শিরোনাম
যেখানে দুর্গাপূজা সার্থক করেন মুসলমানরা
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:০০
যেখানে দুর্গাপূজা সার্থক করেন মুসলমানরা
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ধর্মান্ধতার রাজনীতি যখন মানুষে মানুষে প্রাচীর তোলার চেষ্টা করছে, তখন মৈত্রী অটুট রাখার যুদ্ধে অক্লান্ত কলকাতার বেলগাছিয়ার আমন কমিটি।


সেখানে দুর্গাপুজোর চার-পাঁচটা দিন পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখেন সংখ্যালঘু মুসলিমরা।


দুর্গাপুজোয় জনঅরণ্যে ভেসে যায় কলকাতা। লক্ষাধিক মানুষের ঢল বা যান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কলকাতা পুলিশ ও পুজো কমিটিগুলো নানা উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এসব তো হাল আমলের। তার অনেক আগে থেকে, তিন দশক ধরে, মুসলমান অধ্যুষিত বেলগাছিয়া অঞ্চলের ‘আমন কমিটি' দুর্গোৎসবের দিনগুলোতে এলাকায় পুজোর ভিড় সামলাতে বা যান নিয়ন্ত্রণ করার কাজ করে আসছে। আমন কমিটির পরিচালনায় স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।


টালা থেকে শুরু করে বেলগাছিয়া জায়গাটা কম বড় নয়, ১০-১২টি বড় মাপের দুর্গাপুজো হয়। ছোট-বড় নানা বাজেটের এই পুজোগুলিতে উপচে পড়া ভিড় হয়। পুজোর উৎসাহী দর্শনার্থীরা যখন সকাল থেকে রাত অবধি এক মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপে চক্কর কাটেন, তখন তাঁদের গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেন এঁরাই। কলকাতার পুলিশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তাঁদের এই উদ্যোগ। পুজোর যানজট নিয়ন্ত্রণে, ভিড় সামলাতে বা ইভটিজিং রুখতে আমন কমিটির ৬০-৭০ জন স্বেচ্ছাসেবকই এলাকার ভরসা। এমনকি মণ্ডপে ঝামেলা হলে সেটাও আমন কমিটিই নিষ্পত্তি করে। তিন দশক ধরে কাজই তাঁদের পরিচয় হয়ে উঠেছে।


বেলগাছিয়া মোড়ে পুজোর দিনগুলোতে ক্যাম্প করেন তাঁরা। আমন কমিটির সম্পাদক শওকত আলী ডয়চে ভেলেকে জানান, ১৯৮৫ সাল থেকে শুধু দুর্গাপুজো নয়, বরং রথযাত্রা, দোল, মহরম সব ক্ষেত্রেই আমন কমিটির স্বেচ্ছাসেবকেরা দায়িত্ব নিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজটি করেন। দুর্গাপুজোয় এ কাজের জন্য টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়। প্রতিটি পুজো কমিটির সঙ্গে এই টাস্কফোর্স যোগাযোগ রাখে। কখনো কখনো ৫ দিনের ক্যাম্প বেড়ে ৬-৭ দিনও হয়।


আমন মানে শান্তি। সারা ভারতে যখন মানুষের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার বারুদ ঠাসছে রাজনীতি আর অসহিষ্ণু পরিবেশ, তখন তিন দশক ধরে আমন কমিটি কীভাবে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির বার্তা বজায় রাখছে? অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শওকত বলেন, ‘‘আমরা মানুষের বিশ্বাস পেয়েছি আমাদের কাজের জন্যই। রাজনীতিকে আমরা একেবারেই ঢুকতে দিইনি এসবে। এলাকার মানুষ, থানা পুলিশ সবাই আমাদের ওপর ভরসা রাখেন। পুজোর জন্য চাঁদার জুলুমও হয় না আমাদের এলাকায়।''


এবার ১৬ অক্টোবর থেকে শুরু হবে আমন কমিটির ক্যাম্প। এখন রাত জেগে চলছে মিটিং। পুজোর এই আনন্দ উৎসব যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে, তার জন্য সবরকম প্রস্তুতি নেওয়া প্রায় শেষের পথে। কমিটির মতে, এবার এর জন্য খরচ হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু সেই খরচ আসবে কীভাবে? শওকত বলেন, ‘‘আমরা সদস্যরা চাঁদা দিই, কিছু মানুষ ডোনেশন দেন৷ তাতেই খরচ চলে যায়।''


আমন কমিটির কোনোরকম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই, নেই অনুদানও। অন্যদিকে রাজ্যের ২৮ হাজার দুর্গাপুজো ক্লাবকে ১০ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দেয়া হচ্ছে। তবুও আমন কমিটি নিজেদের কাজটা করেই সন্তুষ্ট।


শওকত বলেন, ‘‘একসময় ৪৭টি শান্তি কমিটি ছিল কলকাতায়। এখন আমরাই টিকে আছি শুধু। দেড় লাখ মানুষের শান্তি, নিরাপত্তার দায়িত্ব আমন কমিটির কাঁধে। কমিটিতে স্বেচ্ছাসেবকসহ ৩০০ মানুষের যোগদানই এ কাজকে এত সুন্দরভাবে করতে সাহায্য করছে।''


আমন কমিটির সদস্য শাহিদ আখতার বললেন, ‘‘ভোর ৬ টা থেকে দুটো শিফটে আমাদের কাজ হয়। রাত ১২ টা অবধি চলে, কখনো কখনো রাত ২টা অবধিও করতে হয়।''


বেলগাছিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা ঋভু পত্রনবীশ বলেন, ‘‘কাছেই টালা বারোয়ারির মতো বড় পুজো হয়। দৈনিক যেখানে ৪ লাখ দর্শনার্থীর ভিড় হয়, এই জনস্রোতটা সামলানো যথেষ্ট কঠিন। দুর্গাপুজোয় এভাবে আমন কমিটির ক্যাম্প সত্যিই আমাদের ভরসা জোগায়।''


একসময় বেলগাছিয়া বস্তির অসামাজিক কাজকর্ম রুখতে তৈরি হয়েছিল বেলগাছিয়া পিস কমিটি বা আমন কমিটি। সময়ের পরিক্রমায় তাদের ওপর নানাভাবে মানুষের বিশ্বাস বেড়েছে। তাই বেড়েছে তাদের কাজের পরিধিও। হিন্দু-মুসলিম দুর্গোৎসবের গণ্ডি পেরিয়ে ৩১ ডিসেম্বরের বর্ষশেষের রাত, মাদকবিরোধী দিবস, ট্রাফিক সচেতনতা দিবসেও তারা কাজ করেন পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে। কমিটির সদস্যদের মুখেই শোনা যায়, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে মেটিয়াবুরুজের একদল উন্মত্ত যুবক বেলগাছিয়ার পরেশনাথ মন্দির ভাঙতে উদ্যত হয়। আমন কমিটিই তাদের আটকায়।


বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন আইপিএস অফিসার ড. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের উদ্যোগ সবসময়ই স্বাগত, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। আমরা গ্রামে বড় হয়েছি, দেখেছি হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকে। কিন্তু শহরের দিকেই সমস্যা দেখা যায়। এখানে বিষয়টা এত স্বাভাবিক নয়। তাই শহরে এ ধরনের উদ্যোগ জরুরি।''


সূত্র : ডিডাব্লিউ



বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com