শিরোনাম
‘ভয়কে জয় করলে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীরা ভাল করবে’
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০১৭, ২০:২৮
‘ভয়কে জয় করলে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীরা ভাল করবে’
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সহ-সভাপতি লাফিফা জামাল। এর বাইরেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির (বিসিএস) কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজির (বিডাব্লিউআইটি) পরিচালক, ঢাকা ইউনিভার্সিটি সায়েন্স সোসাইটির (ডিইউএসএস) মডারেটর এবং আইইইই ওম্যান ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাঞ্চের উপদেষ্টা হিসেবে।


তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের এগিয়ে নিতে এবং তরুণ-তরুণীদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহী করতে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করছেন লাফিফা জামাল। সম্প্রতি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নিজ অফিসে মুখোমুখি হন বিবার্তার। জানান প্রযুক্তি খাতে নারীদের বর্তমান হালচালসহ নারীদের এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা-সমস্যা নিয়ে নানান কথা। দীর্ঘ আলাপের কিছু চুম্বক অংশ বিবার্তার পাঠকদের জানাচ্ছেন প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ


বিবার্তা : তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের এগিয়ে নিতে আপনারা কী কী কাজ করছেন?


লাফিফা জামাল : বিশ্বব্যাপী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর প্রয়োগ জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। এর ফলে একদিকে মানুষের জীবন হয়ে উঠছে সহজ, অন্যদিকে এই প্রবৃদ্ধি উন্মোচন করছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি অংশ নারী। এই নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে আগ্রহী করে তুলতে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) বছরজুড়েই প্রশিক্ষণ কর্মশালা, ক্যাম্প, সেমিনার, ক্যারিয়ার মেলা, উদ্যোক্তা মেলা, প্রোগ্রামিং কনটেস্টসহ নানা প্রোগ্রামের আয়োজন করছে। নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে ‘গ্রেস হপার গার্লস প্রোগ্রামিং ক্যাম্প’ ও ‘এডা লাভলেস প্রোগ্রামিং ক্যাম্প’। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে ‘মার্গারেট হ্যামিল্টন প্রোগ্রামিং ক্যাম্প’। আগামী এপ্রিলের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হবে ‘ন্যাশনাল গার্লস প্রোগ্রামিং কনটেস্ট’। ইতোমধ্যেই ওই প্রোগ্রামের রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়ে গেছে। আর ন্যাশনাল হাইস্কুল প্রোগ্রামিং কনটেস্টের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা তো সারাদেশে চলছেই। এবছর ১৬টি আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি তিনটি উপজেলায়ও এ আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে।



সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্তৃতির কারণে এখন আমাদের সবাইকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে মেয়েদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির। তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি হয়রানিও হতে হচ্ছে। কীভাবে নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়, সে ব্যাপারে যদি নারীদের আমরা দক্ষ ও সচেতন করতে পারি, তাহলে তারা অনেক রকমের ঝামেলা এড়িয়ে কাজ করতে পারে। দেশব্যাপী নারীদের এই সচেতনতা বৃদ্ধিতে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিক্স ও মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাথে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের একটা চুক্তি হয়েছে। চুক্তির আওতায় অনলাইনে নারীদের প্রতি যে সহিংসতা হচ্ছে, তা প্রতিরোধে করণীয় এবং কেউ সহিংসতার শিকার হলে কী করতে হবে এ বিষয়ে দেশব্যাপী আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজন করা হবে। সমাপনী পর্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সম্মেলন।


বিবার্তা : তথ্যপ্রযুক্তি ক্যারিয়ারে নারীদের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?


লাফিফা জামাল : তথ্যপ্রযুক্তি এমন একটি সেক্টর, যেখানে মূলত মস্তিষ্কের কাজ করতে হয়। এখানে কোথাও শারীরিক শক্তি দেখিয়ে কাজ করার উপায় নেই। এটা ছেলেদের আর এটা মেয়েদের কাজ – এরকম কোনো বিভাজনের সুযোগ নেই। নারী-পুরুষ দুজনেরই কিন্তু সমান মেধা থাকে। বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামার কিন্তু ছিলেন একজন নারী, যার নাম লেডী এডা লাভলেস। ফেসবুকের প্রধান অপারেটিং অফিসার শেরিল কারা স্যান্ডবার্গ। গিটহাবের সাম্প্রতিকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওপেন সোর্স প্রজেক্টে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের প্রোগ্রামিং কোড গৃহীত হওয়ার হার বেশি। কাজেই তথ্যপ্রযুক্তি ক্যারিয়ারে নারীদের সম্ভাবনা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। মনোবলের অভাব এবং প্রযুক্তিভীতির কারণেই মেয়েরা সাধারণত পিছিয়ে যায়। এই ভীতি জয় করতে পারলেই তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীরা ভালো করবে।


তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল যে, ঘরে বসেই অনেক কাজ করা সম্ভব। একটা ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই সমস্ত পৃথিবী চলে আসে হাতের মুঠোয়। যদি কোনো নারী কাজ জানেন, তাহলে বাইরে কাজ করার পাশাপাশি ঘরে বসেও প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইনিং, আউটসোর্সিং বা ই-কমার্স বিজনেসের কাজ করতে পারেন। গত দুই বছরে দেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। তারা তাদের উদ্যোগকে সফল করার জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।



বিবার্তা : আইটি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ কতটুকু বেড়েছে বলে মনে করছেন?


