সাক্ষাতকার
'মসলিন পুনরুদ্ধার করেছি, মান বজায় রেখে ভোক্তার নিকট পৌঁছানোই লক্ষ্য’
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৪৯
'মসলিন পুনরুদ্ধার করেছি, মান বজায় রেখে ভোক্তার নিকট পৌঁছানোই লক্ষ্য’
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান (বেলাল) সিটেক্সট, এফটিআই। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন বংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ফ্যাকাল্টি অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিন হিসেবে। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়া প্রগতিশীল শিক্ষক পরিষদ কর্তৃক মনোনীত বুটেক্স শিক্ষক সমিতির সভাপতি। এছাড়া দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি হিসেবে।


বঙ্গবন্ধু ফেলো এর এই গ্রেড -১ অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ২০১০-২০১৪ এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে পিএইচডি করেছেন টেক্সটাইল সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে। এরআগে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ২০০১-২০০৩ এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার (ইউমিস্ট) থেকে এমফিল করেছেন টেক্সটাইল সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে। ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলজিয়াম সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বৃত্তি ১৯৯৪-১৯৯৬ এর মাধ্যমে ইউনিভার্সিটি অব যেন্ট থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএসসি করেছন। এরআগে ১৯৮৬-১৯৮৯ (অনুষ্ঠিত ১৯৯২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল টেকনোলজিতে বিএসসি করেছেন। নিজের শিক্ষাজীবনের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায়ও মেধায় স্বাক্ষর রেখেছিলেন তিনি।



বরেণ্য এই অধ্যাপক নিজের উজ্জ্বল শিক্ষাজীবনের পর বংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পেশাগত জীবনেও বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু ফেলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই অধ্যাপকের প্যাটেন্ট, পাবলিকেশনসহ অসংখ্য বই রয়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধার করেছে যে গবেষক দল, তিনি তাদের একজন। ব্যক্তিগত জীবনে নানা কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান।



বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী এই অধ্যাপক সম্প্রতি বিবার্তা২৪ডটনেটের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় মুখোমুখি হয়েছেন। আলাপে তিনি বঙ্গবন্ধু ফেলো, ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধারসহ ব্যক্তিজীবনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবার্তা প্রতিবেদক মহিউদ্দিন রাসেল।



বিবার্তা: আপনি প্রভাষক থেকে এখন গ্রেড-১ অধ্যাপক। আপনার এই যাত্রাটা কেমন ছিল?


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: আমি যখন ১৯৯২ সালে এখান থেকে (টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়) পাস করি তখন আমি ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড পজিশনে ছিলাম। প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানটি কলেজ ছিল। আমার রেজাল্টের পরে অনেকে বলতো, টিচার হিসেবে এখানে আসো। কিন্তু তখন এই আহ্বানের দিকে আমার আগ্রহ ছিল না। চিন্তাভাবনা ছিল প্রাইভেটে থাকবো, প্রাইভেটে জব করবো- এই রকম। এক পর্যায়ে এই কলেজ হওয়ার পরে সর্বপ্রথম ক্যাডারে নিয়োগ হওয়ার বিষয়টি সামনে আসল। এর আগ পর্যন্ত এখানে এডহকে নিয়োগ হতো অর্থাৎ পার্মানেন্ট নিয়োগ হতো না পিএসসির মাধ্যমে। এরপর সার্কুলার হলে আবেদন করলাম। এখানে অনেক সিনিয়ররা ছিল। কাজেই তাদের বাদ দিয়ে আমি সবেমাত্র পাস করা ছেলে চান্স পাবো এটা কঠিন ব্যাপার ছিল। এদিকে মাস্টার্স করাও অনেকে ছিল। তারপরে পরীক্ষা দিলাম। তখন দুইটা বোর্ড পিএসসিতে হয়েছিল। আমি যে বোর্ডে ছিলাম তার আরেকটা বোর্ডে আমার প্রিন্সিপাল ছিলেন, আমার এক স্যার ছিলেন (কাশেম স্যার)।



কিন্তু যখন আমার বোর্ড শুরু হয় তখন আমি একেবারে শেষের দিকে ছিলাম। আমার ইন্টারভিউ দুপুর –বিকালের দিকে হয়েছে। এক পর্যায়ে আমি দেখলাম, আমার তদানীন্তন প্রিন্সিপাল মোস্তাফিজুর রহমান স্যার আমার বোর্ডে এসে বসেছেন। একদিকে উনি বসায় অন্যদিকে নিজের জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ হওয়ায় একটু ভয়ও পেয়েছিলাম প্রথম দিকে। কিন্তু মোস্তাফিজুর রহমান স্যার এতো সুন্দর করে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন আর আমি জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হয় আধা ঘণ্টার উপরে আমার ইন্টারভিউ হয়েছে। সেইদিন আমার এতো ভালো ইন্টারভিউ হয়েছিল যে, বের হয়ে আমি বলেছিলাম –যদি ফেয়ার সিলেকশন হয় তাহলে অবশ্যই আমি পাবো। তারপর আমি সিলেক্টেড হলাম, বোর্ডে ফার্স্ট হলাম। আমার বর্তমান কলিগ ড. জুলহাস উদ্দিন সেকেন্ড হলেন। এই হিসেবে আমরা জয়েন করলাম। সিনিয়র হিসেবে আমি এক নম্বরে আর উনি দুই নাম্বারে ছিলেন।



