শিরোনাম
‘চরিত্রগত গুণ হারিয়েছে এখনকার ছাত্র রাজনীতি’(১ম পর্ব)
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২১, ১৭:১০
‘চরিত্রগত গুণ হারিয়েছে এখনকার ছাত্র রাজনীতি’(১ম পর্ব)
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি। ১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চলনবিলের বিলসা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. হায়েতুল্লাহ সরদার পেশায় ছিলেন কৃষক ও মাতা মোছা. গুলেনুর বেগম ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলায় পিতৃহারা আব্দুল কুদ্দুস গ্রাম থেকে উঠে এসে রাজশাহী কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ পাস করেছেন। ১৯৬৮-৭২ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভুত্থানের সময় ছিলেন বৃহত্তর রাজশাহী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি। তিনি বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি কমাণ্ডার হিসেবে জীবন বাজি রেখে পাক হায়েনার বিরুদ্ধে প্রাণপনে যুদ্ধ করেন।


দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি (১৯৭২-৭৪) রাজশাহী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী রাজশাহী জেলায় প্রথম গ্রেফতার করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসকে। দীর্ঘ ৫ বছর কারাভোগ করে মুক্তি পান তিনি। কারাগারে থাকা অবস্থায় রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস। ১৯৮২-৮৬ পর্যন্ত রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রাজশাহী মহানগর গঠিত হলে ১৯৮৬-১৯৯০ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।


১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি প্রথমবার সংসদ সদস্য হন।এর আগে ১৯৮৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করলেও স্বৈরাচারী শাসক জেনারেল এরশাদ নাটোর-৪ সংসদীয় আসনটি ক্যু করে নিজের দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। তার নির্বাচনী এলাকা ৬১, নাটোর-৪ (বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর)। সর্বমোট ৭ বার দলীয় মনোনয়ন পেলেও ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুস। বর্তমানে তিনি নাটোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন।


সম্প্রতি বিবার্তার কার্যালয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন নিয়ে কথা বলেছেন বরণ্যে এই রাজনীতিবিদ। তাঁর সেই বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ আলাপ বিবার্তায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। আজ বিবার্তা২৪ডটনেটের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো প্রথম পর্ব।


জাগরণ টিভির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের সাথে মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি।


বিবার্তা : ছাত্র রাজনীতিতে জড়ালেন কিভাবে? শুরু থেকে জানতে চাই. . .


মো. আব্দুল কুদ্দুস : ছাত্র রাজনীতিতে জড়ানোর গল্প শোনানোর আগে ১৯৬৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার আগের একটা ঘটনার কথা বলে নিতে চাই। আমি যে স্কুলে লেখাপড়া করতাম সেটি ছিলো তখনকার সময়ে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানার সবচেয়ে ভালো স্কুল ‘কাছিকাটা স্কুল’। ১৯৬২ সালে ৪টি মহকুমাকে নিয়ে ছিলো বৃহত্তর রাজশাহী জেলা। রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর এবং নবাবগঞ্জ (বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ)। মহকুমা প্রশাসক পিএ নাজির সাহেবের সাথে স্কুলের সভাপতির আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলো। নাজির সাহেবের ভাই ছিলেন দিদারুল আলম আজিজ। তিনিও দক্ষিণাঞ্চলের মহকুমার কর্মকর্তা ছিলেন। তো সভাপতি তাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছেন স্কুলের কিছু কাজ করানোর জন্য। তখন আমি নবম থেকে দশম শ্রেণীতে পড়ি। ওই সময়ে স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি। মিটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কিছু দাবি-দাওয়া ছিলো কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে তারা কোনো কমেন্ট করেননি। কমিশনার সাহেবও না, ডিসি সাহেবও না।


আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন আকবর হোসেন সাহেব, তিনি বিএসসির টিচার ছিলেন। উনি আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। হঠাৎ করে দেখি যখন লাঞ্চের সময় হয়েছে, নাটোর থেকে খাওয়ার নিয়ে আসা হয়েছে। মিষ্টি, কাঁচাগোল্লা ইত্যাদি আনা হয়েছে। এসব দেখে এমএসসি নিতাই স্যারকে বললাম, স্যার সংবর্ধনা দিলাম আমরা। কমিশনার সাহেব, ডিসি, তার ড্রাইভার, তার পিএসকে নাস্তা দিচ্ছেন। ছাত্রদের দিবেন না। তিনি প্রতি উত্তরে বলেন, তোমাদের কেন দিতে হবে? সব কষ্ট করলো ছাত্ররা আর এখন ছাত্ররাই বঞ্চিত। তখন বিষয়টা আমাদের মাথায় লেগেছে।


