যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের ই-কমার্স সেক্টর। গত ৭ বছরে এই সেক্টরের বাজার বহু গুণ বেড়েছে। দেশের ই-কমার্স নিয়ে গবেষণা ও বৃহৎ পরিসরে পরিকল্পনার এখনই উপযুক্ত সময়। কারণ দেশে এখন ই-কমার্সের বাজার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। নতুন একটি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দেশে ই-কমার্সের বিভিন্ন দিক নিয়ে যত বেশি গবেষণা করা হবে সেটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য তত বেশি ভাল ও শুভ ফল বয়ে আনবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। ই-কমার্স সেক্টরে আগামী ১০ বছর কি হতে পারে, কি করা দরকার, এসব বিষয় নিয়ে একটা মাস্টারপ্ল্যানও করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদ।
দেশে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করার পেছনে যাদের বিশেষ অবদান রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম সম্মুখ সারির যোদ্ধা রাজিব আহমেদ। গত ৭ বছর আগে তিনি দেশের ই-কমার্সকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছেন দিন-রাত এক করে কঠোর পরিশ্রমের ফলে তার সে স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। ই-কমার্স সেক্টর আজ একটা ভাল অবস্থানে এসেছে। ই-কমার্সকে কেন্দ্র করে আজ দেশে তৈরি হয়েছে লাখ লাখ উদোক্তা। সব কিছুর নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তাঁর। বর্তমানে ই-কমার্স নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি।
সম্প্রতি বিবার্তার সাথে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। আলাপে উঠে আসে বর্তমান দেশের ই-কমার্স ও উদ্যোক্তা সেক্টরের হালচাল, দুটি সেক্টরকে আরো এগিয়ে নিতে করণীয় কী, এ বষিয়ে গঠনমূলক পরামর্শ ও দিকনির্দেশনাসহ ই-কমার্সে নারীদের অংশগ্রহণের চিত্র। দীর্ঘ আলাপের কিছু অংশ বিবার্তা২৪.নেটের পাঠাকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো।
বিবার্তা: দেশের ই-কমার্স সেক্টর অনেকটা এগিয়েছে। ই-কমার্স নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীতা কতটুকু রয়েছে বলে মনে করেন?
রাজিব আহমেদ: দেখুন, আমার বিশ্লেষণে ই-কমার্স নিয়ে গবেষণার দিকে মনোযোগ দেবার এটিই উপযুক্ত সময়। কারণ দেশে এখন ই-কমার্সের বাজার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তাই এ সেক্টর নিয়ে ভাল করে লেখাপড়া ও গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। এই ইন্ডাস্ট্রিতে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান বেশি দূরের বলে মনে হচ্ছে না। আগামী অন্তত ১০ বছর ধরে এই ইন্ডাস্ট্রি শুধু বড়ই হতে থাকবে। এ নিয়েও মনে হয় কারো মনেই কোনো সন্দেহ নেই। যেহেতু আমাদের দেশে ই-কমার্স একটি নতুন ইন্ডাস্ট্রি। তাই এর বিভিন্ন দিক নিয়ে যত বেশি গবেষণা করা হবে, তত বেশি ভাল। এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিবার্তা: ই-কমার্স সেক্টর উন্নয়নে কোন দিকে বেশি নজর দেয়া জরুরি বলে মনে করেন?
রাজিব আহমেদ: ই-কমার্স সেক্টর উন্নয়নে দরকার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অনেক বেশি ফিডব্যাক নেয়া। ই-কমার্স উদ্যোক্তারা এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। হয়তো আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামেই তাদের আমরা পাবো। ই-কমার্স সেক্টরে আগামী ১০ বছর কি হতে পারে, কি করা দরকার, এসব বিষয় নিয়ে একটা মাস্টারপ্ল্যান করতে পারলে খুব ভাল হতো। এখানো আমরা অনেকেই এই সেক্টরের বিপুল সম্ভাবনাকে তেমনভাবে উপলব্ধি করতে পারছি না। গত ৭ বছরে এই সেক্টরের বাজার বহু গুণ বেড়েছে।
বিবার্তা: ই-কমার্সে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ জানতে চাই?