আর এভাবেই চলতেই ছিলাম। এদিকে কলেজে তো প্রমোশন অনেক ডিলে করে হয়। ১৯৯৪ সালে স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম বেলজিয়ামে। এরপর সেখানে চলে গেলাম। সেখান থেকে দুইবছরের মাস্টার্স শেষ করে ১৯৯৬ সালে দেশে আবার ব্যাক করলাম। এর কয়েক বছর পরে সহকারী অধ্যাপক হলাম। আর এটাতে কাজ করতে করতে দেখলাম বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ শুরু হলো। এদিকে আমিও খোঁজ নিচ্ছি যে, স্কলারশিপ কোথায় পাওয়া যায়। কারণ পিএইচডি তো করা দরকার। ফলে স্কলারশিপ খোঁজতে খোঁজতে প্রায় ইআরডিতে যেতাম, কারণ আমার বেলজিয়ামের স্কলারশিপটাও ইআরডির মাধ্যমে হয়েছে।




ঐখানের এক অফিসার একদিন বলে দিলেন যে, আমাদের সরকারেরও স্কলারশিপ আছে। আমি জানতে চাইলাম কী স্কলারশিপ? তিনি বললেন-বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ। আমি বললাম শুনিনি তো কখনো। তখন এটার বিষয়ে খোঁজ নিলাম। এক পর্যায়ে এটার সার্কুলার হল, তখন আবেদন করলাম। এই বৃত্তির জন্য ১৪৯ জনের মতো আবেদনকারী ছিল। তার মধ্যে সম্ভবত ৪৭ জনকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকেছিল। বাকীদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। কারণ ঐ স্কলারশিপের একটা অলিখিত কন্ডিশন ছিল, এডমিশন হতে হবে ভালো ভালো ইউভার্সিটিতে অর্থাৎ এডমিশনের ফান্ড কালেক্ট করতে যারা পারতেছেনা তাদেরকে সুযোগ দেয়া হবে।



ভাইভা বোর্ডে যে ৪৭ জনতে ডাকা হলো আমার সিরিয়াল ছিল একেবারে প্রায় শেষের দিকে। এই ভাইভা বোর্ডে ১৯ জনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ছিলেন, এর মধ্যে ৬ জন ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আর বাকীরা ছিলেন সিনিয়র বিশেষজ্ঞ টিচার। এই ভাইভাতেও একটু ভয় পেলাম। আমি লক্ষ্য করলাম যে, বোর্ডের এক মাথায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফজলুল হক স্যার বসা, যিনি জাদরেল সচিব ছিলেন, আর আমি ক্যান্ডিডেট এই কোণায় বসা। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে এই ভাইভাটাও আমার খুব ভালো হলো। এই বোর্ড থেকে বের হয়ে আমি বলছিলাম আমি পাবো ইনশাআল্লাহ। ১৩ জনকে সিলেক্ট করা হলো আর আমি সপ্তম হলাম। এরপর এই স্কলারশিপ নিয়ে মাথা উঁচু করে ফ্যামিলি নিয়ে চলে গেলাম।


একটা জিনিস ভেবে আমার ভালো লাগল, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে এই বৃত্তি চালু করেছেন। আর এটা ছিল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম নিজস্ব অর্থায়নে বাহিরে হায়ার এডুকেশনে যাওয়া। ইতিপূর্বে কখনো এই রকম হয় নাই। পিএইচডি স্কলারশিপ আর কোন সরকার কখনো করে নাই। কাজেই বুকভরা গর্ব নিয়ে আমার ছোট দুইটা বাচ্চাসহ ফ্যামিলি নিয়ে চলে গেলাম ২০০১ সালে।



তারপর তো আমাদের কপাল খারাপ। সরকার চেঞ্জ হয়ে গেল,পট পরিবর্তন হয়ে গেল। আমাদের এক বছরের টিউশন ফি দেওয়া ছিল। আর তিনমাসের লিভিং খরচ দেওয়া ছিল। আর একটা পয়সাও আমাদের জন্য পাঠালো না তৎকালীন বিএনপি সরকার বরং আমাদের ব্যাক করার জন্য বলে দিল। আমরা চিন্তা করতেছি একটা বছরের টিউশন ফি দেওয়া। কাজেই এখনই চলে যাবো? একটু চেষ্টা করে দেখি না।



এরপর বারবার আমরা সরকারকে লিখলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা এমনও বললাম আমাদের লিভিং খরচ না দেন অন্তত টিউশন ফি’ টা দেন। আগে তো আমাদের দেওয়া হয়েছে। কাজেই এখন না দিলে সরকারের এই টাকাটা নষ্ট হবে। কিন্তু তাও দিবে না। আমাদেরকে ব্যাক করতে বললো। কিন্তু ব্যাক আর কে করে ? সবাই ঐখানে থেকে গেল। আমি জিদ করে ব্যাক করলাম। ব্যাক করার সময়ে আমি ফার্স্ট ইয়ারের রিপোর্ট জমা দিয়েছি। তখন আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে বললো যে, দেখো-তুমি এটাকে রি-রাইট করে এমফিল হিসেবে জমা দাও।