আমরা কয়েকজন মিলে যেখানে খাবার রাখাছিলো সেখান থেকে সরিয়ে আমরাও সরে পড়েছি। খাওয়ার সময় দেখে যে খাওয়ার কিছু নাই তখন তো সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। সবাই খুঁজতেছে। কে করলো, কে করলো? হেডমাস্টার সাহেব, এমএসসি স্যার বললো যে, কুদ্দুস ছাড়া কেউ এ কাজ করেনি। তখন আমাকে খোঁজে বের করে নিয়ে আসা হলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি এই কাজ করেছো? উত্তর দিলাম- না, আমি এই কাজ করিনি। স্যার বললেন, তাহলে কার সাহস আছে এ কাজ করে?


আমি বলি, সাহসের তো বিষয় না। আপনারাই বলতেন আইয়ুব খান মার্শাল ল' জারি করে ক্ষমতা দখল করে রাখছে। আজকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের বন্দি করে রাখছে। আপনারাই তো তার কমিশনার, ডিসিকে ডেকে নিয়ে আসছেন। তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, ছাত্রদের জন্য কিছুই রাখেন নাই। খাওয়ার আয়োজন যখন করছেন সবার জন্যই করতেন। এখন কে করেছে না করেছে আমার ওপর দায় দিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে অনেক ভয়ভীতি দেখানো হলো। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম প্রতিবাদ করতে হবে। আমি আসলে ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিবাদী। আমি কৃষকের সন্তান, গ্রামে থাকি। ১১ বছর বয়সে যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন আমার বাবা মারা যান। তখন থেকেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান।


এরপর ১৯৬৩ সালে রাজশাহী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে আর্টসে ভর্তি হলাম। আইয়ুব খানের একটি সংগঠন ছিলো এনএসএফ (জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন)। তারাই রাজনীতিতে গুণ্ডামী নিয়ে আসছে। কলেজে ভর্তি হয়ে আমরা ১১-১২ জন ছাত্রলীগে নাম লেখাই। ৯-১০ জন ছাত্র ইউনিয়নের ছিলো। তখনকার সময়ে রাজশাহী কলেজের এ ও সি ব্লকে যারা থাকতো তারাই ছাত্রলীগের কথা বলতো।


তখনই আমরা জানি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন নেতা আছে। যে নেতা এই ছাত্র সংগঠনটা তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের নেতা। ১৯৬৪ সালের মে মাসে কামারুজ্জান সাহেব উনাকে রাজশাহীর মাদরাসা মাঠে জনসভা করতে নিয়ে আসছেন। আমরা চিন্তা করলাম বঙ্গবন্ধুকে রাজশাহী কলেজের গেটে সংবর্ধনা দিবো। আমরা ১০-২০ জন্য গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমরা স্লোগান দিচ্ছি- ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব লও সালাম’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি। এসময়ে এনএসফের জাফর, সেন্টোর নেতৃত্বে হকিস্টিক, চেইন, ড্যাগার ইট নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে ওরা স্লোগান দিচ্ছিলো- ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আইয়ুব খান জিন্দাবাদ, মোনায়েম খান জিন্দাবাদ’। এরকম করে তাদের সাথে আমাদের সাংঘর্ষিক একটা অবস্থার তৈরি হয়।


রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবনের পাশে টেনিস কোর্ট আছে। টেনিস কোর্টের নিচ তো পাকাই থাকে। ওখানে আমাকে নিয়ে গিয়ে সেই পাকার ওপর ইট বসালো। এরপর সেই ইটের ওপর আমার মাথা রেখে আরেকটা ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করতে লাগলো। পুরো মাথা থেতলে দিয়েছে, সেই সময়ে আমার মাথা ২৯ টা সেলাই দিতে হয়েছে। মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সেই থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হই।


অধ্যাপক মো.আবদুল কুদ্দুস এমপি।


বিবার্তা : আপনি রাজশাহী কলেজের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। সেসময়ের সামগ্রিক ছাত্ররাজনীতির চরিত্রটি কেমন ছিলো?