রাজিব আহমেদ: দেখুন, অনেক আগে থেকেই আমি বলে এসেছি যে, ই-কমার্স এমন একটি সেক্টর যেখানে উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন নারী। তাদের জন্য কিছু সাপোর্ট দরকার। ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য পণ্য ডেলিভারি এখনো বড় সমস্যা। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে থাকা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য। গত দেড় বছরে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার নারী দেশি পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ইতোমধ্যেই দেশি পণ্য নিয়ে ফেসবুকে অনেক পেজ এবং কয়েকশত গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আশা করছি এ বছরের মধ্যে এমন গ্রুপের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। নারী ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দরকার। তাদের সামাজিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা গেলে আমাদের অর্থনীতিতে এর চিরস্থায়ী সুফল পাওয়া যাবে।
বিবার্তা: দেশে উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকে আরো ত্বরান্বিত করতে আমাদের করণীয় কী?
রাজিব আহমেদ: আমি মনে করি, এজন্য দরকার দেশি পণ্যের দিকে বেশি করে ফোকাস করা এবং ই-কমার্সের গুরুত্ব তুলে ধরা। এখনো অনেকের চিন্তা বিদেশি পণ্যকেন্দ্রিক। শিক্ষা ব্যবস্থায় এ নিয়ে কয়েকটা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলে ভাল হবে। আমরা প্রায় সবাই এখনো মনে করি লেখাপড়া শেষ করে সবাইকে চাকরি পেতে হবে। আবার অনেকের ধারণা হলো যে, ব্যবসা করা মানে কমার্সের শিক্ষার্থীদের কাজ। আমরা যদি জাতীয় অর্থনীতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো যে রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসছে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। এটি সম্ভব হয়েছে কয়েক হাজার উদ্যোক্তার চেষ্টায়। তাদের কারণে এখন দেশে ৪০-৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমার মনে হয় যে, সবার আগে শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্যোক্তার বিষয়টি যতটা সম্ভব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
বিবার্তা: এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। আপনি অনলাইনে ইংরেজি চার্চার জনপ্রিয় প্লাটফর্ম ‘সার্চ ইংলিশ’ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। দেশের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে গ্রুপটি কীভাবে ভূমিকা রাখছে?
রাজিব আহমেদ: ইতোমধ্যেই সার্চ ইংলিশ গ্রুপ আর এর ওয়েবসাইটের বয়স ৫ বছর হয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গ্রুপে এখন ৩০ লাখের বেশি মেম্বার রয়েছে। ভয় আর লজ্জা কাটিয়ে ইংরেজি প্র্যাকটিস করার জন্য ফেসবুকে এটি অন্যতম সেরা প্লাটফর্ম বলে সবাই মনে করেন। এখানে প্রতিদিন সময় দিলে কয়েক মাসের মধ্যে ইংরেজি পড়া আর লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে অনেক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সার্চ ইংলিশ গ্রুপ। এজন্যই গ্রুপটি এতো জনপ্রিয়। সার্চ ইংলিশের ওয়েবসাইটে যে রিডিং ম্যাটেরিয়াল আছে তা হাজার হাজার মানুষের কাজে লাগছে। এছাড়াও অনেকে ২-৩ মিনিটের কথা বলার ভিডিও গ্রুপে পোস্টে আপলোড করছেন। এই প্লাটফর্মটিতে যেকোনো বয়সের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি প্র্যাকটিস করে থাকেন।
বিবার্তা: অনলাইনে ইংরেজি শেখার অন্তরায়সমূহ কী কী?
রাজিব আহমেদ: অনলাইনে ইংরেজি শেখার অনেক কিছু আছে এবং এজন্য কোন টাকা লাগে না। আসল সমস্যা মানুষ নিয়মিত না। নিয়মিত সময় দিলে দক্ষতা না বাড়ার কোন কারণ নেই। ইংরেজি শেখা নিয়ে শুধু ইউটিউবেই এত ভিডিও আছে যে একজন মানুষ সারা জীবনেও তা দেখে শেষ করতে পারবে না। আর সার্চ ইংলিশ এটিও দেখাতে পেরেছে যে ফেসবুকের মাধ্যমেও ইংলিশ প্র্যাকটিস করা যায়। যারা ইংরেজি শিখতে চান তাদের অনেকের মধ্যে যা নেই, তাহল আগ্রহ।
বিবার্তা: অন্তরায়গুলো উত্তরণে করণীয় কী?