তখন আমি বললাম, এমফিল দিয়ে কী করবো? আমার তো মাস্টার্স করাই আছে। তখন তো এটার ওতো গুরুত্বও নাই। এরপর ঐখানকার টিচার আমাকে বুঝিয়ে বললেন -দেখো এমফিল কিন্তু মাস্টার্সের চেয়ে বড় ডিগ্রি। এরপর আমাকে বলা হলো , তুমি যদি এমফিলটা করে যাও তাহলে পরবর্তীতে আসলে দুইবছরে তোমার পিএইচডি কমপ্লিট হয়ে যাবে। আমি তখন বললাম, আমাকে তখন অফার লেটার দিবেন তো? তখন দেয়া হবে বলে জানালো হলো। এরপর আমি এমফিল হিসেবে রি-রাইট করলাম। আমি এটা ৩ তারিখে জমা দিলাম আর ৫ তারিখের টিকিট আমার কাটা ছিল। তখন বোর্ডের সুপারভাইজার আমাকে জিজ্ঞেস করলো- তুমি কি সত্যিই চলে যাবা? এরপর আমি তাকে ৫ তারিখের টিকিট দেখালাম। এরপর ঐ তারিখে আমি চলে আসলাম। আসার পরে বেশ কয়েক বছর পরে আমি সহযোগী অধ্যাপক হলাম। এখানে আসার পরে মাঝখানে আরও দুইটা স্কলারশিপ পেলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে।



এর মধ্যে একটা মরক্কো আরেকটা তার্কিতে। তবে এগুলো পেলেও জিদ করে গেলাম না। আমার চিন্তাভাবনা ছিল, দেখি- আমার নেত্রী আবার কবে আসেন? আমার বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধু ফেলো স্কলারশিপ আবার চালু হবে। আর সেটাতে যাবো। এজন্য বসে রয়েছি। আর বসে থাকতেই থাকতেই এক পর্যায়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার চলে আসলো। তারপর আবার আবেদন করলাম। তবে এই আবেদনটা অনেক কষ্টের ও দুরূহ ছিল। এরপর বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান স্যারের সাথে দেখা করলাম। তিনি খুব আন্তরিকতার সাথে জিনিসটা নিলেন। ঐ অফিস থেকে আমার শ্রদ্ধেয় আরেক স্যার বললেন, আপনি পিএম বরাবর আবেদন করেন। আমি তখন পিএম বরাবর আবেদন করলাম। ক্যাডার থেকে কোন মাধ্যম ছাড়া আমি সরাসরি আবেদন করবো, এটা খুবই দুঃসাহসী কাজ ছিল। আমার আশা ছিল আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আমার এপ্লিকেশন পায় তাহলে উনি এ বিষয়টিকে দোষ হিসেবে দেখবেন না। এই সাহস করে আমি এপ্লিকেশন করে দিয়েছি। আল্লাহর কী হেকমত। তিনমাসের মধ্যে আমি সাড়া পেতে থাকলাম। তখন এপ্লিকেশন ঘুরিয়ে বলা হলো লোকাল এমপির সুপারিশ লাগবে।



তখন আমাদের বর্তমান স্বরাষ্টমন্ত্রী কামাল ভাই, উনি তখন আমাদের এমপি ছিলেন। আমি তখন তার কাছে গিয়ে বললাম, এটা আপনি ফরওয়ার্ডিং না করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একচেপ্ট করতেছেন না। তারপর উনি সঙ্গে সঙ্গে ফরওয়ার্ড করে দিলো। সবমিলিয়ে তিনমাসের মধ্যে চিঠি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে গেল। আর বলা হলো ফান্ডের ব্যবস্থা করা হোক। এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একেবারে অর্ডার দিয়ে দিলাম। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বলা হলো, আপনি কি পিএমকে কোন এপ্লিকেশন করেছেন? আমি বলেছি, করেছি। এসময় কথা বলতে গিয়ে ভয় পেয়ে বলেছি আমি কি আসবো? তখন আমাকে বলা হলো আসতে হবে না। আপনার এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একচেপ্ট করে আমাদেরকে দিয়ে দিয়েছেন। তখন বলা হলো এটা কোথায় ছিল। আমি বললাম এটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ছিল। তখন শিক্ষা সচিব মহোদয় ফরওয়ার্ডিং করে দিয়ে দিলেন। তারপর আমি চলে গেলাম এবং ইয়াফেস ওসমান স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। স্যারও খুব খুশি। আমি স্যারকে বিষয়টি দেখতে বললাম।



বাংলাদেশের জন্য এটাও একটা ঘটনা যে, ৫মাসের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পটা ছেড়ে দিলেন। এসবের তথ্য কারো কাছে না থাকায় অর্থাৎ ফাইল সরে যাওয়ায় আমি তখন প্রতিদিন মন্ত্রণালয়ে খোঁজখবর রাখতাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ইয়াফেজ ওসমান স্যারের সঙ্গে মিটিং করতেন তখন ঐ প্রকল্পের যিনি সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি আমাকে ফোন দিতেন আর বলতেন – এটা কী? ঐটা কী? আর কারা কারা আছে? আমি তখন সবার নাম দিতাম। তখন তো অধিকাংশই ব্যাক করেনি।



এই হলো অবস্থা। আর এই অবস্থার মধ্যে আবার যখন চালু হলো তখন আমার কোন এপ্লিকেশন লাগে নাই। এদিকে আমার তখন ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায় আমি আবার স্কলারশিপ পাই। বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপে আমি সর্বপ্রথম পিএইচডি করে দেশে ব্যাক করি ২০১৪ সালে। ২০০১ সালে আমি যেহেতু পিএইচডিটা করতে পারি নাই, সেহেতু আমার প্রফেসর হতে দেরী হয়ে যায়। পরে ২০১৫ সালে আমি প্রফেসর হিসেবে জয়েন করি।


বিবার্তা: ব্যক্তিজীবনে আপনি ছাত্ররাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন। কেমন ছিল তখনকার ছাত্ররাজনীতি?


