শিরোনাম
ডেন্টাল চিকিৎসার সম্ভাবনা ও করণীয় পর্ব-২
'ডেন্টাল চিকিৎসার আন্তর্জাতিক মান উন্নয়নে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি'
প্রকাশ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:২৫
'ডেন্টাল চিকিৎসার আন্তর্জাতিক মান উন্নয়নে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি'
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

সারাদেশে ৩৫টা ডেন্টাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১টা সরকারি ডেন্টাল কলেজ, ৮টা সরকারি মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট, ১৩ বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, ১৩টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট। আর দেশে সরকারি-বেসরকারি ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা সর্বমোট সাড়ে ১২ হাজার। এই পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে ডেন্টাল স্বাস্থ্যখাতে শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষার পরিধি বাড়ানো এবং সেটি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি গবেষণার মান উন্নয়নে বাংলাদেশে একটি স্বতন্ত্র ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা খুবই প্রয়োজন। ডেন্টাল প্রফেশনকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এখন সময়ের দাবি বলে মত দিয়েছেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল।


তিনি বলেন, মাত্র ৬জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল ঢাকা ডেন্টাল কলেজের। সময়ের পালাবদলে ডেন্টাল প্রফেশনের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। এখন এই প্রফেশনে প্রতি বছর ২ হাজার ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয় এবং প্রায় একই সংখ্যক ছাত্রছাত্রী চিকিৎসক হিসেবে বের হয়। এসব মেধাবি ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতের জন্য দেশে ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সদয়দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ঢাকা ডেন্টাল কলেজে নিজের অফিসে বিবার্তা২৪.নেটকে দেয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ঢাকা ডেন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল। দীর্ঘ আলাপে উঠে এসেছে বাংলাদেশে কতগুলো ডেন্টাল কলেজ আছে, কলেজগুলোর সার্বিক অবস্থা, কলেজ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা, ডেন্টাল শিক্ষার অতীত, বর্তমান হালচালসহ এই শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে করণীয় ইত্যাদি নানান বিষয়। দীর্ঘ আলাপের বিষয়গুলো নিয়ে আজ প্রকাশ হচ্ছে সাক্ষাতকারটির দ্বিতীয় পর্ব।



বিবার্তা : বর্তমানে দেশে কতগুলো ডেন্টাল কলেজ রয়েছে এবং কলেজগুলোর সার্বিক অবস্থা জানতে চাই।
ডা. হুমায়ুন কবির বুলবুল :
বর্তামানে দেশে ৩৫টি ডেন্টাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ছাড়াও ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস-এর পাশাপাশি ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি (বিডিএস) কোর্স চালু আছে। তার মানে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট নামে ৮টা ইউনিট আছে। আর এই ইউনিটগুলো চালু হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে। সরকারিভাবে ডেন্টাল শিক্ষা চিকিৎসা ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে এই উদ্যোগটা নেয়া হয়েছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট থেকে যাত্রা শুরু এবং ওই উদ্যোগের প্রস্তাবটা ছিল আমার।


১৯৯০ সালে দেশে দুটি সরকারি ডেন্টাল ইউনিট চালু হয়। একটা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট ও আরেকটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট। আর বাকি যে ৬টি ডেন্টাল ইউনিট চালু হয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আর ২টি সরকারি ডেন্টাল ইউনিট আগেই ছিলো। দেশে ১৩টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ এবং ১৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট আছে। ঢাকা ডেন্টাল কলেজসহ মোট ২৭টি। আর ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট নিয়ে এখন আমাদের দেশে মোট ৩৫টি ডেন্টাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশে ডেন্টাল শিক্ষা ও চিকিৎসার চাহিদা বেড়েই চলেছে। দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে যে, আগামী দিনে এই চাহিদা আরো বাড়তেই থাকবে।


বিবার্তা : দেশে জনসংখ্যার তুলনায় ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা খুবই কম। এ বিষয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে কী?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
দেখুন, আমাদের সরকার স্বাস্থ্যবান্ধব সরকার। মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সব সময়ই সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিচ্ছে নিয়মিত। সেই হিসেবে ডেন্টাল স্বাস্থ্যখাতেও সরকারের ইতিবাচক নজর থাকার কথা। সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়নের আলোচ্যসূচি নিয়ে গত মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মাননীয় স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব মহোদয়ের সভাপতিত্বে একটা সভা হয়েছে। সে সভায় কয়েকটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।


মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে সারসংক্ষেপ পাঠানোর ওই সভার কয়েকটা ইতিবাচক দিক হচ্ছে, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিট দুটিকে পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজে পরিণত করা। সেইসাথে সিদ্ধান্ত হয়েছে রংপুর মেডিকেল কলেজে যে ডেন্টাল ইউনিটটি আছে, সেটাকে পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজ করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটা কমিটি করার। পাশাপাশি আরো দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে দুটি ডেন্টাল ইউনিট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আপনি জেনে থাকবেন যে, গোপালগঞ্জ লুৎফর রহমান ডেন্টাল কলেজের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। আশা করা যাচ্ছে পরিস্থিতি অনুযায়ী আগামী বছরে এই কলেজে ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হবে। সেইসাথে খুলনা ডেন্টাল কলেজের প্রিন্সিপাল ইতোমধ্যেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সেখানেও আগামী বছর থেকে পাঠ্য-কার্যক্রম শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এভাবে দেশে ডেন্টাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুস্ঠু বিকাশ ও বিন্যাসের মধ্য দিয়ে আমাদের ডেন্টাল শিক্ষার এবং উচ্চশিক্ষার অবারিত সুযোগ তৈরি হচ্ছে।



বিবার্তা : দেশে ডেন্টাল উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
ডেন্টাল উচ্চতর শিক্ষার বিষয়ে আমি মনে করি, আমরা অত্যন্ত একটা সীমিত পরিসরের মধ্যে আছি। প্রতি বছর দেশে ২ হাজার শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েট হয়ে কলেজ থেকে বের হচ্ছে। তাদের জন্য উচ্চতর শিক্ষার সুযোগটা খুবই সীমিত। একেবারে সুযোগ নেই বলা চলে। আমরা যখন দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ফ্যাকালটিতে যে কয়টি সাবজেক্টে পোস্ট গ্রাজুয়েশন রয়েছে এমএস ডিগ্রির ক্ষেত্রে সেটি ৪০টি বা ৫০টির সীমা অতিক্রম করে না। আমরা যদি আরো ব্যাপকভাবে চিন্তা করি, তাহলে আমাদের নিপসমে যে সুযোগটা আছে বা বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসে (বিসিপিএস) যেটুকু আছে, অথবা ঢাকা ডেন্টাল কলেজে যে ডিডিএস, অর্থোডন্টিক্সে ও ওরাল সার্জারিতে এমএস, চট্টগ্রাম ও সিলেটে ডিডিএস কোর্সের যে সুযোগ আছে, এতে সব মিলিয়েও ৬০-৭০ জন চিকিৎসকের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার সুযোগ রয়েছে মাত্র। এটা একটা খুবই দুঃখজনক, অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অবৈজ্ঞানিক অবস্থা।


বিবার্তা : কেনো এমনটা হচ্ছে, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
বিষয়গুলো নিয়ে আমি অনেক আগে থেকেই বিশ্লেষণ করে আসছি। আমার দৃষ্টিতে যেসব কারণ ধরা পড়েছে সেগুলো এখন বলছি। আপাতত দৃষ্টিতে বলতে গেলে অনেকগুলো কারণে কলেজগুলোতে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগের অভাবে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক তৈরির যে প্রক্রিয়া সেটি ব্যহত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের সরকারি ও বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত শিক্ষা দান, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের যোগান এগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের জনগনের ডিসিপ্লিনারি ও মাল্টি ডিসিপ্লিনারি বিশেষজ্ঞ সেবা পাওয়ার যে সুযোগ সেটিও অবারিত হচ্ছে না।


এসব নানা কারণে আমাদের উচ্চতর শিক্ষার সুযোগগুলো সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। অত্যন্ত কম সিটের বিপরীতে বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে লড়ছে। প্রত্যেকটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের মধ্যেই সরকারি এবং বেসরকারি কোটা রয়েছে। সরকারি সেক্টরে সদস্যসংখ্যা এবং বেসরকারি সেক্টরে যে সদস্যসংখ্যা সেই আনুপাতিক হারে কিন্তু আমাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্সগুলোকে বিন্যস্ত করা হয়নি। যেমন- আমরা যখন দেখি একটা কোর্সের মধ্যে ১০জন করে সুযোগ পায়, সেখানে সরকারি যে সংখ্যা তার তুলনায় বেসরকারি আসন সংখ্যা হওয়া উচিত অন্তত তিন থেকে চারগুন। সংশ্লিষ্টরা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি চিন্তা করেন না।


