এক দশকেরও বেশি সময়! আফগান মেয়েটি আর মেয়ে নেই। বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ছেলে সেজে রয়েছে সিতারা ওয়াফাদার। এই কিশোরীর মা-বাবা পুত্রসন্তান না থাকার আক্ষেপে সিতারাকেই জোর করে ‘ছেলে’ সাজিয়ে রেখেছেন।
সিতারারা পাঁচ বোন, কোনো ভাই নেই। কাদামাটির চার দেয়ালের মধ্যে বাস তাদের। আফগানিস্তানের পশ্চিমের প্রদেশ নানগরহরে থাকে সিতারারা। এখানে একটি প্রথা রয়েছে, ‘বাছা পোশি’। স্থানীয় দারি ভাষায় যার অর্থ মেয়েকে ছেলে সাজিয়ে রাখা। আর ছেলে-রূপী মেয়ে পরিবারের যে কোনো ছেলের মতোই সব কাজ করতে পারে।
আফগানিস্তানের কট্টরপন্থী ছোট এই প্রদেশে মেয়েরা তুলনায় অনেক বেশি কোণঠাসা। যে সব পরিবারে উত্তরাধিকারী হিসেবে কোনো পুত্রসন্তান নেই, তাদের মধ্যেই এই প্রথার চল রয়েছে। তারা মেয়েকে ছেলে সাজিয়ে ভাবেন, ‘ছেলের মতো’ দায়িত্ব পালন করবে সে। তার চেয়েও বড় কথা, পরিবার ভাবে ছেলে সাজলে আর সন্তানকে হেনস্থার মুখে পড়তে হবে না। আর ছেলের ছদ্মবেশ ধরায় পিতৃতান্ত্রিক দেশটিতে তারা নিরাপদে সব কাজ করতে পারেন।
কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক বারইয়ালাই ফেতরাত জানান, বাছা পোশি একেবারেই আফগানিস্তানের রক্ষণশীল এলাকার প্রথা।
সিতারা এখন ১৮’তে পা দিয়েছেন। সকাল সকাল ব্যাগি শার্ট এবং প্যান্ট গলিয়ে বেরিয়ে পড়েন। খয়েরি ছোট চুল কখনো কখনো ঢেকে নেন স্কার্ফ দিয়ে। গলাটা যথাসম্ভব ভারী করে কথা বলার চেষ্টা করেন যাতে কেউ বুঝে না ফেলে! দরিদ্র পরিবার তার। তাই ইট তৈরির কারখানায় সপ্তাহে ছ’দিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। আট বছর বয়স থেকে এই রুটিন সিতারার। চামড়া পুড়ে এখন বাদামি। বৃদ্ধ বাবাও যান তার সঙ্গে।
সিতারা বলেন, আমি কখনো ভাবিই না যে আমি মেয়ে! বাবাও বলেন, সিতারা আমার বড় ছেলের মতো। কারো কারো অন্ত্যেষ্টিতেও যাই বাবার সঙ্গে।
মেয়ে হলে এই সুযোগ কখনোই হত না তার। সিতারার বোনেরাও ছোটবেলায় যেত কারখানায়। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে তারা আর যায় না। স্কুলের মুখ দেখেনি কেউই।
তবে বয়ঃসন্ধির পরে অবশ্য ছেলে সাজা অনেক মেয়েই ফিরে আসে নিজের জীবনে। কিন্তু ব্যতিক্রম সিতারা। তিনি এখনো ছেলে সেজেই আছেন। নয়তো কারখানায় তাকে ঝামেলায় পড়তে হবে বলে দাবি তার। সিতারা বলেন, ওখানে কেউ বোঝে না, আমি মেয়ে। যদি বোঝে ওদের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোনো মেয়ে কাজ করছে, তা হলে আমার কী হবে কেউ জানে না। অপহরণও করতে পারে ওরা!
তার আর কোনো উপায়ও নেই। ৫০০টি ইট তৈরি করে ১৬০ আফগানি (দু’ডলারের সামান্য বেশি) মেলে। কারখানা মালিক আর আত্মীয়স্বজনদের কাছে ২৫ হাজার আফগানি ঋণ রয়েছে। মায়ের চিকিৎসায় অর্থ শেষ। তাই কারখানার কাজ ছাড়লে চলবে না সিতারার।
সিতারার বাবা নূর বলেন, যদি আমার একটি ছেলে থাকত, আমাকে এই ধরনের সমস্যা মুখোমুখি হতে হতো না। আমার মেয়ের জীবন শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর হতো। পরিবারের ভরণপোষণ এবং ঋণ পরিশোধের সব দায়িত্ব আমার ও মেয়ের কাঁধে।
কিন্তু দীর্ঘ সময় ছেলে সেজে থাকতে থাকতে লিঙ্গ-পরিচয় নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয় না? অধ্যাপক ফেতরাত বলেন, পুরুষ-প্রধান সমাজে এমন সঙ্কট হতে বাধ্য। এর পরে এই সব মেয়েরা বাধ্য বৌয়ের ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারে না। অবসাদের শিকার হয়।
রক্ষণশীল আফগানিস্তানে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের কদর বেশি। নারীদের বেশির ভাগ সময় নিজ বাড়ির গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। বাবা ছাড়া তাদের পরিবারের কোনো পুরুষ মানুষ নেই। বাইরের সমাজে মেয়েদের পদে পদে সমস্যা সৃষ্টি হয়, যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু ছেলে হলে আর এসব সমস্যা স্পর্শ করতে পারে না। মূলত মেয়েদের জটিলতা এড়াতে এবং দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করতেই সিতারার এই ছদ্মবেশী জীবনযুদ্ধ। সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা ও এএফপি
বিবার্তা/জাকিয়া
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]