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: আমাদের সময়টাতে ছাত্রদলের যুগ ছিল। এরশাদের যুগও এই আমলটায় ছিল। তখন আমাদের ব্যাচের মধ্যে আমরা ৫/৬ জন দৃঢ়তার উপর ছিলাম। যারা সবসময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উপর টিকে থাকতাম। অনেক অত্যাচার আমাদের উপর হতো। আমার রুমমেট বড় ভাই ছিলেন তেঁজগাও এলাকার ছাত্রলীগের সভাপতি। বাকী রুমমেটরাও ছাত্রলীগের ছিল। ফলে এখানকার পরিবেশ ভালো ছিল। এরপরেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নানা সমস্যা ফেস করতে হয়েছে। তারপরেও আমরা টিকে থাকতে পেরেছি। আমি হলের মেস সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হলাম। আর সফলতার সাথে এ দায়িত্বও পালন করলাম। আমরা যখন ছাত্ররাজনীতি করতাম তখন বিশেষ করে ছাত্রলীগের ছেলে যারা ছিল তাদের সততা ও দৃঢ়তা ছিল। এককথায় তারা একুতোভয় ছিল। আমরা তো অন্যায় করতাম না। যার জন্য কোন কিছুকে ভয়ও পেতাম না।



বিবার্তা: বিএনপি শাসনামলে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় চালু নিয়ে আপনি জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। এটা নিয়ে যদি একটু বলতেন -


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: আমরা স্কলারশিপ পেয়ে অনেক আশা নিয়ে তৃতীয় ব্যাচের হয়ে গেলাম। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার এসে এই প্রকল্পটা আর বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার বন্ধ করে দিল অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু নামের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হলো। আরও একটা স্কলারশিপ ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মন্ত্রণালয়ের আণবিক শক্তি কমিশনে। সবমিলিয়ে আমরা ৮১ জন ছিলাম। আমাদের তখন আর টাকাপয়সা দেয়া হলো না। তখন আমরা চিন্তা করতে লাগলাম কী করা যায়? এদিকে একবছরের টিউশন ফি তো আমাদের দেয়া আছে। তখন আমরা বলতে লাগলাম- দেখি, সরকারের মন গলে কি-না? তারপরেও আমরা অনেক চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কোনভাবেই কোনকিছু হয় না। তখন বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যে নতুন মন্ত্রী আসলেন তাকেও বললাম। তাও কোন কাজ হয় না। শেষ পর্যন্ত উনারা আমাদের ব্যাক করতে বলে। এই ঘোষণার পর অধিকাংশ সেখানে থেকে যায় কিন্তু আমি ব্যাক করলাম। অথচ আমার তখন এমফিল করার পর পিএইচডির এক পার্ট শেষ হয়েছে। এদিকে আমার তো টিউশন ফি দিতে হবে। ঐ অবস্থায় আমি ব্যাক করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ৩ তারিখে আমার ভাইভা,প্রেজেন্টেশন হলো আর ৫ তারিখে আমি ব্যাক করলাম। এভাবে আসার পর ঐ আশা নিয়ে বসে ছিলাম আবার কবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসবে? এরমধ্যে দুইটা স্কলারশিপ পেলেও আমি যাইনি। তারপরেও আওয়ামী সরকার আসার পর থেকে আমি আর কালক্ষেপণ না করে আবেদন করলাম। একটা এপ্লাই করলাম ইয়াফেজ ওসমান স্যারকে আরেকটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।


তখন একদিকে প্রকল্পের কাজ চলছে অন্যদিকে আমি আমার মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকলাম। ইয়াফেজ স্যারকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে এনে আমরা বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ নিয়ে বলতে লাগলাম। অনেক প্রচেষ্টার পর এই প্রকল্পটি চালু হলো। আমি ৩ তারিখে চলে যাই। ৩১ তারিখে ঐ দফতরের সচিব মহোদয় আমাকে বলেন, আপনি চলে যান। আর কত অপেক্ষা করবেন? আমি বললাম ২০০৩ সাল থেকে আমি আমার এডমিশন কন্টিনিউ করছি। প্রতি বছর রিনিউ করতাম। এবার আমাকে বলা হচ্ছে তুমি ঠিক করে বলো তুমি আসবে কিনা? এখন তো তারা আমাকে আর সময় দিচ্ছে না।