বিবার্তা : বাংলাদেশের ডেন্টাল উচ্চশিক্ষা কী বিশ্বমানের?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
দেখুন, গুনগতমান, মূল্য বা দক্ষতা মূল্যায়নের যে মানদণ্ড সেটি হলো, প্রফেশনাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। সে দিক থেকে আমাদের ডেন্টাল উচ্চশিক্ষাটাও এখন বিশ্বমানের করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অর্থাৎ বিশ্বমানের ডেন্টাল উচ্চশিক্ষা ও পেশার গুণগতমানের বিষয়ে যে কথাটা আমরা বোঝাতে চাই সেটি হলো, দেশে আজ থেকে ৪-৫ বছর আগ পর্যন্ত ওই জায়গাটি সংকুচিত ছিল। যখন আমাদের ৪ বছর মেয়াদী বিডিএস কোর্স ছিল, তখন এটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, এক্রিডেশান, ফেলোশিপ, স্কলারশিপ ও অ্যাপ্লয়মেন্ট সুযোগটা ছিল না। বর্তমানে আমাদের বিডিএস কোর্সটিকে ৫ বছর মেয়াদী করার মাধ্যমে এটিকে আন্তজার্তিকীকরণ ও বিশ্বমানের করেছি। এখন আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন কোর্সটি শেষ করে বের হবে, তখন আর শিক্ষার মান নিয়ে কোন অভিযোগ থাকবে না।


বিবার্তা : দেশে ১৯৬১ সালে ডেন্টাল কলেজের কার্যক্রম চালু হয়। এতো দিনেও কোনো কলেজে বেসিক সাবজেক্টে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স চালু হয়নি কেন?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
১৯৬১ সালে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৬১ সাল থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত ৬০ বছরের ডেন্টাল প্রফেশনের পদযাত্রা থাকলেও অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, এই প্রফেশনে এতো দিন বেসিক সাবজেক্টে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের কোন সুযোগ ছিল না বা তৈরি হয়নি। এটা বলা যায় আমাদের এই প্রফেশনের বিকলাঙ্গ হয়ে থাকার একটা বড় কারণ। বলা যায় অনেকটা অবহেলিত ছিল এই বিষয়টি। এই খাতে পেশাগত সাংগঠনিক নেতৃত্ব থাকলেও সেভাবে বিষয়গুলোকে তুলে ধরতে না পারাও অন্যতম কারণ। যখন বিষয়টা নিয়ে জোর দাবি জানানো শুরু হয় এরপরে সরকারিভাবে দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স চালু হয়ে উঠেনি। এ কারণে আমাদের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সে জায়গাটা আমাদের প্রফেশনালরা চিহিৃত করেছেন। বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সিনিয়র প্রফেসররা যুদ্ধও করেছেন। অনেক চেষ্টা করেছেন। সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে আশার কথা হলো, এখন সে চেষ্টার ফল আমাদের হাতে আসতে চলেছে।


বিবার্তা : জেনেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি বেসিক সাবজেক্টে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স খোলার নেপথ্যে আপনার ভূমিকাটা সবচেয়ে বেশি। ওই গল্পটা জানতে চাই।
ডা. হুমায়ুন কবির বুলবুল :
আপনারা জেনে থাকবেন যে, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ এখন পর্যন্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি ডেন্টাল কলেজ। এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এই কলেজের অবকাঠামো আছে, ঐতিহ্যও আছে। এই কলেজে রয়েছে মেধাবি ছাত্রছাত্রীরা। এই কলেজের শিক্ষার পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক মান অনেক উন্নত হয়েছে। এখানে যোগ্য শিক্ষকমণ্ডলী ও চিকিৎসকগণ আছেন। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় কলেজটি আধুনিকমানের। এই মুহূর্তে আমাদের কোনো অপূর্ণাঙ্গতা নেই। ক্লিনিক্যাল ও বেসিক সাবজেক্ট সব বিষয়ে আমাদের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন খোলার সক্ষমতা রয়েছে। সেই কারণে এখানে ওরাল সার্জারিতে এমএস ডিগ্রি চালু আছে। ডিডিএস ডিগ্রি আছে। অর্থোডনশিয়ায় আছে। এফসিপিএস-এর ট্রেইনিরা কাজ করছে। আমাদের সব ধরনের সক্ষমতা থাকার কারণে গত এপ্রিল মাসে ঢাকা ডেন্টাল কলেজের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেসিক ৪টি সাবজেক্টে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন খোলার জন্য একটা প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে, নিয়ম মাফিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসক্রাইভ ফরমে, প্রেসক্রাইভ স্ট্রাকচারে চাহিদামোতাবেক পূর্ণ করে এটা জমা দিয়েছি। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, খুব দ্রুত সেই প্রস্তাবটি শুধু একটা জটই খুলেনি, এটি এক্ষেত্রে বহুলাংশে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পেরেছে।