লাফিফা জামাল : আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আমরা যখন কাজ শুরু করেছি তখন তথ্যপ্রযুক্তিতে হাতেগোনা কয়েকজন নারী কাজ করতেন। এখন এই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। সরকারি হিসেবমতে বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিক্ষেত্রে ৯% নারী কাজ করছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে কর্মরত নারীদের হার কিন্তু সারা বিশ্বেই কম। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ২০১৫ সালে তথ্যপ্রযুক্তিতে ১৬% নারী কাজ করতেন। দুই বছর আগের এক পরিসংখ্যানে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে শুধু প্রোগ্রামিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়ার জন্য মাত্র ১% মেয়ের আগ্রহ রয়েছে। তবে এখন সরকারি-বেসরকারিভাবে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর নানা কার্যক্রম পরিচালনার ফলে তাদের অংশগ্রহণ ও আগ্রহ অনেক বেড়েছে।


২০১৫ সালে বাংলাদেশে আইসিপিসির অনলাইন প্রিলিমিনারি কনটেস্টে মেয়েদের দল ছিল মাত্র ১০টি, ২০১৬ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৯টিতে। গত দুই বছরে মেয়েদের দলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মেয়েদের আইসিটিতে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য যে কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে, এটা তার প্রতিফলন।


আরেকটি দিক হল, সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা নারীবান্ধব করা হয়েছে। নারীদের আইসিটিতে নিয়ে আসতে এবং ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আইসিটিকে পেশা হিসেবে নেয়ার জন্য সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা সরকার করছে। আমি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে এজন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। আমরা যদি যথাযথভাবে এ সুযোগগুলোকে কাজে লাগাই তাহলে তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ আরও অনেক বাড়বে।



বিবার্তা : তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর উপরে ওঠার পেছনে কী প্রতিবন্ধকতা লক্ষ্য করছেন।


লাফিফা জামাল : অন্য আর দশটা পেশার মতো এক্ষেত্রেও আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক বাধা মূলত নারীদের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এটা শুধু আইসিটিতেই নয়, সব ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে একই সমস্যা। একজন পুরুষ যত সহজে তার ক্যারিয়ার গঠন করতে পারে নারীর পক্ষে তা অতটা সহজ নয়। নারীকে বেশ কিছু সামাজিক-পারিবারিক-মানসিক বাধা পেরিয়ে আসতে হয়। তাই অনেক সময় তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে সফলভাবে শিক্ষা-কার্যক্রম শেষ করা মেধাবী ছাত্রীদের আমরা অকালে ঝরে যেতে দেখি।


বিবার্তা : এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?


লাফিফা জামাল : সামাজিক বাধাগুলো অতিক্রম করার দৃঢ় মনোবল ও আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হলে চলবে না। নিজের মধ্যে পেশাদারিত্ব থাকতে হবে। নিজের পথ নিজেকে তৈরি করতে হবে – সামনে এগুনোর পথ কেউ তৈরি করে দেবে না। কাজের মধ্যে সমস্যা আসবেই। সেই সমস্যার কথা চিন্তা না করে তার সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মেয়েদের নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্কিং বাড়াতে হবে। ভয়কে জয় করে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।



নারীদের ঘরে-বাইরে দুদিকে সামলাতে হয়। কিন্তু ঘরের ব্যস্ততাকে কখনও কাজের ক্ষেত্রে অজুহাত হিসেবে দেখানো যাবে না। সঠিকভাবে টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে পারলে সব দিকই সামলানো সম্ভব। যে কোনো সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে না দেখে পজেটিভ মনোভাব নিয়ে এর মধ্যে থেকে কীভাবে বের হবো তা খুঁজে এর মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।


বিবার্তা : নারীরা প্রতিনিয়ত ইন্টারনেট প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি?


লাফিফা জামাল : এখন আমার হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমার স্মার্টফোন, আমার ল্যাপটপ। এই স্মার্টফোন আমি ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারি, আবার অনেক খারাপ কাজেও। এই ফোন ব্যবহার করে কারো কোনো বিপদ হলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারছি। আবার একই ফোন দিয়ে নারীকে হয়রানিও করছি। এটা তো স্মর্টফোন বা প্রযুক্তির দোষ না। দোষ আমাদের মানসিকতার। সুশিক্ষা, পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা – এই তিনই পারে আমাদের রক্ষা করতে। পাশাপাশি মেয়েদেরকেও সচেতন হতে হবে। নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার শিখতে হবে। নিজের অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। প্রাইভেসি বজায় রাখতে হবে।


বিবার্তা : নতুন প্রজন্মর নারীদেরকে কী আপনি কোনো মেসেজ দিতে চান?


লাফিফা জামাল : এখনকার যুগে নারীদের খুব বেশি আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। নারী-পুরুষ সবাইকেই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করে এগিয়ে যেতে হবে। নিজের ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে, সঠিক পরিকল্পনা করে পেশাদারিত্বের সাথে নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারীর মেধা কোনো অংশেই পুরুষদের চেয়ে কম নয়। সেই মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালেই জীবনে সফলতা আসবে।


বিবার্তা/উজ্জ্বল/মৌসুমী/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com