রাজিব আহমেদ: এর আগের প্রশ্নে যেটা বললাম যে শিক্ষার্থীদের সমস্যা একটাই। ফেসবুকে ইংরেজি শেখার জন্য দরকার আগ্রহ। এ জিনিসটা কারো মধ্যে থাকলে হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও তার পক্ষে সময় বের করা সম্ভব। আর নিয়মিত রুটিন করে সময় দিলে ইংরেজি শেখা কোন কঠিন বিষয় না। একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি শেখার বাধাগুলো নিজে নিজেই দূর করতে পারেন। এ সমস্যার সমাধান আমাদের নিজেদের হাতে। ইন্টারনেটকে আমাদের দেশে অনেকেই এখনো টাইম পাস বা সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছি। প্রতিদিন সময় দিলেই ১০০ দিনের মধ্যে নিজের উন্নতি ভাল করেই দেখা ও বোঝা সম্ভব। একটা বছর সময় দিলে যে কারো ইংরেজি নিয়ে দুর্বলতা ভয় থাকবে না। প্রমাণিত এমন হাজারো উদাহরণ আমাদের গ্রুপে দেখতে পাবেন।
বিবার্তা: অনলাইনে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়ালেখার প্লাটফর্ম ‘ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ (ডিএসবি) বিষয়ে সংক্ষেপে বলুন।
রাজিব আহমেদ: ডিজিটাল স্কিলস ফর বাংলাদেশ (ডিএসবি) গ্রুপকে আমি আমার জীবনের সেরা কাজ বলে মনে করি। এর বয়স সাড়ে ৩ বছর হয়ে গেছে। বিভিন্ন টপিকে ৫ লাখের বেশি পোস্ট আছে। গ্রুপটির ব্লগেও হাজারের বেশি পোস্ট আছে। ডিজিটাল স্কিলস নিয়ে বিভিন্ন টপিকে বাংলা ভাষায় অনেক কন্টেন্ট আছে এই গ্রুপে। গত কয়েক মাস ধরে ইংরেজি রিডিং স্কিলের দিকে নজর দিচ্ছি আমরা। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩ হাজার মানুষ এতে যোগ দিয়েছে।
সেই সাথে অনেকেই গ্রুপে ও নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে নিজ নিজ জেলার পণ্য নিয়ে লিখছেন। ময়মনসিংহ থেকে আরিফা খাতুন ২০২০ সালের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির দিকে নিজের জেলার উদ্যোক্তাদের তুলে ধরতে উদ্যোগী হন। সেই চেষ্টা এখন বিভিন্ন জেলার পণ্য, দর্শনীয় স্থান, খাবার, সংস্কৃতি ইত্যাদি তুলে ধরার দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে। জেলা ওয়েবসাইট নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে এই গ্রুপে আমরা কথা বলে আসছি। ২০২২ সাল নাগাদ আশা করছি বিপুল অগ্রগতি দেখতে পারবেন। ডিজিটাল স্কিলস গ্রুপে কাউকে আসলে পোস্ট, লাইক, কমেন্ট এসবের দিকে উৎসাহিত করা হয় না। সেখানে বলি প্রতিদিন কোন টপিকে সার্চ করে ১০০ পোস্ট পড়তে। এভাবে অনেক কিছু জানা যায়।
বিবার্তা: ই-কমার্স সেক্টরকে কেমনভাবে দেখতে চান?
রাজিব আহমেদ: ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে আমি সব সময় বলেতে চেষ্টা করেছি ই-কমার্স সেক্টর যেন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। ২০১৪ সালে আমরা কয়েকজন মিলে যখন ই-ক্যাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই তখন ই-কমার্স খুব ছোট একটি সেক্টর ছিল। ই-ক্যাবের কারণে তা দ্রুত অনেক বড় একটি ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। যে কেউ যেকোনো স্থান থেকে ই-কমার্সে উদ্যোগ নিয়ে যেনো প্রবেশ করতে পারে, সব সময় এমন একটা সেক্টর দেখতে চাই।
২০১৫-১৭ এই তিন বছরে ই-ক্যাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বারবার বলেছি যে, ই-কমার্স কোন শখের বিষয় নয় বরং এটি সবার জন্য দরকারি। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা করোনার সময়ে সেই বাস্তবতা বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছি। বর্তমান সরকার সেই ২০০৯ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে। বর্তমানে এর অগ্রগতি অভাবণীয়। এর সুফল ই-কমার্স সেক্টরেও পরেছে। ৫-৬ বছর আগে সারা দেশে এত স্মার্টফোন আর থ্রিজি, ফোরজি ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যেত না। মোবাইল ফিনান্সের মাধ্যমে লেনদেন এত জনপ্রিয় ছিল না। সরকারের নেয়া বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত ই-কমার্স সেক্টরকে অনেক দ্রুত অনেক বড় করে তুলতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
বিবার্তা: আপনাকে ধন্যবাদ।
রাজিব আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বিবার্তা/গমেজ/শাহিন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]