আপনারা জানেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে রদবদল হয়েছে, মাননীয় ভিসি প্রফেসর ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে অ্যাকাডেমিক জায়গাগুলোতে একটা ঢেউ তৈরি হয়েছে। যার ফলে আমাদের ‘বেসিক ডেন্টাল সায়েন্স এবং প্যারাক্লিনিকেল ডিভিশন’ তৈরি হয়েছে। সেই ডিভিশন হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভিসিসহ সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই। সেটির হাত ধরে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমাদের ডেন্টাল ফ্যাকাল্টিটা একটা যোগ্যতর ফ্যাকাল্টি। এখানে অভিজ্ঞ, যোগ্য কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকমণ্ডলী আছেন। বিশেষ করে ডিন মহোদয় যেভাবে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই ধারাটি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আমি আশা করতে পারি এ বছরেই আমাদের ডেন্টাল ফ্যাকাল্টিতে ও ঢাকা ডেন্টাল কলেজে বেসিক সাবজেক্টে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রাপ্তির একটা সুযোগ ঘটবে। এই গতিটা অব্যাহত থাকলে আমাদের দীর্ঘ দিনের যে একটা ডিপ্রাইভেশনের জায়গাটা ধরে অনেক প্রফেশনালরা কাজ করেছেন, ভূমিকা রেখেছেন, কথা বলেছেন, আশা করছি সে জটটা শিগগিরই খুলতে শুরু করবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা সোপানে পৌঁছাতে পারবো ইনশাল্লাহ।


বিবার্তা : ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় হলে কী ধরনের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন?
ডা. হুমায়ুন কবির বুলবুল :
ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। যেমন- দেশে যদি ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, তাহলে আজকে দেশে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের যে সংখ্যা তার দ্বিগুন বৃদ্ধি পাবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টিসহ অন্যান্য মেডিকেল মিলে বাংলাদেশে ডেন্টিস্টিতে বছরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে পারে মাত্র ৫০ জন। এটা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ একটা জায়গা। বলা যায় একেবারে চোরাগলি।


একজন শিক্ষার্থী পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে কী হয়? একেকজন একটা বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ হয়, বিশেষজ্ঞ হয়। একজন ডেন্টিস্টের মধ্যে বিশেষত্ব তৈরি হয়। এখন ডেন্টাল শিক্ষায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনই যদি না থাকে, তাহলে যে ৫০জন বিশেষজ্ঞ তৈরি হলো তারা ঢাকায় প্র্যাকটিস করছে। আর শহুরে মানুষগুলো এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সেবাগুলো নিতে পারছে। তাহলে সারাদেশের গ্রামের মানুষেরা এই সুযোগটা পাচ্ছে না। একটা ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন সেখানে অনেকগুলো ফ্যাকাল্টি থাকবে। সেই ফ্যাকাল্টি থেকে অনেকগুলো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বের হবে। আমাদের কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। কারণ হলো পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ না থাকলে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক বা চিকিৎসক হতে পারে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় হলে সরকারী-বেসরকারী সকল পর্যায়ে শিক্ষক সমস্যার সমাধান হবে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পরে একজন শিক্ষার্থী একটা বিষয়ে স্পেশালিস্ট হয়। তাহলে চিকিৎসাসেবারও মান বাড়বে। ডেন্টাল শিক্ষায় স্পেশালিটি ডেভেলপ করলে গবেষণার সুযোগও বাড়বে। এসব কারণে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনটা এখন সময়ের দাবি।


একটা ডেন্টাল বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে এই প্রফেশনের মানুষগুলোই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা সব কিছুতে দায়িত্ব পালন করবে। আমরা যখন দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যাল অথবা অন্যান্য মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাথে সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মেডিকেল সমস্যার সাধানের চেষ্টা করে, সে জায়গাটায় আমরা অনেক পেছনে পড়ে আছি। আমাদের পেশাজীবী সংগঠনের উপস্থিতি ছাড়া অ্যাকাডেমিক জায়গা থেকে উপস্থিতির সুযোগগুলো অনেক কম। সুতরাং আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজেদেরই নেতৃত্বের আসনে আসতে হবে।