মো. আব্দুল কুদ্দুস : আমার প্রাকটিক্যাল মাস্টার্স শেষ হয়েছে ১৯৬৮ সালে। এরপর আমি ল' কলেজের ছাত্র হয়ে গেলাম। সেই ছাত্রত্ব থাকাকালীন দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়। এরপর দেশ স্বাধীন হয়ে গেলো। রাজশাহী কলেজের প্রিন্সিপাল নুরুল সাহেব। তখন রাজশাহী কলেজ উপমহাদেশের ২ নম্বর কলেজ ছিলো। উনি, শিক্ষকরা এবং ছাত্ররা আমাকে বললো যে, আপনার তো বঙ্গবন্ধুর সাথে খুব ভালো সম্পর্ক। এই কলেজে অনার্স আছে কিন্তু মাস্টার্স নাই। স্যার বললেন, তোমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভালো খাতির, তুমি একটু চেষ্টা করতে পারো। এটা আমার মাথায় ক্যাচ করলো। আমি সরাসরি বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি তোফায়েল ভাইয়ের কাছে টেলিফোন করলাম। আমি বললাম নেতা, আমি একটু রাজশাহী থেকে আসবো, বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করবো। তিনি বললেন, চলে আসো। তারপর ইশ্বরদী থেকে রাজশাহী রিকশায় তারপর প্লেনে করে চলে গেলাম ঢাকায়।


আসার আগে শেখ কামালকে টেলিফোন করলাম। শেখ কামালের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো। বঙ্গবন্ধুর টয়োটো একটা সাদা কার ছিলো। সেই কারে করে আমাকে বাসায় নিয়ে আসলো। বঙ্গবন্ধুর বাসার সিঁড়ির উত্তর পাশে একটা রুম ছিলো। সেই রুমে শেখ শহিদুল ইসলাম থাকতেন। তিনি শেখ কামালের ফুফাতো ভাই। একসময় তিনি দিলু রোডে চলে গেলেন। দুই একদিন আমি এখানেই থাকতাম। শেখ কামাল আমাকে খুব ভালোবাসতো।


তখন ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস। বঙ্গবন্ধুর সাথে সকালবেলা নাস্তা করছি। নেতাকে বললাম, নেতা আমি তো আসছিলাম একটা কথা বলতে অফিসে গিয়ে বলবো। বেইলি রোডে টং ওয়ালা ঘর ছিলো। পুরনো গণভবন। এখন যেটা গেস্ট হাউস। ওখানে হানিফ ভাই ছিলেন, এপিএস, নরসিংদীর মহিউদ্দিন ভাই ছিলেন চিফ সিকিউরিটি অফিসার। তিনি এখন মুন্সীগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। কামারুজ্জামান (এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনা) সাহেব সামনেই এক বাড়িতে থাকতেন। তিনি টেলিফোনে ডাকলেন। তো আমি ঘটনা খুলে বলে রাজশাহী কলেজে মাস্টার্স চালু করার জন্য বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপ চাইলাম। তিনি বললেন যে, রাজশাহী কলেজের এই অবস্থা। তুই এক কাজ কর আন্দোলন শুরু করে দে। বঙ্গবন্ধু এতো সহজ সরল মানুষ ছিলেন যে, তিনি আমার মতো ক্ষুদ্র একটা মানুষকে বললেন, ‘তুই আন্দোলন ডাক’।


তোফায়েল ভাই বলতেছেন কি আন্দোলন করবে? বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তুই অনশন কর’। ইউসুফকে (শিক্ষামন্ত্রী প্রফেসর ইউসুফ আলী) পাঠায়ে দিবো নে, অনশন ভাঙায়ে দিয়ে ঘোষণা দিয়ে আসবে। আমি উনার সাথে কথা বলে পরের দিন চলে গেলাম।


