী আজগর : বাংলাদেশে আইটির সুফল ভোগ করা শুরু হয়েছে অল্প কিছুদিন ধরে। সুতরাং তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে ঘরে বসেই যে অন্য দেশের কোনো কোম্পানিতে চাকুরি করা সম্ভব, বিষয়টি অনেকের কাছেই এখনও অবিশ্বাস্য। আবার অনেকের এ বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই। সেজন্যই ফ্রিল্যান্সিং পেশাটি এখনও উপেক্ষিত। আমি মনে করি, ফ্রিল্যান্সিং যে চমৎকার একটা পেশা সেটাকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় নাই। এই স্বীকৃতিটা আগে দিতে হবে। যেমন কেউ ব্যাংকে কাজ করলে বলা হয় ব্যাংকার। এটা একটা পদবী। তেমনিভাবে ফ্রিল্যান্সারও যে একটা সম্মানজনক পেশা, এর মাধ্যমে ঘরে বসে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়, এরও একটা পদবী দেয়া দরকার। এখনই এই স্বীকৃতি দেয়ার উপযুক্ত সময়।



বিবার্তা : এ থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে কি?


মো. আলী আজগর : ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ফ্রিল্যান্সার তৈরি এবং নতুন ফ্রিল্যান্সারদের সঠিক গাইডলাইন দেওয়ার জন্য ব্লগ, সোশ্যাল মিডিয়া, পত্রিকাতে লেখালেখি, সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে এ সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ইতোমধ্যে এগুলো হচ্ছেও প্রচুর। সেজন্য শহরকেন্দ্রিক এ বিষয়ে সবার মধ্যে ধারণার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, আরও পরিবর্তন হবে। কারণ, এ ব্যাপারে সরকার থেকেও ব্যাপক চেষ্টা চলছে।


বিবার্তা : ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশকে কীভাবে দেখতে চাইছেন?


মো. আলী আজগর : সরকারি-বেসরকারিভাবে সারাদেশে তরুণ-তরুণীদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ, সেমিনার, ক্যারিয়ার ক্যাম্প আয়োজন করা হচ্ছে। এটা আশার দিক। তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, ঘরে বসেই অনেক কাজ করা সম্ভব। একটা ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ হলেই এই পেশায় ঘরে বসেই মাসে আয় করা যায় হাজার ডলার।


গত দুই বছরে দেশে অনেক নারী ফ্রিল্যান্সারও তৈরি হয়েছে। তারা এখন ঘরে বসেও প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইনিং, আউটসোর্সিং বা ই-কমার্স বিজনেসের কাজ করছেন। আমি চাই, ২০২১ সালের মধ্যে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। নারী-পুরুষ এক সাথে ফ্রিল্যান্সিং করে দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করবে।



বিবার্তা : তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে দেশব্যাপী তরুণ-তরুণীদের ‘লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রশিক্ষণ দেয়াকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?


মো. আলী আজগর : লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৫০ দিনব্যাপী ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং ডিজিটাল মার্কেটিং হাতে-কলমে শেখানোর একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা মহৎ উদ্যোগ।


আসলে ফ্রিল্যান্সিং নামটি যত সহজ মনে হয়, কাজের ক্ষেত্রে ততটা নয়। এটি একটি বিশাল জগত। এখানে জানার, বোঝার, শেখার অনেক কিছু আছে। এখানে যেটা করা হচ্ছে সেটা হলো, ফ্রিল্যান্সিং কাজের জন্য প্রাথমিক ভিত্তি নির্মাণ করা হচ্ছে।


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইসিটি বিভাগ থেকে সারাদেশে এসব প্রজেক্ট যাদের দেয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নাই। ফলে তারা কিছু টাকা ব্যয় করে অদক্ষ প্রশিক্ষক ভাড়া করে এসব প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছেন। প্রজেক্ট অনুসারে ফ্রিল্যান্সিং শেখানো হচ্ছে, কিন্তু মাত্র ৫০ দিনের প্রশিক্ষণে প্রকৃত শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে কাজ করলে ২০২১ সাল নাগাদ সরকারের যে স্বপ্ন রয়েছে বাংলাদেশকে একটা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করা, তা অধরাই থেকে যাবে।


এক্ষেত্রে আমার মতে, কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, ভালো বোঝেন, ফ্রিল্যান্সিং কাজে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণগুলো পরিচালনা করলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা লাভ করতে পারতো। প্রতিটি জেলা থেকে ১০জন করে ফ্রিল্যান্সার বেরিয়ে এলেও তাদের পরবর্তীতে মেন্টরশীপের ব্যবস্থা করলে সরকারের স্বপ্ন কিছুটাও হলে তারা পূরণ করতে পারতো।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com