শিরোনাম
কেমন আছে থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়া সেই কিশোররা?
প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:৫১
কেমন আছে থাইল্যান্ডের গুহায় আটকে পড়া সেই কিশোররা?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

চলতি বছরের জুন ও জুলাই মাসের তিন সপ্তাহ জুড়ে থাইল্যান্ডের একটি গুহায় ১২ কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচের আটকে পড়া, রোমাঞ্চকর উদ্ধার অভিযানের খবর সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল।


থাইল্যান্ডের মায়ে সাই এলাকায় সেই উদ্ধার অভিযানের পরে কী ঘটেছে? সেটাই জানতে গিয়েছিলেন বিবিসির সংবাদদাতা।


উদ্ধার হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো ওই স্থানে এসেছিলেন কিশোর এবং তাদের কোচ একাপল চান্থাওং, যিনি ১৭ দিন ধরে মেডিটেশন এবং নানাভাবে কিশোরদের চাঙা করে রেখেছিলেন। সে সময় তাদের উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া কয়েকজন উদ্ধারকারীও এসেছিলেন স্থানটি আবার দেখতে। তাদের মধ্যে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের জোশ মরিস, ফিনিশ ডুবুরি মিকো পাসি, ব্রিটিশ গুহা বিশেষজ্ঞ ভের্ন আন্সওয়ার্থ।


থাইল্যান্ডের সরকার এই কিশোরদের ব্যাপারে বেশ রক্ষণশীল। এই কিশোরদের যে কোনো জনসংযোগের ক্ষেত্রে সবসময় সাথে শিশু কল্যাণ কর্মকর্তা থাকেন। কেউ যদি এই কিশোরদের সাক্ষাৎকার নিতে চায়, তাহলে অন্তত কয়েক সপ্তাহ ধরে দুইটি কমিটির পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়া কারো সঙ্গে কথা না বলার জন্য তাদের পরিবারকেও নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।



ব্রিটিশ গুহা বিশেষজ্ঞ ভের্ন আন্সওয়ার্থ বলছেন, আমার জন্য এখনো এই জায়গাটি বেশ আবেগের জায়গা। অনেকেই মনে করেন, ১৩ জনের মধ্যে ১৩ জনকেই জীবিত উদ্ধার করে আনতে পারাটা অলৌকিক একটা ব্যাপার।


তিনি বলেন, আমার ধারণা, সারা পৃথিবীর মানুষ একটি খারাপ ফলাফলের ধারণা করছিল। কিন্তু আমরা কখনো হাল ছাড়িনি। ডুবুরিরা যা করেছেন, তা হচ্ছে অসাধারণ ধৈর্য আর অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব। আর পুরো ঘটনার জন্য ওই কিশোর বা তাদের কোচকে কেউ দোষ দেয়নি, আসলে তাদের ভাগ্যটাই খারাপ ছিল।


সেদিন অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে গুহার ভেতরে পানির মাত্রা হঠাৎ করেই বেড়ে যায় এবং কিশোর ও তাদের কোচ গুহার ভেতর আটকে পরে।


ভের্ন বলছেন, তারা সবাই ভালো নির্দেশনা পেয়েছে, তাদের ভালোভাবে দেখভাল করা হচ্ছে। আমি এটাকে ঠিক স্বাভাবিক জীবন বলবো না, কারণ তাদের সারা পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। তবে তারা সবাই আবার স্কুলেও যেতে শুরু করেছে।



তাদের প্রধান কোচ নোপ্পারাট কান্তাওয়াঙ বলছেন, গুহার ওই ঘটনার আগে তারা যেমন ফুটবলের কঠোর প্রশিক্ষণ করতো, এখনো সেরকম প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছে। হারানো ওজন তারা ফিরে পেতে শুরু করেছে। এমনটি ম্যানচেস্টার সিটির একটি প্রশিক্ষণ দল এসে তাদের ফুটবলের প্রশিক্ষণও দিয়েছে।


তাদের ওই উদ্ধার অভিযানের ওপর ভিত্তি করে অন্তত তিনটি চলচ্চিত্রের কাজ শুরু হয়েছে। ‘দ্য কেভ’ নামের প্রথম চলচ্চিত্রটির চিত্র ধারণের কাজ শেষ হয়েছে। ভার্ন ও অন্য ডুবুরিরা আশা করছেন, গুহা ও জাদুঘরটির মাধ্যমে আশেপাশের ভূচিত্রের নানা অনুষঙ্গ সম্পর্কে মানুষকে জানানো হবে।


জুলাই মাসে উদ্ধার অভিযান চলার সময় গুহার ভেতরের পানি বের করার জন্য বড়সড় সেচ কার্যক্রম শুরু করেছিল কর্তৃপক্ষ। তখন ঘণ্টায় কয়েক মিলিয়ন লিটার পানি বের করে ফেলা হয়, যে পানিতে আশেপাশের ফল আর সবজির ক্ষেত ডুবে গিয়েছিল।


তখন যাদের ক্ষেতখামার ডুবে গিয়েছিল, তাদের একজন ছিলেন আনারস চাষি আরচাউন মোপোআকু, সেখানকার পাহাড়ি একটি গোত্রের বাসিন্দা। তবে সেজন্য তিনি কোনো অভিযোগ করেননি, বরং বেশ কিছুদিনের জন্য ক্ষেতখামারের কাজ বন্ধ করে রাখেন এবং বাঁশ কেটে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেন।