রাজশাহী কলেজের টেনিস কোর্টে রেডক্রসের ২০টা টেন্ট ছিলো। আমার সব নিয়ে অনশনে বসে গেলোম। বক্তৃতা হচ্ছে, উপমহাদেশের ২ নম্বর কলেজ অনার্স আছে, মাস্টার্স নাই। অনার্স পড়ে আমরা কি মতিহারে, ঢাকাতে গিয়ে মাস্টার্স করবো। আন্দোলন শুনে ডিসি সাহেব আসলেন, কমিশনার আসলেন। আমরা তো জানি হেডকোয়ার্টার আমাদের চাবি দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীকে সামনে পেয়ে বক্তৃতা দেয়া শুরু করলাম, নেতা, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সাহেব, এই দেশ স্বাধীন করেছি আমরা ছাত্ররা। রক্ত দিয়েছি। প্রেসিডেন্সি কলেজের পর এই কলেজের অবস্থান। সেই কলেজকে কেন মাস্টার্স দেয়া হবে না। আপনি আজকে এই ঘোষণা দিবেন না হলে আজকে যাইতে দিবো না।


এদিকে বঙ্গবন্ধু সার্কিট হাউসে টেলিফোন করে বলছে, ‘ইউসুফ, ছেলেরা যা বলে শোন, ঘোষণা দিয়া আসো।’ পরে উনি ঘোষণা দিলেন। এর ১৫ দিনের মধ্যে গর্ভমেন্ট অর্ডার পেয়ে গেলাম। এখন তো মাস্টার্স হয়ে গেছে। ভর্তি শুরু হয়ে যাবে। আমার তো ১৯৬৮ মাস্টার্স শেষ। সবাই চাইলো যে তোমার ছাত্র হইতে হবে। কিসে, পলিটিক্যাল সায়েন্সে। রাজনীতি করো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ১ নাম্বার রোলে ভর্তি হতে হলো। এর ২ মাস পর সিদ্ধান্ত হলো এখানে একটা ছাত্রসংগঠন হবে। সাধারণ শিক্ষার্থী, সব দল সবাই চাইলো তুমি এতো কাজ করছো তুমি নেতৃত্ব দাও। এসময়ে আমি আবার পার্শ্ববর্তী সিটি কলেজের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলাম। এখন রাজশাহী কলেজ তো শুধু বিশাল কলেজ না বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান কলেজ। সেই কলেজের আমি প্রথম ভিপি ছিলাম।


জাগরণ টিভির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথিদের সাথে মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপি।


বিবার্তা : তখন কী ধরনের ইস্যুতে ছাত্র সংগঠনগুলি আন্দোলন করতো?


মো. আব্দুল কুদ্দুস : তখনকার সময়ে ছাত্ররাজনীতির মূল ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো ছাত্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সেসময়ে আমরা শিক্ষা সিলেবাস নিয়ে কাজ করি। রবীন্দ্রনাথের গান বাজনা নিষিদ্ধ করছিলো সেসবের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ ছিলো। শরীফ খান কমিশন যা করেছিলেন তার বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করেছি। যেহেতু বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ, সেহেতু স্বাভাবিকভাবে আমরা সরাসরি বাংলাদেশের স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে জাতীয়তা বোধ, বাঙালি সাহিত্য্, সংস্কৃতিক জাগরণ তৈরি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কাজ করতাম। এছাড়াও আমরা স্বাধিকার এর লক্ষ্য নিয়ে ধীরে ধীরে স্টেপ বাই স্টেপ কাজ করতাম।


বিবার্তা : বৃহত্তর রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা প্রসঙ্গে বলুন।


মো. আব্দুল কুদ্দুস : সেসময়ে রাজশাহী শহরের লোকজন বাইরের লোকদের পাত্তা দিতে চাইতো না। তো আমরা তিনটা মহকুমা নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলে বললাম, এই তিন মহকুমা থেকে একজন সভাপতি দিতে হবে। আর তোমরা সেক্রেটারি নাও। সেই লক্ষ্যে ভোটাভোটি হলো। তখন ১৯৬৭ সাল। রাজশাহী শহরে গ্রুপিংয়ের ব্যাপার-স্যাপার ছিলো। এ অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফটেরিয়াতে কনফারেন্স ডাকা হলো। সেসময়ে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি। সেখানে ভোটাভোটি হলো। শহরের আব্দুল খালেক নামে একজন দাঁড়ালো। সে পেলো ১১ ভোট। আর আমি পেলাম ৩৫৬ টা। ‘৭২ পর্যন্ত গেলো। ১৯৭০-৭১ এ সম্মেলন হয়নি। ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থানের সময় রাজশাহীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ছিলাম।