বিবার্তা : রাজধানীবাসী খুব সহজে অত্যাধুনিক ডেন্টাল চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন। এই সুযোগটা উপজেলায় পর্যায়ে কী যথেষ্ট রয়েছে? আপনার কী মনে হয়?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
রাজধানীর মিরপুরে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ অবস্থিত। এই কলেজের সাথে একটি আধুনিক বিশেষায়িত হাসপাতালও আছে। এখানে আধুনিক, উন্নত এবং আন্তর্জাতিকমানসম্পন্ন সব ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। সেইসাথে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি মেডিকেলে ডেন্টাল ইউনিট আছে। সেগুলোতেও উন্নত চিকিৎসাসেবার সুযোগ রয়েছে। ফলে দেশবাসী খুব সহজে অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন। তবে এই চিকিৎসার সুযোগটা সারাদেশের উপজেলা পর্যায়ের মানুষের জন্য অবারিত না। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটা হলো, সারা উপজেলায় সরকারী ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা মাত্র ১টা। এখন ৪-৫ লাখ মানুষের বসবাসকারী একটা উপজেলায় ১জন ডেন্টাল সার্জন কোনভাবে চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন না। ওই ডাক্তারটা অসুস্থ হতে পারেন, করোনা আক্রান্ত হতে পারেন, আইসোলেশনে যেতে পারেন। এমন কী ছুটিতে যেতে পারেন। একজন ডাক্তার এসব কারণে হাসপাতালে অনুপস্থিত থাকলে ওই উপজেলার মানুষ কোনোভাবে চিকিৎসাসেবা পেতে পারেন না।


একসময় যখন উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হলো, তখন একজন মেডিকেল অফিসার এবং একজন ডেন্টাল সার্জন ছিলেন। সে জায়গায় কোনো কোনো উপজেলায় ৩০জন মেডিকেল অফিসারও এখন আছেন কিন্তু ডেন্টাল সার্জন সেই ১জনই। সুতরাং সারাদেশের জনগণের দোরগোড়ায় এই চিকিৎসাসেবা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ডেন্টাল সার্জনের সংখ্যা খুবই কম। পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গেলে যে পর্যাপ্ত পরিমাণে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির চাহিদা রয়েছে সে পরিমাণে যোগানও নেই।


সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, দেশ স্বাধীনের পরে এই সেক্টরে আমরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছি। তবে আমাদের প্রত্যাশার জায়গা আরো অনেক বড়। যেমন- সরকারি সেক্টরে যেসব মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট আছে সেগুলো পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজ হওয়া প্রয়োজন। তাহলে হবে কী সে জায়গায় ঢাকা ডেন্টাল কলেজের মতো পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড়াবে। সেখানে দেশের শিক্ষার্থীরা পেশাগত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।



বিবার্তা : বেসরকারি সেক্টরে ডেন্টিস্টদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে কিনা?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
বিষয়টা দুঃখজনক হলেও বলতে দ্বিধা নেই। আমাদের বেসরকারি সেক্টরে যে ২৬টি প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে শিক্ষকদের নিয়োগ, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, সম্মান, চাকরির স্থায়িত্ব এগুলো কোন কিছুই একটা স্ট্যান্ডার্ডে এসে পৌঁছায়নি। এই সেক্টরে ইচ্ছামতো নিয়োগ, নিয়োগ বাতিল, বেতন ঠিকমতো না দেয়া কিংবা একেবারেই না দেয়া, অথবা আরো ভিন্নভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এখানে শিক্ষার, চিকিৎসার, উপযুক্ত চিকিৎসক তৈরির সকল ইনস্ট্রুমেন্ট, লজিস্টিকস, ইকুইপমেন্টাল বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, সে জায়গাটাতে সরকারের নজর দেয়া জরুরি। কারণ একজন চিকিৎসক যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে বের হয়ে আসেন, তখন যেনো উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জনগণকে সঠিক চিকিৎসা দিতে পারেন, সে ক্ষেত্রটা তৈরি করার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা সঠিক ও উপযুক্ত চিকিৎসা পাওয়া সাধারণ জনগণের মৌলিক অধিকার।