তখন আমাকে বলা হলো, আপনি চলে যান। আমরা হয়ে গেলে আপনাকে জানাবো। ৩১ তারিখে এটা ডিজিশন হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি জানতে পারছিলাম না। আমি ৩ তারিখে চলে যায়। তখন আমার সুপারভাইজার বলে যে, এতো অনিশ্চয়তার মাঝে তুমি কিভাবে কি করবা? তুমি জানুয়ারি থেকে শুরু করো। আমি বললাম স্যার অনেক সময় আমার নষ্ট হয়েছে। আমি আর দেরী করতে চাই না। আমার সরকার আমাকে দিবে। এ বিষয়ে আমার পুরো বিশ্বাস আছে। আপনি শুরু করে দেন। এরপর সরকার আমাকে দিয়ে দিল। আর আমি তাদের জানিয়ে দিলাম। প্রথম দিকে খুব অল্প টাকা ছিল আমাদের। ২০০১ সালে ৫০০ পাউন্ড অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকা আসতো। পরবর্তীতে সরকার এটাতে সংযোজন করে বাড়িয়েছে, প্রতি মাসে ১ লাখ করে পেত ছেলেরা। আমি শেষের দিকে গিয়ে সেই সুযোগটা পাইনি। আমি শুধু চেষ্টা করেছি দ্রুত শেষ করে কিভাবে চলে আসবো। আলহামদুলিল্লাহ। সাড়ে তিন বছরে আমি পিএইচডি শেষ করে দেশে চলে আসি।



বিবার্তা: আপনি বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সবের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: আমি এই কলেজে জয়েন করি ১৯৯৩ সালের ২৫শে জুলাই। জয়েন করার পরে আমার তদানীন্তন যে স্যাররা ছিলেন অর্থাৎ পর পর যে তিনজন ভিসি ছিলেন উনারা কলেজে খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। এক পর্যায়ে আমাকে আজিজ হলে সহকারী সুপার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন মেইনলি একটা হলই ছিল আজিজ হল। আরেকটা ১০ রুম নিয়ে ছিল ওসমানী, ঐটাকে হল হিসেবে তেমন দেখা হতো না। কাজ করার সুবাদে কয়েক মাসের মাথায় আমি এডমিনিস্ট্রেটিভ মেম্বারের সদস্য হয়ে গেলাম। এটা তখনকার কলেজের সর্বোচ্চ বডি। শুরু থেকে ভর্তি পরীক্ষা, ভর্তি কার্যক্রম প্রশাসনিক কাজ, হলের কাজসহ সার্বিক বিষয়ে সবসময় জড়িত থাকতাম। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে আমি যখন দেশে ব্যাক করলাম এরপর থেকে ২০০৮ সালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটানা ৬/৭ বছর হলের প্রভোস্ট হিসেবে কাজ করেছি। এ হিসেবে আমার হলের অভিজ্ঞতা খুব বেশি। মাঝখানে কলেজে থাকা অবস্থায় হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব পালন করেছি। আর সত্যি কথা বলতেই প্রশাসনিক এই দায়িত্বগুলো পালন করতে আমার খুবই ভালো লাগে। যেহেতু এসব কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সুযোগ থাকে, সেহেতু এটাতে সবচেয়ে আনন্দ পেতাম।


বিবার্তা: এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতেন কি-না?


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক চ্যালেজ্ঞের মুখোমুখিও হয়েছি। কিন্তু আমার একটা দৃঢ়তা ছিল। আমি যখন ৫/৬ বছর হলের সুপার হিসেবে ছিলাম তখন আমার সাহস ছিল আমার তদানীন্তন প্রশাসন। নিতাই স্যার ছিলেন, কাশেম স্যার ছিলেন, উনারা শতভাগ সাপোর্ট আমাকে দিয়ে গেছেন। আমি হলে একচেটিয়াভাবে আমার মতো করে প্রশাসন চালিয়েছি। কোন রকম সমস্যা হয়নি। আমার উপর বিশ্বাস রেখে বলা হতো, তোমারটা তুমি করো। এসব দায়িত্ব পালনকালে শিক্ষার্থীদের সুবিধা ছাড়া অন্যদিকে আমি চিন্তা করি নাই। অনেক সময় হলের টাকায় আমি হলের উন্নয়নে কাজ করলে অনেকে নানা কথা বলতো। এখনো গেটের টাইলস, ওসমানী, আজিজ হলের টাইলস আমার লাগানো, আমার আমলের। এখানের বাস্কেটবলের কোর্ট করা আমার আমলের। আমি হল থেকে যতটুকু পারতাম এসব ব্যাপারে খরচ করতাম। এমনটি চেয়ার টেবিল পর্যন্ত আমি হলে বানিয়েছি। তখনকার ছাত্রনেতারাও আমার এসব কাজে বাধা দেয়নি। বরং তারা আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। যার জন্য আমি এগুলো করতে পারছি।



কলেজ থেকেও ফান্ড দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করা হয়েছিল। কাশেম স্যারের সময়ে আমি যখন বাস্কেট বলের কোর্ট করার পরিকল্পনা করি তখন আমি ছেলেদের শিখিয়ে দিয়েছিলাম যে, স্যারকে আসলে বলবা তোমাদের কোর্ট দরকার। এই রকম ভাবে অনেক কাজ আদায় করেছি। মসজিদের টাইলসসহ এরকম নানা কাজ করেছি হলের টাকায়। শিক্ষার্থীবান্ধব এসব কাজ করাতে তখন অনেকে আমাকে বলতো তুমি এতো টাকা খরচ করো কেন? অনুমোদন নাও না? তখন আমি বলতাম আমি ছাত্রদের টাকায় ছাত্রদের জন্য কাজ করি। যেহেতু আপনারা সরকারকে কোন টাকা দেন না, সেহেতু কী অনুমোদন নেবো? এভাবে আমি কথা বলতাম।