এখনো আরচাউনের আনারস বাগান অনাবাদী রয়ে গেছে। তবে এখন তিনি গুহায় যাবার পথের পাশে পর্যটকদের কাছে কমলা বিক্রি করেন। কারণ পাঁচ মাস পরে সেই গুহাটি থাইল্যান্ডের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।


তিনি বলেন, আনারস বিক্রির চেয়ে কমলা বিক্রি তাকে অনেক বেশি লাভ এনে দিয়েছে। উদ্ধার অভিযানের আগে এই এলাকাটি ছিল বেশ নিরিবিলি। শুধুমাত্র একবার কয়েকজন বিদেশি পর্যটক এখানকার গুহা দেখতে এসেছিল। কিন্তু উদ্ধারের ওই ঘটনার পর অনেক বেশি মানুষ আসছে আর এতে আমার মতো পাহাড়ের মানুষজনের অনেক উন্নতি করছে।


শুধু তিনি একা নন, পথের পাশে ফুল বিক্রি করা হচ্ছে, গ্রিল করা মাংসের খাবার তৈরি হচ্ছে, স্যুভেনিরের দোকান বসেছে, আর বিশেষ করে লটারির টিকেটও বিক্রি হচ্ছে।


গুহার আগে আগে একটি প্লাস্টিক চেয়ারে বসে পার্কের একজন রেঞ্জার দর্শনার্থীদের সংখ্যার হিসাব রাখছেন। আগে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ জন দর্শনার্থী আসতেন, এখন প্রতিদিন ৬০০০ হাজারের বেশি দর্শনার্থী আসছে। তাদের বেশিরভাগই থাইল্যান্ডের বাসিন্দা, যারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে এই গুহা দেখতে আসছেন।



দেশটির এক ম্যাগাজিনের প্রকাশক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ডামরন পুট্টান গুহা দেখতে গিয়ে বলেছেন, এই মুহূর্তে থাম লুয়াঙ্গের মতো আর কোনো আকর্ষণীয় এলাকা আশেপাশে নেই। যখন ওই ঘটনা ঘটে, তখন তিনি ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে দেখতে পান, সেখানেও সেটি কতটা মনোযোগ কেড়েছে।


ভ্যানিসা আচাকুলভিসুট নামে একজন বলেছেন, উদ্ধারের ওই অভিযানের আগে এই গুহাগুলোর কথা আমি জানতাই না। কিন্তু ওয়াইল্ড বোয়ারস ফুটবল টিমের সব খবর পড়ার পর এখানে এসে আমি নিজের চোখে দেখতে বাধ্য হয়েছি।



গুহার ওপরের পাহাড়ি এলাকাটির নামকরণ হয়েছে পুরাকাহিনীর নাঙ নোন নামের এক রাজকুমারীর নামে, যিনি নিষিদ্ধ প্রেমের জের ধরে আত্মহত্যা করেন, যার ঘুমন্ত চেহারার আদলেই এই পাহাড়ি এলাকাটি গঠিত হয়েছে বলে লোককাহিনী প্রচলিত আছে। এসব গুহাকে ঐতিহ্যগতভাবে রহস্যময় শক্তির উৎস বলে থাইল্যান্ডে মনে করা হয়।


গুহার প্রবেশ পথের কাছাকাছি নাঙ নোনের একটি মন্দির রয়েছে, যেখানে লোকজন তার জন্য নানা উৎসর্গ করে থাকে। কিন্তু সেই আলোচিত উদ্ধার অভিযান যেন তার জন্যও সুভাগ্য বয়ে এনেছে। যেসব দর্শনার্থীরা গুহাটি দেখতে আসছেন, সবাই ফুল নিয়ে এসে নাঙ নোনের মন্দিরে প্রার্থনাও করে যাচ্ছেন।


লটারি কেনার জন্য এই জায়গাটিও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে জনপ্রিয় নম্বরটি হচ্ছে ১৩, কারণ এই গুহায় ১২ কিশোর আর তাদের কোচ মিলে ১৩ জন আটকা পড়েছিলেন।


এখন সেখানে আরো একটি প্রার্থনার কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। সেটি হলো তিন মিটার উচ্চতায় ডুবুরি সামান গুনানের একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি, যিনি ওই কিশোরদের উদ্ধার অভিযানে গিয়ে মারা যান। আর যে স্থানে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকরা ওই ঘটনাটি প্রচার করেছেন, সেখানে এখন একটি জাদুঘর তৈরির কাজ চলছে।


ব্রিটিশ গুহা বিশেষজ্ঞ ভের্ন আন্সওয়ার্থ


মায়ে সাইয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা সোমসাক কানাখাম মনে করেন, গুহাটি কেন্দ্র করে এই এলাকায় আয় এবং ব্যবসার সুযোগে দরিদ্র মানুষজন উপকৃত হবে। তবে তিনি খানিকটা উদ্বিগ্নতাও বোধ করেন এই কারণে যে, অতিরিক্ত মানুষজন এবং গাড়ির চাপ সামলাতে এখানকার অবকাঠামোর উন্নয়ন করারও জরুরি।


এখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে তিনি ভাবছেন যে, কিভাবে আশেপাশের অন্য আকর্ষণীয় জায়গাগুলোকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা যায়। কারণ এক সময়ে হয়তো উদ্ধার অভিযানের এই আকর্ষণ ফিকে হয়ে আসতে শুরু করবে এবং হয়তো তখন পর্যটকদের সংখ্যাও কমে যেতে শুরু করবে। সূত্র: বিবিসি


বিবার্তা/জাকিয়া

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com