বিবার্তা : এক্ষেত্রে করণীয় কী বলে মনে করেন?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
চিকিৎসা যাতে অপচিকিৎসা হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য আমাদের যে রেগুলেটরি বডি আছে তাদের ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মান উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক, যন্ত্রপাতি আছে কিনা, শিক্ষকদের সম্মান, মর্যাদা ও স্থায়িত্বের জায়গা ঠিক আছে কিনা, ঠিক মতো বেতন-ভাতা, বোনাস পাচ্ছেন কিনা এসব ইস্যুতে রেগুলেটরি বডির নজরদারি বাড়ানো জরুরি। কেননা এসব ইস্যুতে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে প্রায়শই আমরা নানান অভিযোগ শুনি। আমি যখন সংগঠনগতভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সাথে যোগাযোগ করি তখন অহরহ এ ধরনের অভাব, অভিযোগের কথা আসে এবং বহুলাংশে এসব অভিযোগ সত্যতা পাওয়া যায়। সে জায়গাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাহলেই আমাদের সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে শিক্ষার মান বাড়বে।


সরকারি সেক্টরে ডেন্টাল ইউনিটগুলোতে চিকিৎসকদের জন্য আমরা যে পদ তৈরি করেছি সেগুলো একটা লেভেল বা ধাপ পর্যন্ত। কথা ছিল ধাপে ধাপে এটাকে আরো পূর্ণাঙ্গ রুপ দেয়া হবে। সে জায়গাগুলোতে পদ তৈরির সুযোগ এখনো রয়ে গেছে। এটা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। একজন ভাল চিকিৎসক তৈরি করতে হলে এই যোগানও ঠিকমতো দিতে হবে।


বিবার্তা : এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি হলো দেশের ডেন্টিস্টদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন। সারাদেশে পেশাজীবীদের যেসব সংগঠন আছে সদস্য সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী এই সংগঠনটি। এই সংগঠনের সদস্যদের সংখ্যা এখন সাড়ে ১২ হাজার। বাংলাদেশের আর কোনো প্রফেশনাল স্পেশালিটির সংগঠনের সদস্যা সংখ্যা এর অর্ধেকও নাই। কোন কোনটায় সদস্য সংখ্যা ২শ’, ৪শ’, ৫শ’ জন। আবার কোন কোনটায় ২ হাজার, ৪ হাজার বা ৫ হাজার। বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটিই শুধু এমন শক্তিমত্তার অধিকারী সংগঠন। আর এ কারণেই সংগঠনটি ডেন্টাল চিকিৎসাসেবা সেক্টরে বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।


ডেন্টাল সোসাইটি কোন পুলিশী সংস্থা না। আমাদের কোন মেজিস্ট্রেসি বা জুডিশিয়াল বা অ্যাডমিনিস্ট্রিটিভ পাওয়ার নেই। আমরা যেটি করতে পারি সেটি হলো, পেশাজীবীর কল্যাণে কথা বলা, সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা, দাবি নিয়ে কথা বলা, তাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতির সাথে থাকা, সরকারি বিভিন্ন পলিসি মেকিংয়ে সহযোগিতা করা, আমাদের মতামত দেয়া, সরকারি মতামতের সাথে শেয়ার করা ইত্যাদি। আমাদের মূল কাজ হলো ডেন্টিস্টদের কল্যাণে ও ডেন্টাল সেক্টরের উন্নতির জন্য সব সময় কার্যক্রম পরিচালনা করা।


বিবার্তা : আপনি বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আপনার মেয়াদে এমন কী কোনো কাজ করেছেন যার জন্য মানুষ আজীবন আপনাকে স্মরণ করবে?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
আসলে পেশার জন্য সংগঠনের হয়ে অনেক কাজই তো করছি। সবই দেশের ডেন্টাল প্রফেশনালদের মঙ্গলের জন্য। যে কাজগুলো করলে ভবিষ্যতে এই সেক্টরের উন্নতি হবে, ভাল হবে, কী শিক্ষা, কী চিকিৎসায়, সব বিষয়ে কাজ করেছি। সেগুলোর ফলও পেয়েছি। এই সেক্টরের অসংখ্য কাজের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো কয়েকটি বিষয় হলো, আমাদের সংগঠনের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতে বিডিএস কোর্স ৪ বছরের স্থলে ৫ বছরে উন্নীত হয়। সারাদেশে ৬টি মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। সেগুলোতে এখন শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে।