একবার স্যার রাগ হয়ে গেছে। তখন আমি স্যারকে ডেভেলপমেন্টের কাজগুলো দেখাতে নিয়ে গেলাম। যে স্থানে জঙ্গল ছিল মশার কামড়ে শিক্ষার্থীরা টিকতে পারতো না সেটা নিয়ে পরিকল্পনার কথা স্যারকে বললাম। স্যার গভীর রাত পর্যন্ত গেস্টরুমে বসে আমার কথা শুনলেন। এরপর স্যার আমাকে কল দিয়ে ডেকে নিয়ে গেলেন আর বললেন তোমার ঐ কাজের জন্য কত টাকা লাগবে? আমি হল ফান্ড থেকে কিছু দেবো। আপনি যদি ৯৩ হাজার টাকার মতো দেন তাহলে কাজটা হয়ে যাবে। এরপর স্যার আমার বলা এমাউন্টটা চেকে লিখে দিয়ে হাতে দিয়ে দিলেন। এই রকম সহযোগিতা আমি স্যারদের কাছ থেকে পাইছি। আমি প্রচুর ডেভেলপমেন্টের কাজ করেছি। আর এ কাজগুলো করে আমি আনন্দ পাই। ছাত্রদের জন্য কাজ করতে আমার ভালো লাগে। ইউনিভার্সিটিতে একমাত্র ভিসির পদ ছাড়া বাকী সবগুলোর পদের দায়িত্ব আমি পালন করেছি।



মাঝখানে আমি রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেছি প্রায় ২ বছর। ডিন হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতেছি। এরআগে হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্ট হিসেবে দুইটা মেয়াদ আমার হয়েছে। একাধারে প্রক্টর, স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ারের ডিরেক্টর, অধিভুক্ত কলেজের ইনস্পেক্টর হিসেবে কাজ করেছি। এমন কোন প্রশাসনিক পদ নেই,যেখানে আমার পদচারণা ছিল না। মাঝখানে স্যার একবার বাহিরে যেতে চেয়েছিলেন তখন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি ইস্যু করে আমাকে পুরো দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। পরে স্যার না যাওয়ায় এ দায়িত্ব আমার কাছে আর আসেনি। মোটকথা, প্রশাসনিক একমাত্র ভিসি পদ ছাড়া আর বাকী সব পদে আমি আল্লাহর রহমতে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি।


বিবার্তা: আপনার বিভিন্ন প্যাটেন্ট, পাবলিকেশন এবং প্রকাশিত অসংখ্য বই রয়েছে। এসব কী বিষয়ে, সেই সম্পর্কে একটু বলুন।


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: বই লেখাটা আমার জীবনের বড় একটা টার্গেট ছিল। কারণ আমি ছাত্রজীবনে পড়তে গিয়ে এবং পড়াতে গিয়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের উপযোগী আরও কিছু বইয়ের প্রয়োজন অনুভব করেছি। পরে সময় বের করে বিভিন্ন সময়ে প্রচুর শ্রম দিয়ে এসব বই লিখেছি। আমি আবার ড্রয়িং এ ভালো ছিলাম। এজন্য নিচের হাতে আঁকা ছবিগুলো এসব বইয়ে স্থান পেয়েছে।



বাংলাদেশ কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের জন্য দুইটি টেক্সটবুক আমার রয়েছে এগুলো হলো-ফেব্রিক ম্যানুফেকচার ৩ এবং স্ট্রাকচার অ্যান্ড অ্যানালিসিস অব ক্লথ। নিটিং -১,নিটিং-২ নামের এসএসসি (ভোকেশনাল) শিক্ষাক্রম নবম ও দশম শ্রেণির দুইটি সম্পাদিত গ্রন্থ রয়েছে। টেক্সটাইল শিক্ষার স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর পর্যায়ের একটি জনপ্রিয় এবং সর্বজন গৃহীত টেক্সটবুক (আন্ডারস্ট্যান্ডিং টেক্সটাইলস ফর এ মার্চেন্ডাইজার)রয়েছে, যেটি করতে আমার ব্যাপক কষ্ট করতে হয়েছে। বই লেখার ক্ষেত্রে আমি তথ্য উপাত্ত জোরালোভাবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি। এক্ষেত্রে যেখান থেকে যেটা দিয়েছি সেটার রেফারেন্সও বইয়ের শেষে দিয়েছি। উচ্চ ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর সম্পন্ন পিয়ার-রিভিউ জার্নালে বাইশটিরও (২২) অধিক গবেষণা প্রবন্ধ আমার রয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক কয়েকটি কনফারেন্সে যেমন পুর্তুগাল, যুক্তরাজ্য ইত্যাদিতে বিভিন্ন গবেষনা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছি।



বিবার্তা: আপনাদের দীর্ঘ ছয় বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ঢাকাই মসলিন আবার ফিরে এসেছে। ঢাকাই মসলিনের এই পুনর্জন্মের অভিজ্ঞতা,জানতে চাই।