গোটা দেশে আমার নেতা ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। ৬ দফা আন্দোলনে আমি যুগ্ম আহবায়ক ছিলাম। আহ্বায়ক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানিন্তন ভিপি। বঙ্গবন্ধু জেলে যায়, আমরা তখন আন্দোলন করি। আবার জেলে নেয় আমরা আবার আন্দোলন করি। এটা করতে করতে আমরা দেশের মানুষের কাছে গিয়া পৌঁছাইলাম। এক্ষেত্রে ইত্তেফাক সম্পাদকের যথেষ্ট ভূমিকা ছিলো। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন আমাদের গ্রহণ করতো না। তারা বলতো, আমরা সিআইয়ের দালাল। ছয় দফা সিআইয়ের এজেন্ডা। তারা এসব বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতো। ছাত্রশিবির তখনকার ছাত্র সংঘ, তারাও তখন ছিলো। তবে তারা আমাদের সাথে পারতো না।


বিবার্তা : এই সময়ের ছাত্ররাজনীতির সাথে আপনাদের সময়ের চরিত্রগত ও গুণগতপার্থক্যগুলি কেমন?


মো. আব্দুল কুদ্দুস : এখনকার যেসব ছাত্র রাজনৈতিক দল আছে আপনি দেখবেন সেসব দল রাজনৈতিক দলগুলোর পেছনে চলে। ৬০-৭০ এর দশকে কি ছিলো, ছাত্র সংগঠনগুলি আগে যেতো গণসংগঠনগুলো পেছনে যেতো। এখন তো লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি হয়, আগে তো লেজুড়বৃত্তি ছিলো না। বাংলাদেশে কিন্তু ছাত্র সংগঠনই মূল। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলনগুলো ছাত্ররাই করেছে। পেছন থেকে গণ সংগঠন সমর্থন দিয়েছে। তারাও আন্দোলন করেছে তবে ছাত্রদের মতো ওতো আন্দোলন করেনি।


ছাত্ররা কখনো বিলাসী জীবনযাপন করতো না। নেতা ছিলো, কর্মী ছিলো বিলাসিতা করতো না। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, ছাত্র সংসদের সহসভাপতি হিসেবে আমাদেরকে প্রায়ই ঢাকায় আসতে হতো। আমাদের অফিস ছিলো বলাকা ভবনের দুই তলায়। তখনকার ছাত্র রাজনীতির সব দলেরই কেন্দ্রবিন্দু ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহরুল হক হল)। এখানে ২১৩ নম্বর হলে থাকতেন তেফায়েল আহমেদ। তো বাইরে থেকে আসলে আমরা তোফায়েল ভাইয়ের রুমে থাকতাম।


অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস এমপির সাক্ষাতকার নিচ্ছেন বিবার্তার প্রতিবেদক সোহেল আহমেদ।


অন্য দল করলেও রাশেদ খান মেনন, আসম আব্দুর রব, সিরাজুল খান, শাহজাহান সিরাজ, শেখ ফজলুল হক মণি, নজরুল হক বাকী, আব্দুর রউফ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের সবার মধ্যে একটা আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো। আমি কিন্তু ভাবতে অবাক হই তারা বিভিন্ন অমুক জায়গায়, তমুক জায়গায় সারাদিন বিভিন্ন হলে, জেলা শহরে প্রোগ্রাম করে সন্ধ্যার সময় ঢাকা শহরে চলে এসে ইকবাল হলের ডাইনিং টেবিলে বসতেন। কেউ খাইল কি না খাইল সবাই ডাইনিং টেবিলে বসতেন। ফ্লোরে শুতেন, বালিশ নাই, মাথায় একটা ইট দিয়া শুতেন। এরকম দেখেছি আমরা।


তোফায়েল আহমেদরা এমন ছাত্র নেতা ছিলেন গভর্নর পযন্ত তার কাছে গেছেন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান, আইজিরা যেতেন। আব্দুর রাজ্জাক সাহেব একটা রুম ভাড়া করে থাকতেন। তখন রাজ্জাক ভাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন। দৈনিক বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতেন। আর এখনকার ছাত্রনেতারা কি করছে? ছাত্রনেতা হলে তাদের গাড়ি-বাড়ি দরকার, ব্যবসা দরকার। এটা কেমন কথা। আমরা তো এসব দেখে বেকুব হয়ে গেছি। এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি চরিত্রগত গুণ হারিয়েছে। (চলবে)


বিবার্তা/সোহেল/গমেজ/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com