সরকারি সেক্টরে ডেন্টিস্টদের পোস্টিংয়ের (পদ) জন্য ঢাকা ডেন্টাল কলেজে একটা অর্গানোগ্রাম আছে। আর দেশের প্রত্যেকটা উপজেলা হাসপাতালে একটি করে পদ আছে। সে হিসেবে ৪৯০-৯৫টা বা দেশে যে কয়টা উপজেলা আছে সে কয়টা উপজেলায় একজন করে ডেন্টাল সার্জন আছে। ১৯৬১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত গত ৫৫ বছরে দেশের সরকারি সেক্টরে ডেন্টাল সার্জনদের জন্য পদ ছিল মাত্র ৬শ’র মতো। আমরা গত ৫ বছরে ওই সরকারি মেডিকেল কলেজ ডেন্টাল ইউনিটগুলোর জন্য এবং সরকারি ডেন্টাল কলেজে কিছু পদ তৈরি করেছি। এখন সব মিলিয়ে সরকারি পদের সংখ্যা ১ হাজার ২৯৬টি। ৫৫ বছরে যা হয়েছে, গত ৫ বছরে সেই পরিমাণ পদ আমরা তৈরি করতে পেরেছি।


আর একটা বিষয় উল্লেখ করার মতো সেটি হলো, আমাদের দেশে লক্ষাধিক ‘কোয়াক’ আছেন। যারা নিজেদের ডাক্তার বলে পরিচয় দেন। ২০১৫ সালে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে সোশ্যাল আন্দোলন শুরু করি। সেখানে প্রচারণা চালাই যে, ‘এমবিবিএস এবং বিডিএস ছাড়া কেউ ডাক্তার নয়’। বিষয়টা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা করি। আন্দোলনের ফলে ভাল একটা ফল পেয়েছি। সেটি হলো গত ২-৩ বছরের মধ্যে আর কোয়াকরা নিজেদের ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দেন না।


বিবার্তা : করোনা মহামারি যুদ্ধ মোকাবেলায় সারাদেশের ডেন্টিস্টদের ভূমিকা কেমন ছিল?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
২০২০ সালে সারাবিশ্বে মহামারি করোনা যখন আঘাত হানে, তখন বিশ্বের সব দেশই এর ঝুঁকি সামলাতে হিমশিম খেতে থাকে। আমাদের দেশেও একই অবস্থা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রফেশনালদের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সরকারি সেক্টরে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা থাকলেও দুঃখজনক বিষয় হলো, আমাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। টানা ৫-৬ মাস আমাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসটা বন্ধ ছিল। এর ফলে সাধারণ জনগণও ডেন্টাল স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সেইসাথে নানান সমস্যায় পড়েছিল। ওই সমস্যার সমাধানে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যায়ে সারাদেশে টেলিমেডিসিন টিম গঠন করি। এভাবে টেলিমেডিসিন সেবা চালিয়ে যাই। পাশাপাশি সারাদেশে আমাদের যারা ডেন্টাল সার্জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তারাও তাদের সক্ষমতার মধ্য দিয়ে নিজেদের রোগীদের টেলিমেডিসিন সেবা দিয়েছেন।


এছাড়াও করোনাকালে দেশের সবাইকে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা ও সচেতন করতে বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির পক্ষ থেকে একটা প্রমো তৈরি করেছি। সেটি হলো, ‘দুই মিনিট ব্রাশ, ৩০ সেকেন্ড মাউথ ওয়াশ, করোনা সংক্রমণ করবে হ্রাস’। প্রমোটি আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করি। সেইসাথে সারাদেশে আমাদের ডেন্টাল সার্জনদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের করোনা সংক্রমণ ও যেকোন অসুবিধায় সাহায্যের জন্য ৪৫০ সদস্যের একটা ভলেন্টিয়ার টিম রয়েছে। তারা এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।


বিবার্তা : উন্নত দেশগুলোতে এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোর গাইডলাইন রয়েছে। এক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কেমন?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
আসলেই উন্নত দেশগুলোতে এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনগুলোর গাইডলাইন রয়েছে। আর সেগুলো অনুসরণ করে তারা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। তাই তারা ঝুঁকিমুক্তভাবে কাজ করতে পারে। আমরাও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে যখন দেখি আমাদের কোনো প্রপার গাইডলাইন নেই, তখন একজন ডেন্টাল সার্জন ন্যূনতম কী ধরনের পরিবেশে কাজ করতে পারেন সে বিষয়ে একটা গাইডলাইনের খুব প্রয়োজন অনুভব করি। সে কারণে আমরা তখন ডব্লিউএইচও গাইডলাইন, আমেরিকান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের গাইডলাইন, ব্রিটিশ ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের যে গাইডলাইন আছে সেগুলোকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একটা গাইডলাইন তৈরির কাজ শুরু করি।