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান:২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আবার মসলিনের একটা জাগরণ শুরু হলো। এই বছরের অক্টোবরের দিকে উনি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে আসেন একটি মিটিংয়ে। একটা বিষয় দেখেন- আমরা টেক্সটাইল নিয়ে থাকলেও আমাদের কারো মাথার মধ্যে এটা আসে নাই যে, আমরা মসলিন পুনরুদ্ধার করবো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ঠিকই খেলেছে। তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা মসলিন পুনরুদ্ধাদের চেষ্টা করেন। এ সুবাধে ২০১৬ সালে কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল, টেক্সটাইল থেকে আমি ছিলাম, তাঁত বোর্ড থেকে, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বিটিএমসিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। তারপর এই বিশেষজ্ঞ দল এটা নিয়ে আগাতে থাকলো। আমিও এই কমিটিতে থেকে চিন্তা করলাম, ভালো একটা সুযোগ আসলো।



আমি এখন জাতির জন্য কাজ করতে পারবো। এরপর ঐ কমিটির সাথে কাজ করা শুরু করলাম। প্রথমেই আমরা সেম্পলের বিষয়টিতে হাত দিলাম। তখন আমরা আমাদের প্রজেক্ট থেকে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে থাকলাম এই বলে যে, কারো কাছে এই রকম সেম্পল থাকলে তাহলে আমরা উপর্যুক্ত মূল্য দিয়ে কিনে নেবো। এরপর দেশের বিভিন্ন আনাচেকানাচে থেকে সংবাদ আসা শুরু করলো। তখন আমরা যাইতাম এসব দেখতে। কিন্তু গিয়ে দেখতাম সেটা আমাদের খোঁজারটা না। তারপর আমরা খোঁজা বাদ দিলাম।



একপর্যায়ে জানলাম আমাদের জাতীয় জাদুঘরে একটা সেম্পল আছে। ঐটা দেখার মতো সুযোগ আমাদের আর হয় না। আমাদেরকে বিভিন্নভাবে বাধাও দেয়া হলো। এদিকে সেম্পলের জন্য দুই ইঞ্চি চাইলেও সেটা দূরে থাক, দেখতেও দেয় না। এরপর একদিকে আমরা কাপড় খুঁজতেছি অন্যদিকে যে তুলা থেকে এই কাপড় হতো সেটাকে বলা হতো ফুটি কার্পাস। আর ফুটি কার্পাসের গাছ কেমন ছিল সেটার বিভিন্ন বর্ণনা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক ছাত্রকে দিয়ে ঐখানকার প্রতিনিধি মনজুর স্যারের সহযোগিতায় এই গাছের স্কেচটা তৈরি করা হলো। এরপর এটা নিয়ে আমরা বিভিন্ন জায়গার মধ্যে খোঁজা শুরু করলাম। এরপর এটাকে নিয়ে দেশের আনাচেকানাচে গহীনে গেলাম। অবশেষে একবার খবর পেয়ে খাগড়াছড়ির গভীর অরণ্যে গিয়ে এই গাছের সন্ধান পায়। এরপর কালেক্ট করা শুরু করলাম। এরকম করে করে ৩৯টা সেম্পল আমরা সংগ্রহ করলাম। সেখান থেকে ৬ টা সেম্পল আমরা সিলেক্ট করি। সেখান থেকে আবার সিলেক্ট করে সেটা নিয়ে আমরা এখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটির মনজুর স্যারের নেতৃত্বে কাজ করতেছি।



আসলেই সত্যিই বলতে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় যেমন পদ্মাসেতু হয়েছে, উনি না হলে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ দূরের কথা, শুরুই হতো না। ঠিক একইভাবে মসলিন তার তুলনায় ছোট্ট একটা প্রজেক্ট হলেও দুঃসাধ্য কাজ ছিল। সেটা উনার দৃঢ়তার কারণে আমরা করতে পারছি। অন্যথায় আমরা জীবনেও পারতাম না। কেননা, আমাদের এমন এমন সময় বসে পড়তে হয়েছে যে, এই বুঝি ছেড়ে দিলাম! কিন্তু আমাদের টিমে যারা ছিল তারা এতোবেশি ডেডিকেটেড ছিল যে সবারই এটাই প্রতিজ্ঞা ছিল যে, আমরা এটা করবোই। এদিকে প্রাইভেট একটা সংস্থা ছিল তাদের সাথে আমাদের কথা কাটাকাটি- জেদাজেদি চলছিল। আমরা করেই ছাড়বো এই রকম একটা পণ আমাদের ছিল। আমাদের প্রজেক্ট ডিরেক্টর আইয়ুব আলীরও যথেষ্ট দৃঢ়তা ছিল।


এক পর্যায়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি দেখে আসছি আলবার্টে। ওদেরকে আলবার্টে পাঠিয়ে দাও। তখন আমাদের ৫ সদস্য বিশিষ্ট টিমকে আলবার্টে পাঠালো। সেখানে দিয়ে একদিন পুরো আমাদের প্রোগ্রাম ছিল। সেখানে গিয়ে সেম্পল দেখলাম, মসলিন দেখলাম। সেখানে ৩০/৩৫ টা সেম্পল নিয়ে আমি নিজে অ্যানালাইসিস করেছি। সেখানে খুবই রেস্ট্রিকশন ছিল। গ্লাভস পড়া ছাড়া ঢুকা যাবে না। আমি তাদের বললাম কাপড়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ফিলিংস। কাজেই গ্লাভস পড়ে আমি তো সেটার ফিলিংস পাবো না। তখন শুধু আমাকে অনুমতি দিলো।