কঠিন বিষয় হলো আমরা ইচ্ছা করলেই কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা অমেরিকার মতো গাইডলাইন অনুসরণ করতে পারি না। কেননা আমাদের দেশের চেম্বারগুলো গড়ে উঠার কাঠামো, আদল, আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি কোনটাই উন্নত দেশের মতো না। আমাদের দেশে কোনটা ছোট, কোনটা মাঝারি, কোনটা আবার বড়। কোনটা করপোরেট কালচারে গড়ে উঠা, আবার কোনটা মাছ বাজারে গড়ে উঠা। চেম্বারগুলো কোথায় গড়ে উঠবে, কেমন করে গড়ে উঠবে, অবকাঠামো কেমন হবে, এদেশে এগুলো গড়ে তোলার সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন না থাকায় আর নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা থাকায় এলোমেলোভাবে সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়ে থাকে। আমরা রিসোর্সদের অনলাইনে এনে ১৪টা এপিসোডে ৭৬ জন স্পেশালিস্টের মতামত নিয়ে করোনা পরিস্থিতিতে ডেন্টাল সার্জনের গাইডলাইনটা বাংলা ও ইংরেজিতে তৈরি করি। পরে সেটি সারাদেশের ডেন্টাল সার্জনদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এই গাইডলাইন অনুসারে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় থেকে সবাই চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছেন।


বিবার্তা : করোনার সময় স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ থাকায় নিশ্চয় তরুণ ডেন্টাল সার্জনরা বিভিন্ন সমস্যায় পড়েছেন। তখন সংগঠনের ভূমিকা কেমন ছিল?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
আমাদের তরুণ ডেন্টাল সার্জনরা করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে অনেক অসুবিধায় ছিলেন। আমাদের মধ্যে যেসব ডেন্টিস্টরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, প্রতিষ্ঠিত ও সুসংগঠিত তাদের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে একটা ফান্ড গঠন করেছিলাম। যাতে অস্বচ্ছল ডেন্টিস্টদের প্রয়োজনে সাহায্য করা যায়। আর ওই সময় তরুণ ডেন্টাল সার্জনদের মধ্যে যারা আর্থিকভাবে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলেন এমন ২৭২ জন সদস্যকে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিনা শর্তে এককালীন, অফেরতযোগ্য এবং একই পরিমানে আর্থিক সাহায্য করেছি। সেইসাথে আরেকটি মেডিকেল এইড ফান্ড করেছি। যারা বিভিন্ন অসুবিধায় পড়েছেন, অস্বচ্ছল অথবা স্বচ্ছল কিন্তু চিকিৎসার টার্গেটেড টাকা তার কাছে নাই। তাকে সাহায্য করলে চিকিৎসাটা সুন্দরভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন। এমন ডেন্টিস্টদের আমরা ওই ফান্ড থেকে আর্থিক সাহায্য করেছি। এমন কি এখনও করে যাচ্ছি। এটা প্রফেশনাল সংগঠনগুলোর কাছে একটা বিশেষ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।



বিবার্তা : ভবিষ্যতে ডেন্টাল চিকিৎসা পেশাকে কোন জায়গায় দেখতে চান?
ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুল :
আমাদের সরকার প্রযুক্তিবান্ধব ও স্বাস্থ্যবান্ধব। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেসব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করছে। আরো কিছু বাকি আছে। স্বাস্থ্যখাতকেও ডিজিটালাইজড করার সব ধরণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেসব উদ্যোগ বাস্তবায়নও করে যাচ্ছে। আমাদের হাসপাতালগুলোতে এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ চিকিৎসা পদ্ধতি হয়ে গেছে প্রযুক্তিনির্ভর। সে জায়গা থেকে আমাদের ডেন্টাল স্বাস্থ্যখাতও এগিয়েছে। পেশাটাকে আগের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ এই পেশা হোক পৃথিবীর ১ নম্বর পেশা। সেই সম্মানের জায়গায় ও উচ্চতায় পেশাটাকে দেখতে চাই। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আশা করছি সে জায়গায় পৌঁছাতে পারবো।


বিবার্তা/গমেজ/শাহিন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com