এরপর আমি আমার ২৫/৩০ টা সেম্পলের যে ফিজিক্যাল টেস্ট ছিল সেগুলো করে রুম থেকে বের হয়েছি। এরপর বলেছি মসলিন তৈরি করতে পারবো। মসলিন তৈরি হয়ে গেছে। এই মসলিন আর আমাদের কয়েকশ বছর আগের মসলিন সেম্পলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আর এটা এখনও আমাদের রিসার্চের আন্ডারে রয়েছে। আমাদের এই কাজ দেখে বিশেষজ্ঞরা অভিভূত হয়েছে। এটা দেখে আমাদের আরো বেশি আগ্রহ জাগছে। এই মাসের শেষের দিকে একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার হবে। আমরা অলরেডি অনেকগুলো সেম্পল তৈরি করে ফেলেছি। আমরা যে সুতা তৈরি করেছি সেটা প্রায় ৭০০ মেট্রিক কাউন্টের সুতা। যেটা প্রায় ৪৫০ ইংলিশ কাউন্টে আসে। এটা আমরা সর্বোচ্চ তৈরি করেছি ৭৩০ মেট্রিক কাউন্ট। অল এভারেজে আমরা কাপড়গুলো তৈরি করতেছি ৫০০ মেট্রিক কাউন্টকে দিয়ে। ফলে এখানে ৩০০ কাউন্টের মতো সুতা আসে।



আগের সিস্টেমে কাজগুলো করা হচ্ছে। ম্যানুয়ালি সুতা কাটা হচ্ছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মসলিন হাউস দিয়ে দিয়েছেন শীতলক্ষ্যর পাড়ে। সেখানে ১০টা তাঁতে আমাদের সমানে কাপড় তৈরি হচ্ছে। পরবর্তীতে আমরা যেটা করবো এক্সপোর্ট অ্যাম্বাসির প্রতিনিধির সাথে কথা বলে এটার ব্যাপক প্রসার করা হবে। তবে আমাদের দাবি থাকবে সরকারের যেন এটাতে একটা কন্ট্রোল থাকে। প্রাইভেটেও যাদেরকে দিবো তারা যেন কোয়ালিটির সাথে এদিক ওদিক করতে না পারে। যে মসলিনটা হারিয়ে গিয়েছিল সেটাকে যেভাবে আমরা পুনরুদ্ধার করেছি, সেটাকে যেন আমার মান বজায় রেখে ভোক্তার নিকট পৌঁছাতে পারি।



বিবার্তা: আপনি বিভিন্ন প্রেস্টিজিয়াস অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। এসব নিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার অনুভূতি তো অবশ্যই ভালো। এটাতে খুবই ভালো লাগে, আনন্দ লাগে। মসলিনের জন্য প্রজেক্টে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি আমরা। এটার জন্য ২০২১ সালে জনপ্রশাসন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম পেটেন্ট সিমলেস জুট ব্যাগস যেটা আমার টেকনোলজি। এক্ষেত্রে আমার সাথে আবদুল্লাহ আল মামুন আর ওরিন নামের দুইজন জুনিয়র টিচার ছিল, ওরা আমার সাথে কাজ করেছে। এটার জন্য আমরা টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম পেটেন্ট অর্জন করেছি। সর্বোচ্চ পেশাদারী সম্মান সূচক ডিগ্রী পেয়েছি CText.FTI (Chartered Fellowship), দ্যা টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য, (টেক্সটাইল জগতের সর্বোচ্চ পেশাদারী সংগঠন)। দ্যা ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ারস, বাংলাদেশ (আই ই বি) এর লইফ ফেলো হয়েছি। এছাড়া দ্যা ইনস্টিটিউশন অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারস এন্ড টেকনোলোজিস্ট (আই টি ই টি), বাংলাদেশ এর লাইফ মেম্বারও হয়েছি।


বিবার্তা: কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন?


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: স্বপ্ন তো দেখে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উনি যে স্বপ্নগুলো দেখে গেছেন সেগুলোর বাস্তবায়ন করাই তো আমাদের দায়িত্ব। আর উনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলেই আসলেই এই বাংলা সোনার বাংলা হবে। কোন সন্দেহ নাই। সোনার মানুষ বাংলাদেশে আছে। এদিকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো লিডারও রয়েছেন। কাজেই উনার আশপাশের মানুষগুলো যদি সততা নিয়ে আগাতে থাকে তাহলে এই দেশ সোনার বাংলা হতে বেশিদিন লাগবে না। এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিশন ২০৪১ নিয়ে আগাচ্ছেন।


একটা বিষয় দেখেন- দেখেন-উনি কিন্তু জানেন না কতদিন দুনিয়াতে থাকবেন? কিন্তু উনার চোখ কোথায়? এটাই উনার দূরদর্শিতা। আর এটাই হওয়া দরকার। উনি যে ভিশনগুলো নিয়ে আগাচ্ছেন ঠিকই একটার পর একটা সফল হয়ে যাচ্ছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। কাজেই আমাাদের শুধু বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু বললে হবে না, উনার যে স্বপ্ন ছিল সেই স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে আমাদেরকে আগাতে হবে। তাহলে দেখবেন দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?


বিবার্তা: বিবার্তাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।


ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/ রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com